আদিবাসী

আদিবাসী লোকগাথার খোঁজে

সূর্যগ্রহণ হবে আজ। দেশের আনাচে-কানাচে এই নিয়ে চলছে তুমুুল আলোড়ন, চলছে গ্রহণ দেখার নানা আয়োজন। এই আলোড়নের কারণও আছে। আজ থেকে আবার শত বছর পরে এ-দেশ থেকে দেখা যাবে এরকম সূর্যগ্রহণ। তাই গ্রহণ দেখাটা রূপ নিয়েছে রীতিমতো উৎসবে।

কিন্তু দিনাজপুর শহরে নেমেই রীতিমতো থমকে গেলাম। কোথায় গেল সেই উৎসবমুখর মানুষজন? সূর্যগ্রহণ নিয়ে কি এদের আগ্রহ নেই কোনো? নাকি শীতের ভয়েই ঘরের ভেতর পালিয়ে আছে সবাই? সেরকম ভাবার কারণ আছে। কারণ কুয়াশার ভারী পর্দার নিচে জড়সড় হয়ে আছে গোটা জেলা। শহরবাসীর শরীরে শীতপোশাকের আধিক্য চোখে পড়ার মতো। পরিচিতজনদের চিনতেও খানিকটা বেগ পেতে হচ্ছে। সোয়েটার, মাফলার আর নাক অবধি মাঙ্কি ক্যাপে বদলে যাওয়া মানুষটাকে চিনতে চোখ দুটোই শেষ ভরসা। বাস থেকে নেমে সেভাবেই চোখের ইশারায় চিনে নিলাম শামীমকে। জেলার প্রতিভাবান সংস্কৃতিকর্মী তিনি।

রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান। ছোট ছোট সব গ্লাস সাজানো। পাম্প চুলায় শোঁ-শোঁ করে আগুন জ্বলছে। গলগলিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে কেটলির নল দিয়ে। এমন দৃশ্য দেখলেই তো চা খাওয়ার তৃষ্ণাটা আরো বেড়ে যায়। আমি আর শামীম বসে গেলাম ঝটপট। এক গ্লাস গরম চা খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নিলাম। স্টার্ট দিতেই ধোঁয়া উড়িয়ে ছুটে চলল শামীমের মোটরসাইকেল। শহরটাকে পেছনে ফেলে অল্প সময়ের মধ্যে পৌঁছে গেলাম পুনর্ভবা ব্রিজে। চর পড়ার কষ্ট নিয়ে মরে যাওয়া নদী পুনর্ভবার বুকে চলছে বালিভর্তি বড় বড় লরি। ব্রিজ পেরিয়ে সোজা দক্ষিণমুখো বিরলের পথ। দুদিকে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। ধান কাটার পর নিঃস্ব বুকে পড়ে আছে সেগুলো।

পশ্চিমা বাতাসের ঝাপটায় হিম হয়ে আছে চারপাশের গ্রামগুলো। কিছু লোক খোলা মাঠে প্যান্ডেল তৈরিতে ব্যস্ত। পাশেই টানানো ব্যানারে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘ইসলামিক জলসা’। শীতের এ-সময়টাতে বাংলার গ্রামে-গঞ্জে চলে মেলা, যাত্রাপালা, নাটক আর ইসলামিক জলসার মতো আয়োজন। প্রচণ্ড শীতে মাঠের গরু-ছাগলগুলো পড়ে আছে বাহারি কাপড়ের তালি দেওয়া বিশেষ পোশাক। স্থানীয়দের ভাষায় এর নাম ‘ঝুল’।

জায়গার নাম বহবলদিঘি। যখন পৌঁছালাম, মাথার ওপর তখন মধ্যদুপুরের সূর্য। একপাশে সীমান্ত অবধি গহিন শালবন, অন্যপাশে আদিবাসীদের গ্রাম। সেখানেই পাড়াভেদে বাস করে নানা ভাষাভাষী আদিবাসী মানুষ।

