বীরগাথা ১৯৭১: ‘একটা ডিব্বা আর একটা পাইপ ছিল তাঁর সম্পদ’
‘রাজশাহী মেডিকেল কলেজে যখন ভর্তি হই তখন স্থানীয় দুটো সংগঠন ছিল–জাগরণী আর প্রগতি। প্রগতির সদস্য হিসেবে প্রথম সংগঠন করা শুরু করি। কাজ ছিল ছাত্রদের লেখাপড়া ও হোস্টেলের সমস্যাসহ ছাত্র সমস্যাভিত্তিক বিষয়ে। পরে মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড চালু করি। রাজশাহী মেডেকেল কলেজে ছাত্রলীগের ফাউন্ডার মেম্বার ছিলাম। ছাত্রলীগ করা তখন সহজ ছিল না। ক্যান্টিনে খেতে গেলে প্লেট টান দিয়ে নিয়ে যেত এনএসএফের ছাত্ররা। সংখ্যায় কম হলেও তাদেরই দাপট ছিল বেশি। এনএসএফ ছিল শক্তিশালী। গভর্মেন্ট কলেজের সামনে ভয়ে মাথা নোয়াইয়া যেতাম। ওখানে থাকত এনএসএফের বড় গুণ্ডা–জাফর। তবু প্রতিকূলতার ভয়ে থেমে থাকিনি। ছাত্রলীগকে এগিয়ে নিয়েছি।
এরপর, ১৯৭০ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হই। ছাত্রলীগের রাজশাহী সিটি কমিটির প্রেসিডেন্টও ছিলাম তখন। তখনকার সাথে এখনকার ছাত্রলীগের আসমান-জমিন ফারাক। আগে লেখাপড়ায় যারা ভালো তারা ছাত্রলীগে আসত। আজকে সেটা নাই। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান ছিলাম। একটা পাঞ্জাবি-পায়জামাই সাত দিন পরেছি। মেডিকেল কলেজের ছাত্র সংসদের ভোট গণনা চলছে। কিছুক্ষণ পর রেজাল্ট হবে। কিন্তু আমি হোস্টেলে চলে যাই। সাবান দিয়ে পায়জামা-পাঞ্জাবি ধুয়ে ইস্তিরি করে পাঞ্জাবি শুকাই। ফিরে এসে দেখি হইহুল্লোড়। সবাই আমাকে খুঁজছে। ভিপিও হয়ে গেছি। দ্যাট ওয়াজ দ্য কন্ডিশন। আর আজ দেখেন গাড়ি কিনছে ছাত্রলীগের থানা লেভেলের তৃতীয় স্তরের নেতারাও। কীভাবে? আপনারা হয়তো ভালো বলতে পারবেন। তাই এখন নিজেকে ত্যাগী বলি না, বলি ব্যাক্কেল। আমাদের মতো ব্যাক্কেল না থাকলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হতো না।
বাঙালিদের মধ্যে এক নম্বর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমান। মানুষ হিসেবে ছিলেন সাধারণ নব্বইজন লোকের মতোই। কোনো বিলাসিতা ছিল না। সম্পদ ছিল তামাকের একটা ডিব্বা আর একটা পাইপ। কম খেয়ে, সাধারণ খাবার খেয়ে রাজনীতি করতেন। শেখ মুজিবকে আমরা বুকে ধারণ করতাম। জাতির জন্য যদি মঙ্গলজনক কিছু করতে হয়, তবে ছাত্রলীগকে অবশ্যই সৎ আর ত্যাগী হতে হবে।’
ছাত্রজীবনের নানা ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সিরাজুল হক। ছাত্রলীগের সাবেক নেতা, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের ফাউন্ডার মেম্বার ও প্রথম ট্রেজারার তিনি। এই যোদ্ধা ১৯৭১ সালে বিএলএফ-এর রিজিওনাল কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। এক সন্ধ্যায় তার বাড়িতে বসেই দীর্ঘ আলাপ চলে যুদ্ধদিনের নানা ঘটনা নিয়ে।
