হৃদয়ে লেখা নাম-শেখ মুজিব
মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে কতটা অনিবার্য ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান? কোন গুণাবলির কারণে বঙ্গবন্ধু তাদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন? এমন নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পাওয়া কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার মুখোমুখি হই। বঙ্গবন্ধুর কথা স্মরণ করে যারা আজও আন্দোলিত ও উদীপ্ত হন।
শুরুটা করেন টাঙ্গাইলের কালীহাতি উপজেলার যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আশরাফ হুমায়ুন বাঙ্গাল। একটি অজানা ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘১৯৭০-এর নির্বাচনের পরের ঘটনা। মিছিল-মিটিং করাও তখন কঠিন ছিল। আমি টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক, সেক্রেটারি কাদের সিদ্দিকী। আমরা চ্যালেঞ্জ নিয়েই একদিন মিটিং করলাম, কালীহাতির চারাণ এলাকায়। মিছিল বের হলে তাতে যোগ দেয় শত শত লোক। এরপর একদিন কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে যাই ঢাকায়। দেখা করি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে, ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরের বাড়িতে। নেতার সঙ্গে ওটাই প্রথম দেখা। মিটিং-মিছিল করার ঘটনা শুনেই খুব খুশি হন। বসা ছিলেন। উঠে এসে আমাদের সামনে দাঁড়ালেন। অতঃপর হাত দিয়ে বুকে আলতো ধাক্কা দিয়ে বললেন, ‘সাবাস বাঙ্গাল’। বলেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কী যে ভালো লেগেছিল ওইদিন। নেতার সংস্পর্শে সাহস একশ গুণ বেড়ে গিয়েছিল। ওই স্মৃতিটা এখনো ভাবলে চোখ দুটো ভিজে যায়। আমার নাম ছিল কাজী আশরাফ হুমায়ুন। এর পর থেকেই নামের শেষে ‘বাঙ্গাল’ শব্দটা লাগাই। নাম হয় ‘কাজী আশরাফ হুমায়ুন বাঙ্গাল।’ এখন ‘বাঙ্গাল’ বললেই সবাই একনামে চেনে। বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার বাসনাতেই একাত্তরে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি। তাই আজও শেখ মুজিব আমাদের হৃদয়ে লেখা একটি নাম।’
কুষ্টিয়ার এক যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে স্মৃতিময় ছবিগুলো এখনো আগলে রেখেছেন। তার নাম সোহরাব গণি দুলাল। স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার দিনটি আজও তার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। তার ভাষায়, ‘তৎকালীন খাদ্য প্রতিমন্ত্রী ও কুষ্টিয়া সদরের এমপি ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে যান বঙ্গবন্ধুর কাছে। তিনি তখন বসতেন রমনা পার্কের উল্টোপাশে, সুগন্ধায়। তার স্পর্শ পাওয়ার ইচ্ছায় ছবি তোলার সময় আমি বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে গিয়ে বসি। ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন তিনি। দুই হাতে ঘাড় স্পর্শ করে বললেন, এই তোর নাম কিরে? উত্তরে বলি, ‘আমার নাম সোহরাব গণি দুলাল।’ শুনেই তিনি আমার ঘাড়ে আবার থাবা দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন ‘ও তুই আলালের ঘরের দুলাল’। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই স্মৃতিটা থাকবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মা ভয়ে তার সঙ্গে আমার ছবিগুলো বালিশের ভেতর লুকিয়ে রাখতেন। তখন তো বঙ্গবন্ধুর কথা মুখেই আনা যেত না। প্রকাশ্যে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় ও জয় বাংলা বলতেও পারিনি আমরা। বঙ্গবন্ধু মহাচুম্বক। উনার সংস্পর্শে একবার যদি কেউ এসেছে, সে তাকে কখনো ভুলবে না। আমাদের কাছে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ দুটো অবিচ্ছেদ্য নাম। এটা ভাগ করা যাবে না। এত বড় মেহনতি মানুষের নেতা আর আসবে না। আন কম্প্যায়েরেবল, আন প্যারালাল লিডার। বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধুই।’