চারপাশ থেকে মাদল, ঢোল আর তাদের চিৎকারের শব্দ ভেসে আসছিল। আমরা ভাবছি, কোনো পূজার আনুষ্ঠানিকতা চলছে হয়তো; কিন্তু হালজার একটি পাড়ায় ঢুকতেই অবাক হয়ে গেলাম। দিনাজপুর শহরে আমরা একটু আগেই দেখে এসেছি সূর্যগ্রহণকে ঘিরে কোনো সাড়াশব্দ নেই; কিন্তু এখানে ঠিক তার উল্টো। গোটা পাড়ার সবাই ধূপ জ্বালিয়ে, মাদল-ঢোল বাজিয়ে, বাড়ির চালে পানি ছিটিয়ে, আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলছে, ‘মামা, গাহানা ছাড়!’ জিজ্ঞেস করে জানলাম, ‘কড়া’ জাতির লোক তারা। সূর্যগ্রহণ চলায় গোটা পাড়ার সবাই উপোস। সেই উপোস অবস্থায়ই এই লোকাচার উৎসবে অংশ নেওয়া নিয়ম। গোত্রের প্রধানকে তারা বলে ‘মাহাত’। আলাপ হলো তাঁর সঙ্গে।

কড়া মানে কী? গোত্রপ্রধান জগেন বলতে থাকেন, কড়া মানে ‘মাটি খোঁড়া’। একসময় এ-জাতির লোকেরা দিঘি খোঁড়ার কাজ করত। সে থেকেই তারা ‘কড়া’। ইংরেজ আমলে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় বসেছে রেললাইন। পাহাড় কেটে, মাটি খুঁড়ে সেই রেললাইন বসানোর কাজে ঘাম ঝরিয়েছে এই আদিবাসী জনগণই। আর সেই রেললাইনের কাজ করতে করতেই বিপুলসংখ্যক কড়া জাতির মানুষ চলে আসে এ-দেশে। এখানেই তারা বসত গড়ে। নিজেদের

সংস্কৃতি, আচার-আচরণকে বাঁচিয়ে রাখতে সবাই মিলে থাকতে শুরু করে একসঙ্গে। জীবিকার তাগিদে দেশছাড়া সেসব মানুষই এদের পূর্বপুরুষ। নানা কারণে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে এ-জাতিটি। সারাদেশে এখন মাত্র ২৩টি পরিবার টিকে আছে।

নানা বিশ্বাসের প্রভাবে তাদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে নানা আচার। তারই ধারাবাহিকতায় চলছে এই গ্রহণমুক্তির চেষ্টা। কেন এই সূর্যগ্রহণ হয় – সে-বিষয়ে অন্য আদিবাসীদের মতো কড়াদের রয়েছে আদি বিশ্বাস ও কাহিনি। ৯০ বছরের সেড়তি কড়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে শুরু করলেন সে-কাহিনি।

‘মানব জাতি একবার খুবই অভাবের মধ্যে পড়ে। মানব জাতিকে বাঁচানোর জন্য চাই ধান। চন্দ্র এবং সূর্য মানুষের জন্য ধান দিতে অনুরোধ করে দোসাদ দেবতাকে। তাদের প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে দোসাদ দেবতা ধান দেয় মানুষকে, তবে আবার ফেরত দিতে হবে এই শর্তে। কিন্তু সে-বছর দুর্ভিক্ষ দেখা

 দিলে মানব জাতি সে-ধার আর পরিশোধ করতে পারে না। চন্দ্র ও সূর্য মানব জাতির পক্ষে সেই ধান ধার নিয়েছিল বলে দোসাদ দেবতা এখনো সুযোগ পেলেই চন্দ্র ও সূর্যকে আক্রমণ করে। এতে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ ঘটে।’ এ-কারণেই কড়ারা মনে করে, চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণের সময় মানব জাতির দায়িত্ব তাদের বাঁচাতে ভগবানের সাহায্য প্রার্থনা করা।

ক্রমে বেলা বাড়ছিল। কথাও জমে উঠছিল বেলার সঙ্গে সঙ্গে। তাদের কাছ থেকেই জানলাম, কড়াসহ নৃগোষ্ঠীর কোনো সম্প্রদায়েরই লিখিত বর্ণ নেই। পুরোটাই মৌখিক। মায়ের ঘুমপাড়ানির গান আর বাবার আদরের ভাষা শুনে শুনেই শিশুরা তাদের জাতির ভাষা শিখে ফেলে।

