মুক্তিযুদ্ধ

কুষ্টিয়ার খুররমের একাত্তর

বিজয়ের গৌরবগাথা

পঁচিশ মার্চের আগের ঘটনা। কুষ্টিয়ায় প্রতিদিন মিছিল ও ধর্মঘট চলছে। সদর থানা ছাত্রলীগের সেক্রেটারি ছিলাম। সভাপতি তখন এহসানুল করিম হেলাল (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সেক্রেটারি)। পাকিস্তানি আর্মিরা কুষ্টিয়ায় ঢুকতে চাইলে আমরা প্রতিরোধের চেষ্টা করি। কিন্তু টিকতে পারি না। ওরা কুষ্টিয়ায় ঢুকে এপ্রিলের ১৭ তারিখ। এসেই শুরু করে গণহত্যা। আমরা তখন গড়াই নদী পার হয়ে চলে যাই কয়াতে। কিছুদিন পর পরিচিত অনেকেই আসে। তখনই ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। সঙ্গে ছিলেন বন্ধু আব্দুল্লাহ হিল বাকিসহ অনেকেই।

কয়া থেকে হরিপুর, হরিপুর থেকে ভেড়ামারায় পদ্মানদী পার হয়ে প্রাকপুর দিয়ে ভারতের শিকারপুর যাই। ভেড়ামারার তৎকালীন এমপিএ রাজা মিয়া ছিলেন কোচোয়াডাংগায়। খবর পেয়ে ওখানে গেলে তিনি বললেন, তোমরা করিমপুর যাও। ছাত্রদের ওখানে রিক্রুট করবে।

তাই করলাম। সেখানে বারি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়। তার নির্দেশে বাকি, জাকি, জাহিদ ভাই, আব্বাস ভাই, কাশেম ভাই প্রমুখ একত্রিত হই। আমাদের শিয়ালদহের শ্রী নিকেতন হোটেলের চারতলায় নেওয়া হয়। ওখানে পাই নুরে আলম সিদ্দিকী, সিরাজুল আলম খান, মণি ভাই, রাজ্জাক ভাই ও তোফায়েল ভাইকে। কুষ্টিয়ার সন্তান কাজী আরেফ ভাইও ছিলেন। তিনি-ই থাকার ব্যবস্থা করলেন ডা. বিধান চন্দ্র রায়ের বাড়িতে। এরপর একদিন নুর আম্বিয়া ভাই ট্রেনে ব্যারাকপুর হয়ে আমাদের নিয়ে আসেন শিলিগুড়িতে। অতঃপর একটি ভাড়া করা জিপে নিয়ে যান পাংগা ক্যাম্পে।

ওই ক্যাম্পে প্রাথমিক বাছাইয়ের পর ছাই রঙের পোশাক পরিয়ে আমাদের নেওয়া হয় কুমিরগ্রাম এয়ারপোর্টে। প্লেনে করে আমরা আসি বাগডোগড়া এয়ারপোর্টে। নেমেই চলি পাহাড়ি পথে। কোথায় যাচ্ছি কিছুই জানি না। মনে শুধু একটিই শপথ, দেশকে শত্রুমুক্ত করব। এক সময় পৌঁছে যাই হাফলং ট্রেনিং ক্যাম্পে। ট্রেনিং চলে ৪৫দিন। আমার বডি নম্বর ছিল ৪৬৮।

আমাদের বলা হতো মুজিব বাহিনী, সবাই ছিলাম ছাত্রলীগের। তখনো জানি না কেন এই বাহিনী। চিন্তা ছিল একটাই। দেশটাকে স্বাধীন করে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করা। নেতারা ক্যাম্পে এসে বোঝাতেন ‘তোমরা মনোবল অটুট রেখো। ইনশা আল্লাহ আমরা দেশকে শত্রুমুক্ত করবই। তখন ওটাই ছিল আমাদের মিশন।’

একাত্তরে ট্রেনিংয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলো এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. খুররম শাহারীয়ার। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই আলাপ চলে যুদ্ধদিনের নানা প্রসঙ্গে।

আবদুল লতিফ ও সাজেদা খাতুনের বড় সন্তান খুররম শাহারীয়ার। কুষ্টিয়া শহরের নবাব সিরাজুদ্দৌলাহ সড়কের ৪৮ নম্বর বাড়িতে তার জন্ম। ১৯৭১-এ ছিলেন ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র।

ট্রেনিং প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘থ্রি-নট-থ্রি থেকে শুরু করে এসএলআর, এসএমজি, এলএমজি, থ্রি ইঞ্চি মর্টার প্রভৃতি চালনা শেখায় ট্রেনিংয়ে। গোস্ট ক্রলিং হতো নাইট ট্রেনিংয়ে। চোখ বেঁধে বলা হতো ক্রলিং করতে। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে ট্রেসার ফায়ার করে প্র্যাকটিস করতাম। অত্যাধুনিক সব অস্ত্র চালানো শেখানো হয় আমাদের। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর গানের আসর বসত। যে যেভাবে পারে প্রাণখুলে গাইত, অনেকে কৌতুক বলে হাসাত। ওটাই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সময়ের বিনোদন। তখন কিছুটা সময়ের জন্য পরিবারের কথা ভুলে থাকতাম। তবে দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যটা ঠিক থাকত।’