ঢাকার গেরিলা বীরপ্রতীক শেখ আব্দুল মান্নান পড়তেন শাহীন স্কুলে। তিনি ছিলেন শেখ কামালের বন্ধু। সে সুবাদেই যাতায়াত ছিল বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। কেমন দেখেছেন জাতির জনককে? তার ভাষায়, ‘শেখ মুজিবের স্মরণশক্তি ছিল অন্যরকম। একদিন দেখলাম আওয়ামী লীগের লোকজন আসছে কোনো এক জেলা থেকে। উনি পাইপ টানতে টানতে হঠাৎ বলেন, ‘ওই, তুই করিম না? তোর বাড়ি পঞ্চগড় না।’ আমি ভাবি, এত লোকের মাঝে উনি নাম মনে রাখলেন কীভাবে! কাউকে আবার কাছে ডেকে নিয়ে পকেটে গুঁজে দিচ্ছেন ৫০-১০০ টাকা। গ্রাম-গঞ্জ থেকে যেই আসত লিডারের সঙ্গে দেখা করে যেত। মুজিবের কাছে যেতে তাদের ভয় হতো না। শেখ মুজিবের মতো সাধারণ মানুষ আর অসাধারণ স্মরণশক্তি এত বছরে আর একজনও পাইনি।’
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কথা হয় দুই নম্বর সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মো. আবুল হোসেনের সঙ্গেও। নেতাকে প্রথম দেখার স্মৃতি আজও তাকে আন্দোলিত করে। তার ভাষায়, ‘১৯৬৬ সালের ঘটনা। খবর পাই শেখ মুজিব চৌমুহনী হয়ে সামনের রাস্তা দিয়েই যাবেন রায়পুরে। আমরা ভাইরা মিলে তখন কাগজ আর বাঁশ দিয়ে নৌকা বানাই। ওইসময় সেটা টাঙাচ্ছি বাড়ির সামনের রাস্তায়। হঠাৎ গাড়ির শব্দ। দেখলাম কচ্ছপের মতো একটা গাড়ি আসছে। ওই গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে আসেন শেখ মুজিবুর রহমান। ছয় ফুটের ওপর লম্বা, ফর্সা একটা মানুষ। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরা, কালো একটা কোটও জড়ানো। ভাবছি এত লম্বা একটা লোক এই কচ্ছপের মতো ছোট্ট গাড়িতে কীভাবে ছিলেন। উনি এসে বানানো নৌকাটি দেখলেন। এরপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কথা বললেন একান্তভাবে। ওই স্পর্শ ও দৃশ্যটা মনে গেঁথে গেছে। গাছ থেকে ডাব পেড়ে আনা হলো। কিন্তু সেটা দেওয়ার জন্য গ্লাস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। শেখ মুজিব ডাবটি মুখে নিয়েই পানি খেতে থাকলেন। ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে তার শরীরে। এখনো সে স্মৃতি দারুণভাবে মনে হয়।’
মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা ছিল বঙ্গবন্ধু এমনটাই মনে করেন এই বীর যোদ্ধা। বলেন, ‘আমরা শুরু করেছিলাম শূন্য হাতে। ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শক্রর মোকাবিলা করতে হবে…। তার ওই নির্দেশেই পিটি-প্যারেড আর বাঁশের লাঠি দিয়েই যুদ্ধ শুরু করে এ জাতি। থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে তো এলএমজির সামনে দাঁড়ানো যায় না! কিন্তু তবুও বুকভরা সাহস আর মনোবলটা ঠিক রেখে বাঙালি দাঁড়িয়েছিল। তাই বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা একই অর্থে বহমান।’
স্বাধীনতা লাভের পর প্রিয় নেতা ও জাতির পিতার হত্যাকান্ড প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ সারা পৃথিবীব্যাপী আমাদের যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে আমরা নিজেদেরই নিচে নামিয়ে এনেছিলাম। একবার জাপানে গিয়েছি। ওরা বলেছিল, ‘কেমন জাতি তোমরা? যাকে জাতির পিতা করেছ, সেই পিতাকেই তোমরা মেরে ফেললে’।’’ এই হত্যাকা- শুধু সরকার পরিবর্তনের জন্য নয়। একাত্তরের পরাজিত শক্তির প্রতিশোধের অংশও ছিল এটি। যেখানে অংশ নিয়েছিল সেনাবাহিনীর কিছু কুলাঙ্গার। বঙ্গবন্ধু দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও তিন প্রজন্ম নিয়ে নিজের বাড়িতেই ছিলেন। সাধারণ মানুষের আসার কথা চিন্তা করে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাও নেননি। সবাইকে উনি নিজের লোক মনে করতেন। বাঙালিদের কেউ তাকে মারবেএটা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। একটি বিশ্বাসের অপমৃত্যু ঘটে পনেরোই আগস্ট।