আমাদের আগ্রহ দেখে পাশ থেকে সুনিয়া কড়া গাইতে শুরু করল তাদের ভাষায় ঘুমপাড়ানি গানটি –

ইয়ারে ডিম চড়ওয়া ডিমা পার দে

নুনুক খনামে আগ লাগাল নুনু

নিন্দারে দে

গানের কথার অর্থ হচ্ছে এরকম – কোকিল পাখিকে ডাকা হচ্ছে, সে যেন তার ডিম পাড়া শেষ করে চলে আসে এই শিশুটির বিছানায়। আর তারপর তা দিয়ে গরম করে দেওয়া বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে দেয় শিশুটিকে।

উৎসবের অংশ হিসেবেই এবার তাদের মধ্যে চলতে থাকে ধাঁধার খেলা। একপাশ থেকে সেড়তি বললেন, ‘দাশটা মারাত রাগদেলকে, দুটা মারত পাকারকে মারকে।’ এর উত্তর বলতে পারল না কেউ। সবাই চুপ। কেউ না পারায় সেড়তির মুখে বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠল। হাসতে হাসতেই উত্তর দিলেন তিনি, ‘ঢিলা বাছা।’

মানে উকুন আনার জন্য দুই হাতের ১০টি আঙুল থাকলেও উকুন মারা হয় দুই আঙুল দিয়ে।

এবার সুনিয়া বললেন আরেকটি ধাঁধা, ‘ভুরুত পাংখি, একজন ডুবেলকে দুজন সাক্ষি।’ দলের মাহাত বললেন, ‘এটি হচ্ছে সেচ দেওয়ার জন্য টিন-জাতীয় বালতিবিশেষের দুদিকে দড়ি বেঁধে দুজন টেনে ধরা।’ এরকমভাবে চলতেই থাকল উৎসবের একের পর এক লোকাচার।

এরই মধ্যে আমরা কড়াপাড়া থেকে বের হলাম। হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়লাম গিরিডোবার ওঁরাও পাড়ায়। ভাঙাচোরা রাস্তার দুদিকে সারি সারি তুঁতগাছ। পথেই দেখা মিলল নিপেন টিগ্গার। নিপেন টিগ্গা ওঁরাও পাড়ারই একজন। তিনি আমাদের জানালেন, প্রায় ৩০টি পরিবারের বাস এখানে। পরিবারের দরিদ্রতা থেকে মুক্তি পেতে, চিকিৎসা সহায়তা পেতে আর বিনামূল্যে বাচ্চার শিক্ষাপ্রাপ্তির জন্য কয়েকটি পরিবার খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করলেও অধিকাংশ পালন করছে তাদের পূর্বপুরুষের আদি ধর্ম।

চন্দ্র ও সূর্য ওঁরাওদের দেবতা। ওঁরাও ভাষায় বিড়ি নাদ ও চান্দু নাদ। চন্দ্র ও সূর্য সৃষ্টি নিয়ে তাদের বিশ্বাসে আছে প্রাচীন এক কাহিনি। আধো কুরুক ও আধো বাংলায় নিপেন বলতে শুরু করলেন কাহিনিটি –

‘ধরমেশ যখন পৃথিবী সৃষ্টি করল তখন আকাশ ও মাটি ছিল খুবই কাছাকাছি। মানুষ  চলাফেরা  করার  সময়  আকাশ  মাথায় ঠেকত। একবার মানুষের কোনো এক অপরাধে আকাশ ওপরে উঠে গেল। এতে চলাফেরায় মানুষের সুবিধা হলেও সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল।

