মুক্তিযুদ্ধ

আলমডাঙ্গায় দুলালের রক্তাক্ত দিন

বিজয়ের গৌরবগাথা

‘আমি তখন নাইনে পড়ি। সারা দেশে আন্দোলন তুঙ্গে। শেখ মুজিবের নাম সবার মুখে মুখে। পাকিস্তান সরকার ‘দেশ ও কৃষ্টি’ নামে একটা বই স্কুলগুলোতে দেয়। বাঙালি সংস্কৃতি ভুলে পাকিস্তানি তমদ্দুন-তাহজিদ কৃষ্টি শেখানোর চেষ্টার অংশ ছিল সেটি। ওই বইটি আমরা প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। সত্তরের নির্বাচনের কিছু আগের কথা। বঙ্গবন্ধু আসেন কুষ্টিয়ায়। বনানী সিনেমা হলের সামনের বড় মাঠে মিটিং চলে। ওই দিন খুব কাছ থেকে দেখি নেতাকে। পাহাড়সম একটা লোক। কী তার কণ্ঠ! আমি যে কথাটা বলতে চাইছি তার মুখে যেন সেই কথাই উচ্চারিত হচ্ছে। ওই দিন থেকেই বঙ্গবন্ধু জায়গা করে নেয় আমার হৃদয়পটে।’ বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখার স্মৃতি এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা দুলাল। আব্দুল গফুর সরদার ও  আয়েশা গফুরের সপ্তম সন্তান দুলাল। পৈতৃক বাড়ি বরিশালের হিজলার হরিনাথপুরে। কিন্তু বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে দুলালের বেড়ে ওঠা কুষ্টিয়া-যশোর অঞ্চলে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন দশম শ্রেণির ছাত্র।

মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অন্তরালের তথ্য তিনি তুলে ধরেন ঠিক এভাবে ‘আমার বড় দুলাভাই চাকরি করতেন খুলনা কোকোনাট প্রসেসিং মিলে। তিনি পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ৩ মার্চ ১৯৭১। খুলনায় একটা মিছিল সার্কিট হাউজের কাছে পৌঁছালে গুলি চালায় পাকিস্তানি সেনারা। ওখানেই শহীদ হন তিনি। এ খবর আমাদের মনে ঝড় তোলে। একদিন আগেই বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়েছেন রেসকোর্স ময়দানে। দেশ তখন অশান্ত। বোনকে নিয়ে ফেরার পথে চুয়াডাঙ্গা রেলস্টেশনে রেডিওতে শুনি বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি। ওই দিনই শপথ নিয়েছিলাম, ওদের এ দেশ থেকে তাড়াব। মরণ হলেও দেশটাকে স্বাধীন করব।’

৩০ মার্চ ১৯৭১। যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে এসে পাকিস্তানি সেনারা দখলে নেয় কুষ্টিয়া। এপ্রিলের ৭ তারিখে তারা পজিশন নেয় আলমডাঙ্গা থানায়। ওই দিনই আবুল হোসেনসহ ৮-১০ জনকে ওরা ধরে নিয়ে যায় হাটবলিয়া ফেরিঘাটের সামনে। সেখানে গুলি করে তাদের হত্যা করা হয়। আলমডাঙ্গায় ওটাই ছিল প্রথম গণহত্যা।

তার কাছে জানতে চাওয়া হয় ট্রেনিংয়ে গেলেন কোন সময়? ‘মে মাসের প্রথম সপ্তাহের কথা। সেকান্দারসহ কয়েকজন পরিকল্পনা করি বাড়ি ছাড়ার। আব্বা বেতনের টাকা রাখতেন আলমারির ভেতরে। সেখান থেকে ৫০ টাকা নিয়ে একটা সিøপ লিখে দিলাম ‘খুব প্রয়োজনে ৫০টা টাকা নিলাম আব্বা। পরে দিয়ে দেব।’ একদিন বাড়ির সবাই ব্যস্ত নানা কাজে। পেছন দরজা দিয়ে আমি বেরিয়ে পড়ি। মেহেরপুর, কুষ্টিয়া পার হয়ে কাজিপুর দিয়ে চলে যাই ভারতের নদীয়াতে। মুজিবনগরের ঠিক ওপাশে দমপুকুর। সেখানকার ক্যাম্পে গিয়ে নাম লেখাই।’

