মুক্তিযুদ্ধ

বীরগাথা ১৯৭১: ভুল করে বলে ফেললাম ‘কর্তা’ ইজ ডেড

বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল বীর প্রতীক। আট ভাই ও তিন বোনের পরিবারে তিনি সপ্তম। ১১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু তাহের (তখন মেজর ছিলেন) তার বড় ভাই। তিনি ছাড়াও তার পাঁচ ভাই ও এক বোন সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযোদ্ধা বেলাল ভারতের তুরা থেকে দুই মাসের বেসিক ট্রেনিং শেষে এক্সপ্লোসিভের ওপর বিশেষ ট্রেনিংও সমাপ্ত করেন। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন হালুয়াঘাটের ঘোষগাঁও বিওপি এলাকায়। এরপর সেক্টর গঠন হলে চলে যান ১১ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টার মহেন্দ্রগঞ্জে। সেখানেই দেখা হয় বড় ভাই আবু তাহেরের সঙ্গে।

ভাই হিসেবে এনট্রেন্স ওখানে তাদের ছিল না। কর্নেল তাহের বলতেন ‘নো মোর ভাই বিজনেস।’ বেলালরাও তাকে স্যার অ্যাড্রেস করতেন। তিনি তাদের নিয়ে একটি সেকশন তৈরি করে দেন। যার কমান্ড করতেন আরেক ভাই বাহার। কর্নেল তাহেরের সঙ্গে থাকাই ছিল তাদের কাজ। কামালপুর অপারেশনে কর্নেল তাহের রক্তাক্ত হওয়ার দিনও বীর প্রতীক ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল তার সঙ্গে ছিলেন। কীভাবে সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের আহত হলেন, দেশের জন্য হারালেন একটি পা? প্রশ্ন শুনে খানিক নীরব থাকেন এই যোদ্ধা। অতঃপর বলতে থাকেন ওই দিনের আদ্যোপান্ত। ওয়ারেসাত হোসেন বেলালের ভাষায় “কামালপুর ছিল পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালী বিওপি। ওখানে ওদের বাংকার ছিল সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারে হিটলার বাহিনীর বাংকারের মতো। এরপর প্রচুর মুভিট্রপস বিছানো থাকত। ফলে এগোনো খুব কঠিন ছিল। আগেও কামালপুরে বেশ কয়েকটা অপারেশন হয়। কিন্তু এবারের অপারেশনটা ভিন্ন ধরনের। আমাদের সঙ্গে এসে যুক্ত হয় ভারতের মারাঠা রেজিমেন্ট, গুরখা রেজিমেন্ট আর গার্ড রেজিমেন্ট। সবগুলোর কমান্ডে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার। সিদ্ধান্ত হয় অপারেশনটির নেতৃত্ব দেবেন সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের (তখন মেজর ছিলেন)।

পরিকল্পনাটা কী? আমাদের লেভেলে জানানো হয়নি। তবে বুঝতে পারছিলাম বড় ধরনের কোনো অপারেশন হবে। কারণ, প্রচুর ইন্ডিয়ান আর্মি আসে, সঙ্গে অস্ত্রও। সিক্সটিন পাউন্ডার ক্যাননের মতো হেভি আর্টিলারি, মিডিয়াম আর্টিলারিগুলো সাজানো হয় একের পর এক। ১৩ নভেম্বর ১৯৭১। দুপুরে তাহের কমান্ডারদের নিয়ে বসলেন। বলা হলো রাত ১২টার পরেই অর্থাৎ ১৪ নভেম্বর কামালপুর অ্যাটাক করা হবে। ওই দিন ছিল তাহেরের জন্মদিন। বলা হলো, তাহেরের কোড হবে ‘কর্তা’। যে কেউ যোগাযোগ করবে ‘কর্তা’ বলে। রাত ১১টায় রওনা হলাম। কামালপুরের আগেই বানরোড। তারও পেছনে তাহেরের কমান্ড পোস্ট। আমরা ওখানেই পজিশন নিই। পাশেই ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার, গুরখা রেজিমেন্টে কর্নেল বারাখ, মারাঠা রেজিমেন্টের কর্নেল বুলবুল, গার্টস রেজিমেন্টের বারাট। আর্টিলারি ফায়ারের পর শুরু হবে অপারেশন। রাত তখন ১২টা। মুহুর্মুহু শেল ড্রপিং হচ্ছে কামালপুর বিওপির ওপর। প্রায় সাড়ে তিন হাজার আর্টিলারি থ্রো করা হয়েছিল। পাকিস্তানি সেনারাও ফায়ার করছে। ট্রেসার ফায়ারও যাচ্ছে। চরম এক উত্তেজনা।