বনের মধ্যে ছিল এক মহুয়া গাছ। সে-গাছে ফুল যতক্ষণ ফুটে থাকত ততক্ষণ পৃথিবী আলোকিত থাকত। আর যখন ফুল শুকিয়ে যেত তখন আবার অন্ধকার নেমে আসত। সবাই ভাবল, গাছটিই অন্ধকারের মূল কারণ। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো গাছটিকে কেটে ফেলে আলো উদ্ধারের। গাছটি কাটা হলো; কিন্তু তারপরও সেটি মাটিতে পড়ছে না। দৈববাণীর মাধ্যমে জানা গেল, গাছটিতে রয়েছে চিলের বাসা। চিলটিকে না মারলে গাছটি মাটিতে পড়বে না। তাই হলো। চিলটিকে মারার পরপরই গাছটি মাটিতে পড়ে গেল। পড়ার শব্দে কেঁপে উঠল গোটা পৃথিবী।

সে-দেশের রাজা ভাবলেন, শত্রুরা তাঁর রাজ্য আক্রমণ করেছে। তিনি সৈন্য নিয়ে এসে দেখলেন মহুয়া গাছটি কাটা। রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে শাস্তির হুকুম দিলেন। উভয় পক্ষের মধ্যে চলল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। রাজার সৈন্য পরাজিত হলো। অতঃপর গাছটিকে দুভাগ করে কাটা হলো। দেখা গেল নিচের দিকের বড় অংশটিতে সূর্য আর ওপরের দিকের ছোট অংশটিতে চন্দ্র। কিন্তু তাদের জীবনদান হবে কীভাবে?

আবারো দৈববাণী এলো। এক চাষির আদরের ছেলেকে চুরি করে এনে হত্যা করে তার রক্ত ঢেলে দেওয়া হলো গাছের কাটা অংশে। সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্র ও সূর্য জীবিত হয়ে আকাশে উঠে গেল।’

সে-সময় থেকেই ওঁরাওরা মনে করে সূর্য পুরুষ এবং সে বেশি রক্ত পান করেছিল বলে তেজি ও লাল। একইভাবে চন্দ্র মহিলা এবং সে কম রক্ত পান করেছিল বলে স্নিগ্ধ ও সাদা।

ওঁরাও গ্রামের পাশেই নিপেন দেখিয়ে দিলেন সাঁওতালপাড়াটি। এ-পাড়াতেই ঐতিহাসিক পাড়ু রাজার বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল।

পাড়ার ভেতর ঢুকতে ঢুকতে মনে পড়ল সাঁওতালদের বিষয়গুলো। তারা নিজেদের ‘সানতাল’ বলতেই অধিক পছন্দ করে। নিজেদের মধ্যে তারা একে অপরকে ডাকে ‘হর’ বলে। ‘হর’ অর্থ ‘মানুষ’। তাদের আদি দেবতা সূর্য। সাঁওতালি ভাষায় ‘সিং বোঙ্গা’। সূর্য পূর্বদিকে উঠে বলেই পূর্বদিক সাঁওতালদের কাছে পবিত্র। তাই পূজাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তারা পূর্বদিকে মুখ করে বসে।

এখনো শিকারসহ যে-কোনো অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামে আদিবাসীদের একমাত্র অস্ত্র তীর-ধনুক। এছাড়া নানা পূজা-পার্বণেও তারা তীর-ধনুক ব্যবহার করছে পূর্বপুরুষদের আমল থেকে। শিকারসহ তীর-ধনুকের ব্যবহার নিয়ে প্রচলিত আছে একটি কাহিনি। গোত্রের ষাটোর্ধ্ব রাগদা হেমব্রন গল্পের ছলে বলতে থাকলেন কাহিনিটি –

‘সাঁওতাল রাজা তখভনের রানির এক গোপন প্রেমিক ছিল। প্রেমিকটি বনের মধ্যে থাকত সর্পরাজের বেশ ধরে। রাজা যখন শিকারে যেতেন রানি তখন তাকে জঙ্গলের বিশেষ একটি দিকে যেতে নিষেধ করতেন। একবার শিকার করতে গিয়ে কৌতূহলবশত রাজা ওই বিশেষ দিকে যান এবং সর্পরাজকে দেখতে পান। নিজের প্রাণরক্ষার্থে তীর দিয়ে রাজা হিংস্র সর্পরাজকে মেরে ফেলেন। শিকার থেকে ফিরে রাজা ঘটনাটি রানিকে খুলে বলেন। সর্পরাজের মৃত্যুর কথা শুনে রানি ভেতরে ভেতরে বেশ ব্যথিত ও প্রতিহিংসাপরায়ণা হয়ে ওঠেন। তিনি রাতের আঁধারে জঙ্গলে গিয়ে সেখান থেকে সর্পরাজের হাড়গোড় কুড়িয়ে এনে বাগানে পুঁতে রাখেন। কিছুদিন পর ওই জায়গা থেকে একটি গাছ হয় এবং ওই গাছে একটি আধফোটা ফুল সারা বাগানকে আলোকিত করে তোলে।

