মাস্ক পরতে ব্যক্তির সদিচ্ছাই যথেষ্ট
মহামারীর গত দেড় বছরে এখনই সবচেয়ে বিপর্যয়কর অবস্থা চলছে বাংলাদেশে। করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণে গত এপ্রিল থেকে রোগীর সংখ্যা বাড়ছিল। মে মাসে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও জুলাই মাসে এসে তা আগের সব রেকর্ড ভাঙছে। এরপর আগস্টের পরিস্থিতি আগের সব হিসাব পাল্টে দিতে পারে এমন শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের আশঙ্কা, ঈদযাত্রা-গরুর হাট আর কেনাকাটায় স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত থাকায় মধ্য আগস্টে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি সামলাতে আরেক দফা লড়তে হবে দেশকে। কিন্তু সেই লড়াইয়ের চাপ সামলানোর সক্ষমতা কতটুকু রয়েছে আমাদের? গণমাধ্যমের সংবাদ বলছে মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে গত কয়েক সপ্তাহে স্বাস্থ্যসেবায় যে চাপ পড়েছে, তা সামলাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতালগুলোকে। ঝুঁকিপূর্ণ রোগী বাড়ায় সাধারণ ও আইসিইউ শয্যা কোনোটাই ফাঁকা থাকছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে আরও বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার ভয় রয়েছে।
স্বাস্থ্যবিধি না মানার পাশাপাশি গ্রামে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়াকেও বর্তমানে পরিস্থিতি অবনতির কারণ হিসেবে দেখছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, গ্রামে গ্রামে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। একসময় বলা হতো গ্রামে করোনাভাইরাস নেই। কিন্তু এখন গ্রামই শঙ্কার জায়গা। মানুষ রাস্তায় থাকবে আর সংক্রমণ ও মৃত্যু কমবে এটা কোনোভাবেই আশা করা যায় না। যেহেতু এখনো সবাইকে ভ্যাকসিন দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই এই কঠোর বিধিনিষেধ যদি পুরো দেশের জনসাধারণ মেনে চলে, তারা যদি মাস্ক ও স্বাস্থ্যবিধি নিজেদের স্বার্থেই পরে; তবে সংক্রমণ কমার পাশাপাশি আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যুর হার কমবে। কিন্তু বিগত সময়ের মতো অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার দিকে অধিক গুরুত্ব দিলে কঠোর বিধিনিষেধ নিশ্চিত করা সরকারের পক্ষে কঠিন হবে বলে মনে করেন অনেকেই।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মাস্ক পরলে ‘জীবাণু বহনকারী ড্রপলেট’ থেকে সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব। তাই পাবলিক প্লেসে মাস্ক পরা উচিত। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ফেস মাস্ক পরলে শরীরের ভেতর অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণ করোনাভাইরাস ঢুকতে পারে। সে ক্ষেত্রে হয়তো তার উপসর্গ হবে খুবই মৃদু বা আদৌ কোনো উপসর্গ দেখা যাবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় সংক্রামক-ব্যাধি-বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একজন মানুষের সংক্রমণ কতটা গুরুতর তা জানার ক্ষেত্রে তার দেহে কী পরিমাণ ভাইরাস ঢুকেছে তা গুরুত্বপূর্ণ। তাই মাস্ক পরলে, যিনি মাস্ক পরছেন তিনি যেমন সুরক্ষিত থাকেন তা শুধু নয়, এটা অন্যদেরও ভাইরাস সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।