নির্দেশ ছিল মুক্তিযোদ্ধারা চার্জ করবে ‘জয়বাংলা’ বলে। কিছুক্ষণ পর চারপাশ থেকে ‘জয় বাংলা’র চিৎকার। কর্নেল তাহেরের কাছে একটা ওয়াকিটকি। সেখানে লেফটেন্যান্ট মিজান জানালেন ‘কর্তা আমরা পাকিস্তানিদের প্রথম লাইনের বাংকার দখল করে নিয়েছি।’ তখন আনন্দে জয় বাংলা স্লোগান তুলি। রাত তখন ৩টার মতো, মিজানের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে না। ওয়াকিটকিতে কর্নেল তাহের বারবার বলছিলেন ‘মিজান, তুমি কোথায়? ওপাশে কোনো সাড়া নেই। তিনি চিন্তিত হয়ে গেলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তাহেরের ফিলিংসটা সব সময়ই ছিল অন্যরকম। ভোর হয়ে আসছে। হঠাৎ উনি কমান্ড পোস্ট থেকে উঠে গেলেন। ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারকে বললেন ‘আমি ফ্রন্টে যাব।’ তিনি বলেন ‘হোয়াট।’ তাহের বলেন ‘আই হ্যাভ টু সি মাই বয়।’ বলেই আমাদের নিয়ে তিনি সামনে রওনা হন। বানরোডের কাছে গিয়ে বর্ডার ক্রস করি। এরপরই একটা আমবাগান। শেলের আঘাতে পাকিস্তানিদের বাংকারগুলো ভেঙে গেছে। ওরা বেরিয়ে আখক্ষেতে লুকাচ্ছে। দূর থেকে তা দেখছি আমরা।

তাহের ভাই বান রোডের ঢালে এসে বসলেন দুই পা ভাঁজ করে। এক পাশে আমি, আরেক পাশে বাহার, পেছনে তিন-চারজন পজিশনে। তিনি গলফ স্টিক দিয়ে পাকিস্তানিদের দেখালেই, ওদিকে ফায়ার দিচ্ছি আমরা। এর মধ্যেই হঠাৎ একটা আওয়াজ হলো। খেয়াল করলাম কর্নেল তাহের আমার ওপর পড়ে যাচ্ছেন। দেখলাম তার বাঁ পা-টা প্রায় বিচ্ছিন্ন, দু-তিনটা ভেইনের সঙ্গে ঝুলে আছে কোনো রকমে।

পাকিস্তানিদের শেলের আঘাতে?

ওই সময় মনে হয়েছে শেলের আঘাত। কিন্তু পরে অনেক হিসাব করে দেখলাম শেল ড্রপিং হলে তিনি বেঁচে থাকতেন না। তার শরীরের অন্যান্য জায়গাও ইনজুরড হতো। ওটা আসলে অ্যান্টিপারসনাল মাইন ছিল, যা তার পায়ের চাপে বিস্ফোরিত হয়। তাকে ধরতে গেলে তিনি বলেন ‘আমার কিছু হয়নি। তোমরা যুদ্ধটা চালিয়ে যাও।’ রক্ত গিয়ে কর্নেল তাহের নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছেন। আমি তখন ভুল করে ওয়াকিটকিতে বলে ফেললাম ‘কর্তা’ ইজ ডেড।