প্রতিহিংসাপরায়ণ রানি একবার কৌশলে রাজার সঙ্গে মেতে ওঠেন সর্বনাশা বাজির খেলায়। রাজা যদি বাগানের সব ফুলের নাম বলতে না পারেন, তবে রানির হুকুমে প্রজারা রাজার প্রাণদণ্ড দেবে। নিজের বাগানের ফুলের নাম বলাটা খুবই সহজ ভেবে আত্মবিশ্বাসী রাজা রাজি হলেন। অতঃপর গ্রামে গ্রামে ঢোল পিটিয়ে এ-খবর সর্বত্র জানিয়ে দেওয়া হলো। নির্দিষ্ট দিনে রাজ্যের প্রজারা ‘বাজি খেলা’ দেখার জন্য রাজপ্রাসাদের বাগানে উপস্থিত হলো। রাজা একে একে সব ফুলের নাম বলতে পারলেন; কিন্তু অদ্ভুত, আধফোটা ফুলটির কাছে এসে রাজা আটকে গেলেন। সে-সময় রাজার পক্ষের প্রজারা রানির কাছ থেকে আরো সাতদিন সময় চেয়ে নেয়।

খবর পেয়ে রাজাকে বাঁচাতে অন্য রাজ্য থেকে পায়ে হেঁটে রওনা হন রাজার এক বোন। হাঁটতে হাঁটতে ষষ্ঠ রাতে তিনি বিশ্রাম নিচ্ছিলেন একটি শিমুলগাছের তলায়। হঠাৎ গভীর রাতে বোনটি শুনতে পান গাছের মগডালে এক শকুনি তার ক্ষুধার্ত বাচ্চাদের সান্ত্বনা দিচ্ছে এই বলে, পরদিনই সে বাচ্চাদের রাজার দেহের মাংস খাওয়াবে। উৎসুক বাচ্চারা কীভাবে তা সম্ভব মায়ের কাছে জানতে চাইলে গল্পচ্ছলে বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে পাড়াতে সব ঘটনা এবং ফুলের নাম ও জন্মবৃত্তান্ত খুলে বলল শকুনি। শিমুলগাছের নিচে বসে রাজার বোনটি সব কথা শুনে ফেললেন। ভোরের মধ্যেই বোন রাজার কাছে পৌঁছে ফুলের নামসহ সব ঘটনা বললেন। সাতদিনের দিন রাজা প্রজা ও রানির সম্মুখে বললেন, ফুলের নাম হলো, ‘কারি নাগিন হাড় বাহা’ আর তখনই ফুলটি পূর্ণ প্রস্ফুটিত হলো। আর প্রাণদণ্ড থেকে মুক্তি পেলেন রাজা।

কিন্তু ক্ষুব্ধ প্রজারা প্রতিহিংসাপরায়ণা রানিকে তীর মেরে ঝাঁঝরা করে দিলো এবং তাতেও তাদের ক্ষোভ প্রশমিত না হওয়ায় লাঠির আঘাতে রানির মাথা গুঁড়িয়ে দিলো।’