আব্দুল হাই ও জুবেদা খাতুনের সন্তান মোহাম্মদ সিরাজুল হক। পাঁচ ভাই ও এক বোনের সংসারে তিনি সবার বড়। বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার ভাগিয়া গ্রামে। তার বাবা প্রথমে পুলিশে এবং পরে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসে কর্মরত ছিলেন। সর্বশেষ জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার হিসেবে অবসর নেন। বাবার বদলিজনিত চাকরির কারণেই সিরাজুলদের পড়ালেখা চলে বিভিন্ন জেলায়। তার লেখাপড়ায় হাতেখড়ি কাপাসিয়া ভাগিয়া ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে। পরে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হন ময়মনসিংহের মৃত্যুঞ্জয় হাইস্কুলে। এরপর চলে যান নওগাঁতে। ম্যাট্রিক পাস করেন কেডি (কৃষ্ণ দাস) হাইস্কুল থেকে। নওগাঁ ডিএনসি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে তিনি ভর্তি হন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন এমবিবিএস ফিফথ ইয়ারের ছাত্র।
সত্তরের নির্বাচনের দিন তিনি ছিলেন কাপাসিয়ায়। কাজ করেছেন আওয়ামী লীগের পক্ষে। এমএনএ প্রার্থী হিসেবে সেখানে দাঁড়ান তাজউদ্দীন আহমদ। সিরাজুল বলেন, ‘তখন মানুষকে কিছু বলতে হয় নাই। সবাই তাজউদ্দীন আহমদের পক্ষে। ভাগিয়া প্রাইমারি স্কুলটি ছিল ভোটকেন্দ্র। ভোটের দিন সেখানে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ তাজউদ্দীন সাহেব আসলেন সাইকেল চালিয়ে। এগিয়ে গেলাম। ভাবলাম ভোটের খবর নিতে এসেছেন হয়তো। কিন্তু না! ভোট নিয়ে উনি কাউকে কিছুই বললেন না। পাশেই নাপিত বাড়িতে ঢুকলেন। এক নাপিতের খুব শরীর খারাপ ছিল। ভোটের মধ্যেও তিনি তাকে দেখতে এসেছেন। কিছুক্ষণ থেকেই আবার সাইকেল চালিয়ে চলে গেলেন। এমন মানুষ আমরা কোথায় পাব বলেন!’
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও ক্ষমতা দিতে টালবাহানা শুরু করে পাকিস্তান সামরিক জান্তা। তখন আওয়ামী লীগ সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। সরকারও দমন-পীড়নে মাঠে নামে। শুরু হয় ধরপাকড়ও। রাজশাহী মেডিকেল কলেজে কী ঘটেছে তখন? শুনি সিরাজুল হকের মুখে।
তার ভাষায়–‘আমাকে ধরার জন্য আর্মিরা একটা টিম গঠন করে। সারা দিন মিছিল মিটিং করলেও রাতে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বাড়ি বাড়ি থাকতাম। কখনোবা লেডিস হোস্টেলে খালি রাখা সিটে আত্মগোপন করতাম। এরপর থাকা আরম্ভ করলাম অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে। আমার সঙ্গে সব সময় থাকত বন্ধু খালেক। মার্চের আনুমানিক ৫ তারিখের ঘটনা। সকালে নাশতা খেতে যাচ্ছি চারুর ক্যান্টিনে। দৌড়ে এসে এক ছাত্র বলল–“সিরাজ ভাই, ওই দিকে যাইয়েন না। গতরাতে আর্মি আসছিল। আপনার রুমের সব তছনছ করে গেছে। টেবিল চেয়ার ভেঙে নিয়ে গেছে সুটকেসটা। আপনার বন্ধু অরুণকেও তুলে নিয়ে গেছে। ওরা তন্নতন্ন করে খুঁজছে আপনাকে। ধরতে পারলেই মেরে ফেলবে।” তখনই বুঝে যাই ক্যাম্পাসে আর থাকা হবে না। চলে যাই গ্রামে।’
ট্রেনিংয়ে গেলেন কোন সময়টায়?