ট্রেনিং শেষে মুক্তিযোদ্ধা খুররম শাহারীয়ারদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ব্যারাকপুরে, বেইজ ক্যাম্পে। অস্ত্র দেওয়া হয় সেখানেই। এরপর তোফায়েল আহমেদ ব্রিফ করে সবাইকে নানা পরিকল্পনার কথা জানান। বৃষ্টিভেজা এক রাতে নৌকা নিয়ে তারা কেচোয়াডাংগা দিয়ে দেশের ভেতর ঢোকেন। খুররমসহ গ্রুপে ছিলেন বিশ-পঁচিশজন মুক্তিযোদ্ধা।

কুষ্টিয়া অঞ্চলটি আট নম্বর সেক্টরের অধীনে হলেও বিএলএফ-এ এটা ছিল দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন। কুষ্টিয়াসহ এই রণাঙ্গনের বরিশাল, ভোলা, খুলনা জেলাগুলোর নেতৃত্ব দেন তোফায়েল আহমেদ। খুররমদের কুষ্টিয়া গ্রুপটির কমান্ড করতেন মির্জা জিয়াউল বারী নোমান। তারা থাকতেন দুর্বাচরা ক্যাম্পে। ভেতরে ঢুকে অপারেশন শেষে আবার ওই ক্যাম্পেই ফিরে যেতেন। খুররম শাহারীয়ার ছিলেন এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্ট। ভেড়ামারার বহলবাহিয়াসহ কুষ্টিয়ার বিভিন্ন এলাকায় তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন।

এক অপারেশনে রক্তাক্ত হন এই বীর যোদ্ধা। কীভাবে? তার ভাষায় ‘খবর পাই পাকিস্তানি আর্মিরা ঝিনাইদহ থেকে অ্যাডভান্স করেছে, ওরা আমাদের ক্যাম্পে আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েই এগোচ্ছে। ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। বিকেলবেলা। কুমারখালীর বংশীতলাতে ওদের আমরা ঠেকাই। অস্ত্র ছিল এসএলআর। সবাই লাইন পজিশনে। তাজুল নামের এক সহযোদ্ধা স্ট্যান্ডিং পজিশনে ছিল। তাকে বলি তুমি হয় লেয়িং পজিশনে, নাহয় লাইন পজিশনে যাও। সে কথা শুনল না। ফাইট শুরু হলে তুমুল গোলাগুলি চলে। তাজুল স্ট্যান্ডিং পজিশনে থাকায় পাকিস্তানি আর্মিরা তাকে দেখে ফেলে। ওরা তখন আমাদের অবস্থানও বুঝে যায়। ফলে মর্টার শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। প্রথমেই তাজুল রক্তাক্ত হয়ে মারা যায় ওখানে।

আমার পজিশন ছিল একটি গাছের আড়ালে। হঠাৎ একটা মর্টার শেল এসে পড়ে ঠিক সামনে। এরপরই সেটা বার্স্ট হয়। অসংখ্য স্পিøন্টার এসে লাগে দুই পায়ে, হাঁটুর নিচের বিভিন্ন জায়গায়। দেখলাম পা দুটি রক্তে ভিজে গেছে। ভেবেছিলাম পা নেই। সহযোদ্ধারা আমাকে তুলে নিয়ে যায় দুর্বাচরা ক্যাম্পে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতে, করিমপুর ফিল্ড হাসপাতালে। ওই হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন কুষ্টিয়ার আলী হোসেন। কিছুদিন চিকিৎসার পর হাসপাতাল থেকে আবার ফিরি রণাঙ্গনে।

৫ ডিসেম্বর থেকে কুষ্টিয়ার বিভিন্ন উপজেলা মুক্ত হতে থাকে। আর কুষ্টিয়া জেলা শহর পুরো মুক্ত হয় ১১ ডিসেম্বর। কী যে আনন্দ লেগেছিল ওই দিন! বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করেছি খুব। তিনিই তো বলেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তখন ওই লাইন দুটো মনে করে চোখ ভিজিয়েছি। বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চে ওই ডাক না দিলে, আজ হয়তো দেশ স্বাধীন হতো না। তার কথাই সত্য হয়েছিল। বাঙালি ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার লাল সূর্যটাকে।’

রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অবশ্যই বঙ্গবন্ধুকে পাঠ করা জরুরি। এমনটাই মনে করেন সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা। তার ভাষায়‘বঙ্গবন্ধু না থাকলে এ দেশ পেতাম না, নিজের স্বাধিকার হতো না। তাই তাকে না জানলে তো কেউ ভালো নেতাও হতে পারবে না। চামচাগিরি করে যারা দলের নিয়ন্ত্রণ নেয় তারা দলের জন্য ক্ষতিকর। এদের চিহ্নিত করা জরুরি। আমি কি হনু রে এমন ভাব নিয়ে চলে এখনকার ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতারাই। যে নেতার মধ্যে দাম্ভিকতা থাকবে সে কিছুই দিতে পারবে না। সে শুধু নিজের আর স্বার্থের কথা চিন্তা করবে। দশের চিন্তা সে করবে না।’

পরবর্তী প্রজন্মই দেশটাকে এগিয়ে নেবেএমনটাই আশা যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. খুররম শাহারীয়ারের। চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন‘আমরা যা পারিনি। তোমরা তা পারবে এবং করবে। যতটা পার সততার সঙ্গে কাজ করো। সারা পৃথিবীতে দেশের নাম ছড়িয়ে দিও। ধর্মীয় গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দিও না। মনে রেখো দেশকে ভালোবাসা, প্রতিবেশীকে ভালোবাসা, সবার জন্য ভালো চিন্তা করাই সবচেয়ে বড় ধর্ম।’

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৮ অক্টোবর ২০২১

© 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button