দুলাল বলে চলেন, ‘সেখানে পনেরদিন চলে লেফট-রাইট। অতঃপর আসেন ভারতীয় সেনারা। হায়ার ট্রেনিংয়ে লোক নেবে জনাবিশেক। আমি রোগা পাতলা। সাইজেও ছোট। টিকলাম না। কিন্তু যুদ্ধ করার তীব্র বাসনা মনে। হঠাৎ ওরা জানতে চাইল কুষ্টিয়া ও যশোরের বাইরের কেউ আছে কি-না? সঙ্গে সঙ্গে আমি হাত তুললাম। আমাদের ট্রেনিং হয় বিহার চাকুলিয়ায়। ট্রেনিং সেন্টারে ক্যাপ্টেন ভোলা শিং ও হাবিলদার রাজেন্দ্র কুমারের কথা এখনো মনে পড়ে। আমার এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর ছিল ২১২৭।’

ট্রেনিং শেষে তাদের আনা হয় আট নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার কল্যাণীতে। কুমারখালীর খলিল গ্রুপের সঙ্গে দুলালকে পাঠানো হয় ভারতের বানপুরে। দর্শনার উলটো দিকে ছিল তাদের ক্যাম্পটি। আগস্টের প্রথম দিকে ধোপাখালি ব্রিজ ও পরে বিওপি ও দর্শনার বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন করেন তারা। এরপর তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতের শিকারপুরের একটি অ্যাকশন ক্যাম্পে।

দুলালের ভাষায়, ‘আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাংকারে ডিউটি করতাম। মাঝেমধ্যে গেরিলা অপারেশনও চলত। এভাবে আলমডাঙ্গার বিভিন্ন স্থানে অপারেশন করি। আমাদের তেরো জনের দলটির কমান্ডার ছিলেন সুলতান জোয়ারদার। হান্নান গ্রুপ, সুলতান গ্রুপ, রশিদ গ্রুপ ও নান্নু গ্রুপ একসঙ্গে থাকত। সম্মিলিত অপারেশন হলে কমান্ড করতেন হান্নান ভাই।’

১২ নভেম্বর ১৯৭১। দুপুরবেলা। আলমডাঙ্গা থানা অপারেশনের সময় পাকিস্তানি সেনাদের ব্রাশের গুলিতে তার ডান হাতের কবজির ওপরের হাড় ভেঙে, মাংস পুড়ে, রগগুলো ছিঁড়ে যায়। চিকিৎসা হলেও এখনো ডান হাতের আঙুলগুলো তিনি পুরোপুরি সোজা করতে পারেন না। তিনটি আঙুল অবশ। চামড়ায় ব্যথা হয় মাঝেমধ্যেই। কষ্ট হয় অনেক। কিন্তু খুশিমনে তা সহ্য করে যাচ্ছেন স্বাধীন এ দেশের জন্য।

কী ঘটেছিল রক্তাক্ত ওই দিনটিতে? তিনি বলেন, ‘প্রচ- গোলাগুলি চলছে। আমাদের দৃষ্টি থানার দিকে। কিন্তু ডানে পোস্ট অফিসের কাছে যে একটা বাংকার আছে সেটা বুঝতেও পারিনি। ওরা ওঁৎ পেতে ছিল। আমাকে টার্গেট করেই গুলি ছোড়ে। আমিও পাল্টা জবাব দেব। হঠাৎ মনে হলো ধাক্কা খেলাম। হাত থেকে এসএলআরটা পড়ে যায়। গুলি মুখে লাগার কথা। কিন্তু তখন ম্যাগজিনটা কাট করছিলাম। এসএলআরটা মাঝখানে থাকায় গুলিটা প্রথম লাগে এসএলআরের বডিতে। অতঃপর স্পি্লন্টার ঢুকে যায় ডানহাতের কবজিতে। ফলে হাড্ডি ভেঙে মাংস বেরিয়ে যায়। চামড়া ঝলসে গিয়ে রগগুলো গাছের শেকড়ের মতো ঝুলতে থাকে। রক্তে ভিজে যায় গোটা হাতটিই।’