সিরাজুল হকের উত্তর–‘জুন মাসের মাঝামাঝি সময় হবে। কাপাসিয়ায় তখনো আর্মি আসেনি। স্থানীয় এক নেতা আতাউর রহমান। আতা ভাই বলে ডাকতাম। উনি নেতৃত্ব দিয়ে নৌকায় করে নিয়ে যান। ছোট দু’ভাই রেজাউল হক ও বজলুল হক, জেঠাতো দু’ভাই আব্দুল মোতালেব আর আবু তাহেরসহ পঞ্চাশজনের মতো ছিলাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা হয়ে ভারতের বেলতলি ক্যাম্পে যাই আমরা। সেখানে দেখা হয় রেডক্রস বাংলাদেশের তৎকালীন চিফ গাজী গোলাম মোস্তফার সঙ্গে। এমবিবিএস ফিফথ ইয়ারের ছাত্র শুনেই উনি নিয়ে গেলেন মহারাজা বীর বিক্রম কলেজের ক্যাম্পে। চিকিৎসক হিসেবে কাজ করি কিছুদিন। কিন্তু মন উদগ্রীব যুদ্ধে যাওয়ার জন্য।’
ট্রেনিং নিলেন কোথায়?
‘সেখানেই একদিন দেখা হয় আ স ম আব্দুর রব ও আব্দুল কুদ্দুস মাখনের সঙ্গে। রব ভাইকে চিনতাম আগেই। তিনি নিয়ে গেলেন আগরতলায়, “শ্রীধর ভিলা” নামের এক বাড়িতে। রব ভাই ঘরে ঢুকেই বললেন–“মনি ভাই (শেখ ফজলুল হক মনি) ও সিরাজ, ভিপি, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ।” উনি পাশে বসালেন, নানা কথা হলো অনেকক্ষণ। বললেন–“একটা বাহিনী করতেছি। তুই, ছেলে কালেকশন করে দিবি।” জানলাম ওটা বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী। পরদিন রব ভাইকে সঙ্গে নিয়ে ভয়ে ভয়ে মনি ভাইয়ের কাছে আবার গিয়ে বললাম–“যুদ্ধ কত দিন চলবে সেটা তো ঠিক নাই। আমাকে ট্রেনিংয়ে পাঠান। এরপর আপনি যা বলবেন তাই করব।” উনি মুচকি হাসলেন। মনোভাব বুঝতে পেরে বললেন–“তুই কালই ট্রেনিংয়ে যাবি।”
আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় দেরাদুন মিলিটারি একাডেমিতে। ওখানে দেখা হয় বন্ধু কাজী নুরুন্নবীর সঙ্গে। বিএলএফের ফাস্ট ব্যাচে আমরা ছিলাম ৪৯৬ জন। ট্রেনিং হয় দেড় মাস। শিখি গ্রেনেড থ্রো, রাইফেল, মেশিনগান, এয়ার ড্রপিং ইত্যাদি। ইন্ডিয়ান আর্মি অফিসার মেজর মালহোত্রা ছিলেন ক্যাম্পে। সিলেটের একজন রিটায়াট বাঙালিও ছিলেন। নাম কর্নেল পুরকায়াস্ত প্রকাশ।’
ট্রেনিং শেষে সিরাজুল হকদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে পাঠানো হয় দেশের ভেতরে। একটি দলের লিডার হিসেবে তিনি যুক্ত হন বিএলএফ-এর শীতলক্ষ্যা হেডকোয়ার্টারে। প্রথমে দায়িত্ব ছিল কাপাসিয়া, শিবপুর, মনোহরদী এলাকায়। এরপর নারায়গঞ্জের এক থানা, নরসিংদী জেলা, গাজীপুর জেলা, ঢাকা জেলার সাভার আর ধামরাইকেও যুক্ত করে তাকে বিএলএফ-এর ধলেশ্বরী হেডকোয়ার্টারের জোনাল কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। যুদ্ধকালে তাকে সরাসরি কমান্ড করতেন বিএলএফ-এর অধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মনি।