বেশ কিছুদিন আগে দ্য প্রসিডিংস অব ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস-এ (পিএনএএস) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীরা জানান, মহামারীর বিস্তার রোধে কোনো কোনো সময় শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং বাসায় থাকার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় মাস্ক পরিধান করা। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, উত্তর ইতালি ও নিউ ইয়র্ক শহরে মাস্ক পরার নিয়ম জারির পর সে সময় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রাদুর্ভাবের এই দুই এলাকায় সংক্রমণের প্রবণতা নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। নিউ ইয়র্কে বাধ্যতামূলক মাস্ক পরার নিয়ম কার্যকর হওয়ার পর নতুন সংক্রমণের হারও প্রতিদিন ৩ শতাংশ করে হ্রাস পেয়েছিল। বছরখানেক ধরে সরকারি ও বেসরকারি সচেতনতামূলক নানা উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও মানুষের মধ্যে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় উদাসীনতা রয়েই গেছে, যা লক্ষ করা যায় সারা দেশের হাট-বাজার, মার্কেট, ফেরি ও পরিবহনগুলোতে। নিজেকে ও পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে মানুষ স্ব-উদ্যোগেই মাস্ক পরবে, স্বাস্থ্যবিধি মেলে চলবে এবং কেউ মাস্ক না পরলে সামাজিকভাবেই তাকে বাধ্য করা হবে এমনটা সারা দেশে শতভাগ নিশ্চিত করা গেলে ভাইরাসের সংক্রমণ যেমন কমবে, তেমনি কঠোর বিধিনিষেধ প্রয়োগ বা লকডাউন দেওয়ারও প্রয়োজন হবে না। এটি করতে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সচেতনতাবোধ তৈরি অধিক প্রয়োজন। আর ব্যক্তির ইচ্ছা ও উদ্যোগেই এটি নিশ্চিত করা যায় খুব সহজেই।
তাই বাংলাদেশেও মাস্ক পরার বিষয়ে কঠোরতার পাশাপাশি ব্যক্তিগত সচেতনতাবোধ বৃদ্ধির কৌশল নিয়েও সরকারকে নতুন করে ভাবতে হবে। সরকারি উদ্যোগ ও সচেতনতায় অধিকসংখ্যক মানুষ এখন নিজের কাছে মাস্ক রাখছে। এটিও এক ধরনের সফলতা বা অগ্রগতি। এখন সেই মাস্ক যেন সঠিক জায়গায় সঠিক নিয়মে মানুষ পরে সে বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি সচেতনতামূলক কার্যক্রম বা উদ্যোগ হাতে নেওয়া প্রয়োজন। তরুণ ও যুবকদের মধ্যে মাস্ক পরার প্রবণতা খুবই কম। বিনা কারণে তারা বাইরে বের হয়। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে করোনাভাইরাসে যুবকরা আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো হওয়ায় করোনাভাইরাস হয়তো তাদের কাবু করতে পারছে না। কিন্তু যুবকদের উদাসীনতায় পরিবারের বয়স্ক ও শিশুরা যেমন আক্রান্ত হচ্ছে, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে তাদের মৃত্যুর কারণ হয়েও দাঁড়িয়েছে যুবকরা, যা মোটেই কাম্য নয়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলাকাবাসী যদি সতর্ক ও সংগঠিত না হয় তাহলে শুধু প্রশাসনিক আদেশ দিয়ে খুব বেশি কিছু হবে না। জনগণ, সরকার এবং প্রশাসনকে নিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সংক্রমণ মোকাবিলায় শুরু থেকেই আমরা সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলে আসছি। দেরিতে হলেও সরকার সেটি হাতে নিয়েছে। এরই মধ্যে সারা দেশে ওয়ার্ডভিত্তিক কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওই কমিটি যেন কাগজে-কলমে রাজনৈতিক কমিটি হয়ে না যায়। মহামারীর এ সময়ে প্রকৃত উদ্যোগী ও দায়িত্বশীল ব্যক্তির সমন্বয়েই হোক কার্যকর উদ্যোগ। নিজেকে ও পরিবারকে সুস্থ রাখার দায়িত্ব সবার আগে নিজেদেরই। সেটি করতে হলে মাস্ক পরতে হবে। আর মাস্ক পরতে ব্যক্তির সদিচ্ছাই যথেষ্ট।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৬ জুলাই ২০২১
© 2021, https:.