সেই থেকে সাঁওতালদের শাকরাৎ-এর সময় কলাগাছে তীর মারা ও লাঠির ঘায়ে হাঁড়ি ভাঙাকে তারা অশুভ শক্তির প্রতীকী বিনাশ বলে মনে করে। এভাবে সাঁওতালরা বিশ্বাস করে, পৃথিবী সৃষ্টির আগে সমগ্র দুনিয়া জলে ঢাকা ছিল। সৃষ্টিকর্তা পৃথিবী তৈরির সিদ্ধান্ত নিলে তাঁকে সাহায্য করে কেঁচো ও কচ্ছপ। কেঁচো জলের তলদেশ থেকে মাটি এনে কচ্ছপের পিঠের ওপর রাখতে থাকে। ধীরে ধীরে গড়ে উঠল বিশাল পৃথিবী। অতঃপর সৃষ্টিকর্তা তৈরি করলেন আদি পিতা ও মাতাকে। পিতা-মাতার জোড়ায় জোড়ায় সন্তান জন্মের মাধ্যমে গড়ে উঠল সমগ্র মানব জাতি।

সাঁওতালপাড়া থেকে যখন বের হলাম তখন সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই। চারদিকের গ্রামগুলোয় থেমে থেমে বাজছিল মাদল আর ঢোল। ফেরার পথে লোহা ডাংগায় ঢুকে দেখি উঠোনের বোঙ্গায় সন্ধ্যাপ্রদীপ দিচ্ছে একটি জাতির লোকেরা। তারা তুরি জাতি। এ-জাতির মহত বা গ্রামপ্রধান লবানু সিং। পুরুষদের নামের শেষে তারা ‘সিং’ ব্যবহার করলেও নারীদের নামের শেষে টাইটেল হিসেবে ব্যবহার করে ‘বালা’।

একজন লোকের আর্তচিৎকারে আমরা প্রায় দৌড়ে চলে গেলাম মহতের পাশের বাড়িটিতে। সেখানে সাপে কাটা এক রোগীর শরীর থেকে বিষ নামাচ্ছিল মহতেরই ভাই সবানু সিং। বিশেষ ভঙ্গিতে পড়ছেন তাঁদের ভাষায় মন্ত্র :

এখানি পুসকেননি চারিখানি ঘাট

তাতে দিনু পদ্মার পাত

পদং কুমারী মা-বাপার নাম-জয়

 বিষহরি

নাব বিষ নাব

বত্রিশে গড়ে গড়ে নাব

নিচ থাকি উপারে যদি ধাউবো

দোহার লাগে-শিব, দুর্গা, কার্তিক,

 গণেশের মাথা খাবো।

মুণ্ডা, ভুনজার, ওঁরাও আর কড়াদের মতো তুরি জাতির সবচেয়ে বড় পূজার নাম কারমা। ভাদ্র মাসে হয় এ-পূজা। পূজার আগে মেয়েদের তার স্বামীর বাড়ি থেকে দাওয়াত করে নিয়ে আসে তার ভাই ও বাবা। তাই ভাদ্র মাসে চারদিকে যখন কাশফুল ফুটতে থাকে তখন মেয়েদের মনে বাবার বাড়ি যাওয়ার আনন্দের ঢেউ। মনের এই আকুতি নিয়ে কারমা পূজার সময় দলবেঁধে তারা গায় নানা গান।

আমাদের শোনাতে বাসন্তি বালা সুর করে গাইতে থাকেন –

কাশি ফুলা ফুটেই গেলে

আসা মরা লাগি গেলে

ভাইয়া বাপা লেগেল আতে বেটিক

কারমা পূজাকে রাতে।

পাশ থেকে খিরো বালা ধরেন আরেকটি গান –

করম ডাল, করম ডাল

চল শ্বশুরায়ে

ভাদ্র মাসে বিয়া হতে গো

আনে ঘুরায়ে।

তুরিদের গানের আসর থেকে যখন ফিরছি তখন চারদিকে নিস্তব্ধ অন্ধকার। আকাশে অজস্র তারা। হঠাৎ থমকে গেলাম। চোখের সামনেই আকাশের একটি তারা খসে পড়লো। আবার তা নিমিষেই হারিয়ে গেল। দূরে কোনো একটি গ্রাম থেকে ভেসে আসে আদি মানুষের সুর – ‘হে ভগবান! পতিসে পাবনে সিতারাম, জেয় ভগবান।’

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে কালি ও কলমে, প্রকাশকাল: ২৬ অক্টোবর ২০২১

© 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button