কথা হয় সিলেটের যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা জামাল পাশার সঙ্গেও। তার মনে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নানা ভাবনা তৈরি করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। কীভাবে? তার ভাষায় ‘‘৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে নেতাদের সঙ্গে চলে যাই ঢাকায়। খুব কাছ থেকে প্রথম দেখি বঙ্গবন্ধুকে। উনি মঞ্চে উঠলেন। মূর্তির মতো দেখেছি তাকে। যেন আমার অনেক আপন! তিনি বললেন‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে…।’ মনের মধ্যে প্রশ্ন শত্রু কে? তিনি আর্মিদের উদ্দেশে বললেন ‘তোমরা ব্যারাকে থাকো…..গুলি চালাবার চেষ্টা কোরো না…।’ পরিষ্কার হয়ে গেলাম শত্রু আসলে কারা। শেষে বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ মাথায় তখনই ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি গেঁথে গেছে। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘মুক্তির সংগ্রাম’। আমার ভেতর তখন ‘মুক্তি’ আর ‘স্বাধীনতা’ শব্দ দুটি খেলা করতে থাকে।’’
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর প্রতিবাদ করায় বাহাত্তরটি মামলা করা হয় এই মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে। দুইবার গুলির অর্ডারও দেওয়া হয়েছিল তখন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন ‘‘যারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছে তারা মানুষ নয়, নরপশু। চিফ অব আর্মি স্টাফ সফিউল্লাহ তো জীবিত ছিলেন। উনি তো মুখও খুলেননি! জিয়ার সময় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের কথা বললে মৃত্যু অবধারিত ছিল। তবুও কিন্তু কথা বলে গেছি।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সেনাবাহিনীর ভেতরের অবস্থা উঠে আসে যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফার কথায়। তার ভাষায়, ‘‘আমি তখন যশোর ক্যান্টনমেন্টে, প্লাটুন হাবিলদার ছিলাম। বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর শুনেই রায়হান ও সুবেদার জনাব আলীসহ বেশ কয়েকজন ঢাকার দিকে আসার প্রস্তুতি নিই। কিন্তু ব্যারাক থেকেই আমাদের থামিয়ে দেওয়া হয়। অপেক্ষায় থাকি প্রতিবাদের। কয়েকজন নেতার সঙ্গে যোগাযোগও হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সারা দেশে বড় বড় লিডাররাও তখন টুঁ শব্দটি করেনি। তার ডাকেই মুক্তিযুদ্ধ করেছি। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের হত্যার নজির ইতিহাসে আছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পরিবারের নিরীহ, নিরপরাধ ব্যক্তিদের হত্যার নজির পৃথিবীতে নেই। বঙ্গবন্ধুকে আমরা স্বাধীন দেশে বাঁচাতে পারিনি, এর চেয়ে দুঃখের আর অপমানের কী আছে! বঙ্গবন্ধুকে নয়, ওরা হত্যা করেছিল মানবতা আর গণতন্ত্রকেও। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শের তো মৃত্যু নেই।’’
বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য, তার দেওয়া ভাষণ, তার নির্দেশনা ও স্বপ্নগুলোই মুক্তিযোদ্ধাসহ সবার কাছে আজও প্রেরণা হয়ে আছে। তার সারা জীবনের লড়াই ছিল বাঙালি জাতির শোষণ মুক্তির মধ্য দিয়ে সোনার বাংলা গড়ে তোলা। বাঙালি জাতিকে তিনি কেবল একটি ভূখন্ডই দেননি, দিয়েছেন সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তি। দিয়েছেন অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনায় উজ্জ্বল জীবনাদর্শ। তার সবকিছুই বাঙালির ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাকে জানলেই জানা হয় বাংলাদেশকে। তাই সব কালেই অনিবার্য হয়ে থাকবেন শেখ মুজিব।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরের বিশেষ সংখ্যায়, প্রকাশকাল: ১৫ আগস্ট ২০২১
© 2021, https:.