সে সময়ই চুয়াডাঙ্গা থেকে পাকিস্তানি আর্মিরা মুহুর্মুহু গুলি ছুড়তে ছুড়তে আলমডাঙ্গার দিকে চলে আসে। গুলিবিদ্ধ ও রক্তাক্ত দুলাল তখন আশ্রয় নেন আলমডাঙ্গার এক কবরস্থানে, পুরনো একটি কবরে।

সেইসব স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে চোখে পানি আসে দুলালের। বলেন, ‘হাতের ব্যথায় গোঁঙাচ্ছিলাম। পরে নওশের আমাকে কাঁধে তুলে নিয়ে যায় এরশাদপুর গ্রামে। সেখানেও ডাক্তার নেই। আমার হাত গামছা দিয়ে বাঁধা। সহযোদ্ধারা মসজিদের খাটিয়ায় তুলে নেয় আমাকে। সাদা কাপড়ে ঢাকা থাকে খাটিয়াটি। যেন লাশ আমি। পরে বেলগাছির ওহাব মেম্বারের বাড়িতে মেলে গ্রাম্য চিকিৎসা। কিন্তু তাতেও কাজ হয় না। পরে গরুর গাড়িতে করে নেওয়া হয় পাচুরিয়া গ্রামের বিলে। আমার হাত তখন পচতে শুরু করেছে। গন্ধে কেউ সামনে আসে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সঙ্গে ছিলেন লালচান আর শহীদুল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা পালকিতে করে আমাকে বর্ডার পার করে আনেন। চিকিৎসা হয় করিমপুর ফিল্ড হাসপাতালে। আমার হাতে গ্র্যাংগ্রিন হয়ে গিয়েছিল। হাতের দিকে চোখ পড়লে এখনো একাত্তরটা মনে পড়ে যায়।’

যে দেশের জন্য রক্ত দিলেন, সে দেশ কি পেয়েছেন? মুক্তিযোদ্ধা দুলালের অকপট উত্তর, ‘স্বাধীন ভূখন্ড পেয়েছি। কিন্তু চেয়েছিলাম একটা সমাজব্যবস্থা, যেখানে শোষিত আর শাসক থাকবে না। সবাই মৌলিক অধিকার পাবে। দেশ অনেক উন্নত হয়েছে। কিন্তু ধনী-গরিবের বৈষম্যটাও তো অনেক বেড়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তো কেউ জিজ্ঞেস করেনি আমার পাশে কে হিন্দু, কে মুসলমান। অথচ ধর্মটা এখন ব্যবহৃত হচ্ছে রাজনীতিতেও। তাই এখন তো মানুষ দেখি না ভাই। দেখি কিছু হিন্দু আর মুসলমান। মানুষ কই?’

স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালোলাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তরে যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা দুলাল বলেন, ‘আমার দেশের ছেলেরা যখন সারা পৃথিবীতে সাফল্য পায়, লাল-সবুজের পতাকাকে সম্মানিত করে। তখন বুক ভরে যায়।’ তাই পাহাড়সম আশা নিয়ে প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন ‘তোমরা বই পড়ো। নিজেকে জানো। নিজের চিন্তা ও মানসিকতাকে উদার করো। দেশটাকে ভালোবাসো। তাহলেই দেখবে দেশ এমনিতেই এগিয়ে যাবে।’

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১১ নভেম্বর ২০২১

© 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button