তার ভাষায়–‘মনি ভাইয়ের স্বাক্ষরিত ও তার হাতে লেখা তৎকালীন নির্দেশনাগুলো একাত্তরের স্মৃতি হিসেবে এখনো আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতে আমার সহকারী ছিলেন শামসুদ্দিন খান, কামাল উদ্দিন নান্নু, ওবায়দুল্লাহ (কাপাসিয়ার এমপি হয়েছিলেন), মনোহরদীর আব্দুল হাই, মোতালেব মণ্ডল, জিয়া উদ্দিন আহমেদ (শিল্পী শাহাবুদ্দিনের বড় ভাই), কালিগঞ্জের আলী হোসেন প্রমুখ। একটা সাব মেশিনগান আর একটা রিভলবার থাকত সঙ্গে। জোনালের সব ক্যাম্পের খোঁজ নিতে হতো। অপারেশনের সময় এফএফদের (ফ্রিডম ফাইটার) সাথে সমন্বয় করেই কাজ করতাম। এ নিয়ে আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি। কাপাসিয়া ও কালিগঞ্জের বিভিন্ন অপারেশনে সরাসরি অংশ নেওয়াসহ আমার আওতাধীন এলাকায় বহু অপারেশন পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম।’
কাপাসিয়ায় একাত্তরের এক অপারেশনের কথা শুনি এই বীরের জবানিতে। তার ভাষায়–‘আমরা আত্মগোপন করে থাকি। একদিন সাদা কাগজে হাতে লেখা একটা চিঠি পাই। ওটা গাজীপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির থেকে কেউ পাঠিয়েছিল। চিঠিতে একটি তারিখ উল্লেখ করে বলা হলো হেভি আর্মস নিয়ে ওই দিন আর্মি আসবে। তখন আর্মি ছিল কাপাসিয়া থানাতেও। কিন্তু ওরা আসছে তাজউদ্দীন সাহেবের বাড়ি আক্রমণ করতে।
কোন দিক থেকে আসতে পারে সেটা ধারণা করলাম প্রথম। অ্যাম্বুশ করতে গেলে কতগুলো নিয়ম আছে, কোন জায়গাতে হবে, কতজন লোক আছে, কী আর্মস আছে, কে কোন জায়গায় থাকবে, কখন উইথড্রো হবে, কোথায় সবাই আবার একত্রিত হবে, সহযোদ্ধা আহত বা মারা গেলে কীভাবে নেবে ইত্যাদি। কাপাসিয়া নদীর উত্তর পাড়ে একটি মাত্র টিনের ঘর ছিল তখন। ওই এলাকার কাছাকাছি আমরা অবস্থান নিলাম।
রেকি করতে লোক পাঠাই ওই দিন সকালে। কিছুক্ষণ পরেই একটা গ্রুপ নদীর পাড় দিয়ে দৌড়ে এসে জানায় লঞ্চে আর্মি আসতেছে। যে জায়গা ঠিক করে রেখেছিলাম সেখান থেকে দেখলাম নদীর পাড়ে শত শত আর্মি নামছে। আক্রমণ করলে ওরা খুব সহজে ঘেরাও করে ফেলবে। সবাইকে মরতে হবে তখন। সঙ্গে সঙ্গে ডিসিশন চেঞ্জ করলাম। একটু উত্তরে এগিয়ে গিয়ে একটা সড়কের এক পাশে ১৪-১৫ জন পজিশন নিলাম। আমাদের কাছে ছিল মেশিনগান, সাব মেশিনগান, এসএলআর আর রাইফেল।
কিছুক্ষণ পর দেখলাম পাকিস্তান আর্মি সড়কপথে এগোচ্ছে। কয়েকজনের ঘাড়ে টুইঞ্চ মর্টার। সামনে একজন বাঙালি পথ চিনিয়ে নিচ্ছে। রেঞ্জের ভেতর আসতেই গুলি আরম্ভ করি। পাকিস্তানি এক সেনা চিৎকার দিয়ে বলে–‘আল্লাহ কা নাম লে শো যাও।’ ওরা শুয়ে পড়ল। তিন থেকে চার মিনিট গুলি করতে পারলাম। এরপরই ওদের পেছনে থাকা সেনারা আমাদের ওপর বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে সামাদ নামের এক মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হয়। আমরা উইথড্রো করে গলা পানির বিল সাঁতরিয়ে দূরের এক গ্রামে চলে যাই। শুনেছি ওই অপারেশনে ওদের বেশ কয়েকজন সেনা মারা গিয়েছিল। এ খবরটা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও প্রচারিত হয়। শেষের দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে থানার এক মাইল বাইরে আর্মিরা প্রকাশ্যে চলাচলও করত না।’
বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর উদ্দেশ্য কী ছিল?