পাকিস্তানি সেনারা তখন এগিয়ে আসার চেষ্টা করে। আমরাও তাদের ফায়ার করি। মুক্তিযোদ্ধারা একটা কুঁড়েঘরের দরজা ভেঙে নিয়ে আসেন। ওটায় শুইয়ে প্রথম টেনে নেওয়া হয় কর্নেল তাহেরকে। বেশ দূরে একটা আর্মার গান আনা হয়েছিল জিপে করে। দৌড়ে গিয়ে আমি ওই জিপটা এনে তাকে তুলে নিই। মনোবল তখনো তার ভাঙেনি। এর মধ্যেই আনোয়ার ভাই চলে আসেন। তাকে দেখেই কর্নেল তাহের বললেন ‘দেখো আমার মাথায় ওরা হিট করতে পারে নাই। তোমরা কামালপুর মুক্ত করবে। আমি ফিরে এসে যেন দেখি কামালপুর মুক্ত হয়েছে।’ চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে তাকে প্রথমে তুরা এবং পরে নিয়ে যাওয়া হয় গৌহাটিতে। কামালপুর ওই দিন দখল করতে না পারলেও মুক্তিযোদ্ধারা পরে সেটি দখল করেছিলেন।”

স্বাধীনতা লাভের পর দেশ গড়ার কাজে মুক্তিযোদ্ধাদেরও নিয়োজিত করা প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন বীর প্রতীক ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল। বাকশাল গঠন প্রসঙ্গে তিনি অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতটি ‘ইন ওয়ান সেন্স, ফরমেশন অব বাকশাল ওয়াজ টু লেট। ইন এনাদার সেন্স ইট ওয়াজ টু আরলি। বাকশালটা গঠন করা উচিত ছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই। তখন মুক্তিযোদ্ধারা এক জোট ছিল। ফলে বঙ্গবন্ধুর স্ট্রেংথ থাকত অন্যরকম। বাকশালের থিমটা ঠিক ছিল। কিন্তু যখন বাকশাল গঠন করা হলো তখন মুক্তিযোদ্ধারা ছিল বিভক্ত। আর সরকারের ভেতর আগাছাও ঢুকে গিয়েছিল অনেক।’

কর্নেল তাহেরকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

“মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহের- শতভাগ সফল। জাসদে তার যেটুকু দায়িত্ব ছিল, তার যে অ্যাসাইনমেন্ট ছিল, তিনি তা শতভাগ পালন করেছিলেন। কিন্তু জাসদের বাকি নেতৃবৃন্দ তা করেনি। পোস্তাগলা, টঙ্গি আমাদের শ্রমিক বেল্ট। শ্রমিকরা ওখান থেকে এসে ঢাকায় ফ্লাডেড হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। অথচ কেউ বিন্দুমাত্র মুভ করে নাই। ফলে আমরা আমাদের ভাইকে হারিয়েছি। আমার মনে হয়, কর্নেল তাহের মৃত্যুটাকে আলিঙ্গন করেছেন। হয়তো তিনি ভেবেছেন তার মৃত্যুর মধ্য দিয়েই উনি যে স্বপ্নটা দেখেছেন সেটা প্রজন্মের কাছে বেঁচে থাকবে।”

কর্নেল তাহের কি পরাজিত?

মুক্তিযোদ্ধা বেলালের অকপট উত্তর, “নাহ, তাহের ভাই পরাজিত নন। পরাজিত জাসদের ওইসব নেতারা যারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বটা পালন করেননি।”

নতুন প্রজন্মের হাত ধরেই এ দেশ এগিয়ে যাবে। তবে তাদের গাইডলাইনটাও তৈরি করে দিতে হবে সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমে। এমনটাই মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল বীর প্রতীক। চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি বললেন, শেষ কথাগুলো ‘মুক্তিযুদ্ধটা হয়েছিল একটি অসাম্প্রদায়িক চিন্তা থেকে। সে চিন্তাটি তোমরা বাঁচিয়ে রেখো। দেশটাকে ভালোবেসো। মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের ইতিহাসকে অন্তরে ধারণ করো। অন্যায়কে প্রশ্রয় দিও না। মানুষের বিপদে তার পাশে দাঁড়িও। মনে রেখো, এটাই বাঙালির সবচেয়ে বড় শক্তি।’

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সংবাদ প্রকাশে, প্রকাশকাল: ১৩ আগস্ট ২০২১

© 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button