“তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। স্কুলে পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত গাওয়া হতো। ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ…’ শেষ হলেই উচ্চকণ্ঠে বলতে হতো ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। কেন জানি ওটা বলতে ইচ্ছা হতো না। পাকিস্তান জিন্দাবাদের স্থলে বলতাম ‘চিন্সা বাস’। মুখে ওটাই আসত। চট্টগ্রামে ‘চিন্সা বাস’ অর্থ উদ্ভট গন্ধ, যা মানুষের কাছে অসহ্য লাগে। এ খবর চলে যায় মওলানা শামসুল হকের কানে। তিনি পাকিস্তানের ভক্ত, পরে একাত্তরের রাজাকার হয়েছিলেন। পাকিস্তানের জাতীয় সংগীতকে অপমান করায় ডেকে নিয়ে আমাকে খুব মারলেন। ফলে পাকিস্তানের প্রতি মন আরও বিগড়ে যায়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বীজটি হয়তো তখনই রোপিত হয়েছিল।
ফতেয়াবাদ স্কুলে গ্রুপ করে বসতাম ছাত্রনেতাদের সঙ্গে। মূলত দেশপ্রেমটা তখনই তৈরি হয়। এরপর চট্টগ্রাম সিটি কলেজে ভর্তি হয়ে যুক্ত হই ছাত্রলীগের সঙ্গে। সুলতানুল কবির চৌধুরী ছিলেন তখন ভিপি। রাতভর পোস্টারিং করতাম, মিটিং-মিছিল করাও ছিল বড় কাজ। সবাই মনের টানেই মিটিং-মিছিলে চলে আসত। পকেটের টাকা খরচ করেই রাজনীতি করতে হয়েছে। নিজের উন্নয়নের জন্য নয়, তখন দেশের জন্য রাজনীতি করেছি। বলতে খারাপ লাগে, এখন নিজের উন্নয়ন করাটাই যেন রাজনীতি, দেশ জাহান্নামে যাক! অথচ এখনো দেশ ও পতাকা নিয়ে কেউ কিছু বললেই ভেতরটা জ¦লে যায়। ঠিক থাকতে পারি না তখন।”
শৈশব ও কৈশোরের নানা ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মোহাম্মদ সরওয়ার হোসাইন চৌধুরী। এক সকালে তার বাড়িতে বসেই চলে যুদ্ধদিনের নানা আলাপচারিতা। এম সৈয়দ হোসাইন চৌধুরী ও মাহমুদা খাতুন চৌধুরানীর তৃতীয় সন্তান ও একমাত্র পুত্র সরওয়ার। বাবা শিক্ষকতা করতেন। তাদের বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার পূর্ব রায়ছটা গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। সরওয়ার বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শোনেন এক দিন পর, রেডিওতে। তার ভাষায় ‘আমরা যা চাচ্ছি, বঙ্গবন্ধু সে কথাগুলোই যেন উচ্চারণ করলেন। নেতার কথাগুলোই ছিল প্রেরণা। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠই ছিল বুলেট।’
বাঁশখালীতে পাকিস্তানি আর্মি আসে কোন তারিখে? : ‘মে মাসের ১৯ তারিখে। ওরা এসেই বালিগ্রামে মানুষের ওপর অত্যাচার শুরু করে। নাপোড়াসহ কয়েকটা হিন্দু এলাকায় প্রায় ৯২ জনকে হত্যা করে এবং গ্রামগুলো জ¦ালিয়ে দেয়। আমাদের ওখানে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল সিদ্দিক আহমদ সওদাগর। পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করেছে মৌলভী হাসানসহ অনেকেই। ওদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা গণহারে মানুষ হত্যা করার সুযোগ পায়।’
বাঁশখালীতে আর্মি ঢুকলে সরওয়াররা গোপনে সংগঠিত হতে থাকেন। নেতৃত্ব দেন ডা. আবু ইউসুফ চৌধুরী। তারা তখন গুনাগরি খাসমহাল, সাধনপুর ফরেস্ট বিট ও সিও অফিসে হামলা করেন। কোনো ট্রেনিং ছিল না। দেশপ্রেমটাই ছিল সাহস। তবে দলে মানিক, মমতাজসহ কয়েকজন ছিলেন বিভিন্ন বাহিনী থেকে আসা বাঙালি সদস্য। কিন্তু এভাবে তো টিকে থাকা যাবে না। তাই সরওয়াররা ট্রেনিংয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তার ভাষায় ‘মে মাসের শেষে বা জুনের প্রথম দিকের কথা। তখন ঘর ছাড়ি। সঙ্গে ছিলেন রশিদ ভাই, মান্নান, আবু সোলায়মান চৌধুরী, ডা. ইউসুফ প্রমুখ। হরিণায় এম এ আজিজ ইয়ুথ ক্যাম্পে আমিসহ ছাত্রলীগ যারা করতাম ওখানে তাদের একটা আলাদা তালিকা করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আগরতলায়। তখনো জানি না কোন বাহিনী গড়া হচ্ছে। নেতারা শুধু বোঝালেন, দেশ যদি স্বাধীন না হয় বঙ্গবন্ধুকে আমরা পাব না। আমাদের হৃদয়জুড়ে তখন বঙ্গবন্ধু। তিনি না হলে বাংলাদেশ হতো না।’