তিনি বলেন–‘ইট ওয়াজ পলিটিকো ওয়ার–এই ধারণাটা আমাদের দেওয়া হয়েছিল। বিএলএফ ছিল পলিটিকো ওয়ার গ্রুপ। দেশ স্বাধীন হবে, উই আর কনফার্ম। মুক্তিযুদ্ধের পরে বামপন্থিরা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে পারে। তাই আওয়ামী লীগের একটা গ্রুপ থাকা প্রয়োজন। যারা পালিটিক্যালি রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলে রাখতে পারে। মূলত এটাই ছিল বিএলএফ বা মুজিববাহিনীর উদ্দেশ্য। এর অধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মনি অত্যন্ত বিচক্ষণ আর বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন মানুষ ছিলেন।’
বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের মূল্যায়ন এই মুক্তিযোদ্ধা করেন ঠিক এভাবে–‘বঙ্গবন্ধু অতি অল্প সময়ে দেশকে এগিয়ে নিতে যে উদ্যোগগুলো নিয়েছিলেন সেটি ছিল আশার চেয়েও অনেক বেশি কিছু। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৩ সালে পূর্ব পাকিস্তানে একজন এমবিবিএস ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়েছিল। দেশ স্বাধীনের পরেই স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বঙ্গবন্ধু মুখে মুখেই বলে দিলেন প্রত্যেক থানাতে সাতজন মেডিকেল অফিসার থাকবে। মানুষকে সেবা দিতে আর কী কী করতে হবে, সেটিও বললেন। দেশের উন্নয়নের একটা সূত্র উনি দিয়েছিলেন। সেই সূত্র ধরেই এগোচ্ছেন তার কন্যা।’
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এই জাতির জন্য ঘৃণ্য ঘটনা বলে মনে করে মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক। তার ভাষায়–‘বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সৎ আর সাধারণ লোক ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবন যাপনে ছিলেন শতকরা নব্বইজনের মতোই। বাঙালি তারে মারতে পারবে–এটা উনি কখনো বিশ্বাস করতেন না। হাতে পাইপ নিয়ে গেঞ্জি গায়ে নামছেন। তোরা কারা। গুলি করে মেরে ফেলছে তাকে। যেহেতু সৎ লোক ছিলেন। অন্যায় জীবনেও করেনি। অতএব কেউ অন্যায় করতেছে বা কেউ এমন অন্যায় করতে পারে–এটা ছিল তাঁর ধারণারও বাইরে। এই যে বিগ হার্ট। এর জন্যই তাঁর জীবন দিতে হয়েছে। মানুষকে ভালোবেসেই জীবন দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু।’
কী করলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে বলে মনে করেন?
প্রশ্ন শুনে খানিক নীরব থাকেন এই যোদ্ধা। অতঃপর বলেন–‘ব্যক্তিস্বার্থ পরিহার করতে হবে। সেটা প্রথমেই করতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্বদের। নেতৃত্বের সততা অত্যন্ত জরুরি। যেটা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছিল। এখন শেখ হাসিনারও আছে। বঙ্গবন্ধু একটি জাতিকে দেশ দিয়েছেন। সেই দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে পারলেই দেশ এগোবে।’
পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে পাহাড়সম আশা মুক্তিযোদ্ধা ও অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সিরাজুল হকের। তাদের উদ্দেশেই তিনি বললেন শেষ কথাগুলো–‘বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটা স্বাধীন দেশ হয়েছে। সে দেশের বীরত্বের ইতিহাসটি তোমরা জেনে নিও। সততার গুণে নিজেকে আলোকিত করো। একাত্তরে আমাদের রক্ত, ঘাম আর ত্যাগকে তোমরা ভুলে যেও না। এই দেশটাকে তোমরাই এগিয়ে নেবে।’
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সংবাদ প্রকাশে, প্রকাশকাল: ২০ আগস্ট ২০২১
একাত্তরকে জানতে যুক্ত থাকুন ইউটিউব চ্যানেলটিতে: সালেকখোকন
© 2021, https:.