এরপর তাদের নেওয়া হয় দেরাদুনের তান্দুয়া ট্রেনিং ক্যাম্পে। ছয় সপ্তাহের বিএলএফ ট্রেনিং হয় ওখানেই। আরসি, কামান, এন্টি ট্র্যাংক মাইন, ডেমুলেশন থেকে শুরু করে অনেক কিছু শেখানো হয়। ট্রেনিংয়ের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন ভারতের জেনারেল সুজন সিং উবান। ক্যাম্পে ছিলেন মেজর মালহোত্রাও। একেক দিন একেক অস্ত্রের ট্রেনিং হতো। রাতে চলে পলিটিক্যাল ক্লাস। ওয়ারল্যাসের ব্যবহারবিষয়ক ক্লাস নিতেন মালায়লামভাষী একজন। ওই ক্যাম্পের ইনস্ট্রাক্টর চিফ ছিলেন হাসানুল হক ইনু।
ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাদের বন্দিদশা থেকে পালিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ওই ক্যাম্পেই এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর মেজো ছেলে শেখ জামাল। তাকে নিয়ে একটি অজানা ঘটনার কথা জানান মুক্তিযোদ্ধা সরওয়ার। তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিবের ছেলে আসছে এ খবরটা ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়ে। আমিও ছুটে যাই। শেখ জামালকে প্রথম দেখে বলেই ফেললাম, ধুর, এটা বঙ্গবন্ধুর ছেলে নাকি! কথাটা কীভাবে যেন তার কানে চলে যায়। ওভাবে বলা আমার ঠিক হয়নি, তিনি কী ভাবলেন? এমন চিন্তায় মনটাও ছটফট করছিল।’ পরের দিনের ঘটনা। দুপুরে রেস্ট নিচ্ছি। শেখ জামাল এলেন। তাকে দেখেই খুব লজ্জিত হই। ওই কথাটির জন্য তার কাছে ক্ষমাও চাইলাম। তিনি আমার মনের অবস্থা বুঝে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমরা ভাই ভাই। শেখ মুজিবের ছেলে হিসেবে এখানে আসিনি। আমি আপনাদেরই ভাই। আপনাদের মতোই দেশের জন্য যুদ্ধ করতে আসছি।’ মুজিবের রক্তে কী উদারতা তা ওইদিনই বুঝেছি ভাই! কয়েক দিন পরেই তোফায়েল ভাই আর মণি ভাই এসে শেখ জামালকে অন্যত্র নিয়ে যান। জেনারেল উবানও শেখ জামালকে দেখতে এসে বলেছিলেন, ‘আমি তো বাংলার বাঘ দেখি নাই। বাঘের বাচ্চা দেখতে আসছি।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা সরওয়ার বিএলএফের অধীনে যুদ্ধ করেন ফটিকছড়ির যোগ্যাছোলা, রাঙ্গামাটির কাউখালী, কুতুবদিয়া থানা ও বাঁশখালীর বিভিন্ন এলাকায়। ফটিকছড়ির যোগ্যাছোলায় এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের মর্টারের একটি স্পিøন্টার তার বাঁ কানের পেছনের দিকে বিদ্ধ হয়ে বেরিয়ে যায়। এ ছাড়া রাঙ্গামাটির কাউখালীতে আরেক অপারেশনে তিনি বুকের ডান পাঁজরেও আঘাতপ্রাপ্ত হন।
যে দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন সে দেশ কি পেয়েছেন? : ‘অবশ্যই পেয়েছি। একবারেই তো যুদ্ধ করি নাই, দেশটাও স্বাধীন হয় নাই এক দিনে। বঙ্গবন্ধু আস্তে আস্তে একটা জাতিকে একত্র করেছেন। আমাদের ভেতর দেশপ্রেম ঢুকিয়ে দিয়েছেন। স্বাধীনতার পুরো ফল পেতে হলে আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে। সারা বিশে^ আমার দেশের নাম হচ্ছে। এটাও কি কম পাওয়া? বাকি কাজটা করতে হবে নতুন প্রজন্মকে।’ দেশটা ভালো থাকলেই ভালো থাকেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। নতুন প্রজন্মের হাত ধরেই এ দেশটা এগিয়ে যাবে এমনটাই বিশ্বাস এই বীরের। তাদের উদ্দেশেই তিনি শুধু বললেন, ‘এ দেশটা এমনি স্বাধীন হয়নি। আমাদের যেটা সামর্থ্য ছিল করে দিয়েছি। স্বাধীন দেশটা তোমরাই ভোগ করবে। তুমি ছাত্র হলে বেশি বেশি লেখাপড়া করো, ওটাই এখন তোমার মুক্তিযুদ্ধ। যেকোনো কাজ সততার সঙ্গে করো, ওটাই দেশপ্রেম। আর এই করোনাভাইরাসের সময়টায় মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং অপরকে মেনে চলতে বলাটাই সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা তোমরাই।’
একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাভূত করেছিলেন সরওয়ার হোসাইনের মতো বীরেরা। তাদের রক্ত, ঘাম, ত্যাগে সৃষ্ট বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। আজকের সবকিছুই আগামীর ইতিহাসের অংশ হবে তা নয়, কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের গৌরবগাথা অনাদিকাল পর্যন্ত প্রজন্মকে আলোড়িত করবে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১
© 2021, https:.