‘আমাদের ভেতর বাঙালিত্বের চেতনাটা প্রবল ছিল। পাকিস্তানি সেনারা এসে মারবে, মেয়েদের তুলে নিয়ে অত্যাচার করবে এটা সহ্য হচ্ছিল না। ইয়ং ছেলে হয়ে ঘরে বসে থাকব হতেই পারে না। স্বাধীনতার জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য মরতেও প্রস্তুত ছিলাম। অত্যাচারীদের তাড়াব, এ দেশটাকে স্বাধীন করব বুকের ভেতর এমন চেতনা নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের জন্য ঘর ছাড়ার প্রস্তুতি নিই। চাচাতো ভাইকে নিয়ে সোনামুরা হয়ে চলে যাই ভারতের হাতিমারা ট্রানজিট ক্যাম্পে। সেখানে প্রতিদিন চলে লেফট-রাইট। ক্যাম্প চিফ ছিলেন আইয়ুব। ক্যাম্পে তখন পাঁচশোর মতো যুবক। একদিন আসেন ভারতীয় কর্নেল বাগচি। ট্রেনিংয়ের জন্য যুবকদের বাছাই করেন তিনি। আমি একটু বেঁটে, কিন্তু কথাবার্তায় পটু ছিলাম। বাগচি সাহেব সেটা খেয়াল করলেন। তিনি ইশারা করতেই কাছে এসে এক সেনা ধুপ করে আমার বুকে একটা ঘুষি দেয়। আমি তখনো সটান, একটুও হেলিনি। তিনি বললেন ‘ইয়েস হি ইজ দা ফিট পারসন।’ টিকে গেলাম। এভাবেই ট্রেনিংয়ের জন্য রিক্রুট করা হয় ৫০ জনকে।
পরদিন সকালে আমাদের তুলে দেওয়া হয় ইন্ডিয়ান আর্মিদের বড় গাড়িতে। কোথায় যাচ্ছি জানা নেই। পাহাড়ি পথে একসময় এসে পৌঁছি আসামের শিলচর লোহারবনে। ছিলাম চার নম্বর কোম্পানিতে। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর: ই-৬৩০৫। বেসিক ট্রেনিং হয় এক মাস। চানমারী (টার্গেটে গুলি লাগানো) ট্রেনিং যখন হয় তখন যে বেশি গুলি লাগাতে পারছে, তাদের নিয়ে আলাদা একটা গ্রুপ করা হয়। ওই গ্রুপকে ওরা বিশ দিন জে.এল.ডাব্লিউ (জুনিয়র লিডার উইং) ট্রেনিং দেয়। ওটা খুব কঠিন ট্রেনিং ছিল মানকিং চাল, সেনেক চাল, একটা রশির ওপর দিয়ে এক গাছ থেকে অন্য গাছে যাওয়া প্রভৃতি। কষ্ট যেমন, জীবনের ঝুঁকিও ছিল তেমনই। ওই দিনগুলোর কথা ঠিক বলে বোঝানো যাবে না!
‘মূলত একাত্তরই আমাদের শক্তি আর বঙ্গবন্ধু প্রেরণা। এই দুয়ের অনুভূতি সরব আছে বলে আজও মাথা উঁচু করে বেঁচে আছি।’ একাত্তরের নানা ঘটনাপ্রবাহ এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত (এখন হুইল চেয়ারধারী) বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ জানে আলম সাচন। এক সকালে তার বাড়িতে বসেই আলাপ হয় যুদ্ধদিনের নানা বিষয় নিয়ে। সৈয়দ জানে আলম সাচনের বাবার নাম সৈয়দ আশরাফ আলী ও মা সৈয়দা জাহানারা বেগম। দুই ভাইয়ের মধ্যে সচন ছোট। তাদের পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার মৌচাগড়া গ্রামে। কিন্তু বাবার চাকরির সুবাদে তারা বসতি গড়েন ঢাকার নাখালপাড়াতে।
ট্রেনিং শেষে সাচনদের পাঠানো হয় চার নম্বর সেক্টরে, কৈলাশ শহর সাবসেক্টরে। চাকলা ও রাঙাউটি বর্ডারে তারা ‘ফ্রন্টফাইট’ করেন। কমান্ড করতেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ফিল্ড মেজর জাং শিং। একপাশে পাকিস্তানি আর্মি আর ভারতীয় অংশে ছিলেন তারা। বৃষ্টির মতো সারা রাত গোলাগুলি চলত। প্রতিদিন মারা যেত সহযোদ্ধারা। তাদের লাশ কবর দেওয়া হতো পাহাড়ে। এভাবে প্রায় আড়াই মাস সম্মুখযুদ্ধ করেন তারা। মাঝেমধ্যে গেরিলার বেশে ভেতরে ঢুকে মনু নদীর ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া ও শমসেরনগরে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পেও হামলা করেন সাচনরা।
এক অপারেশনে মারাত্মকভাবে আহত হন এই যোদ্ধা। বাঁ হাতের জয়েন্টের নিচে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি দুই পাহাড়ের কুঁচকিতে পড়ে যান। কী ঘটেছিল ওইদিনটিতে? তার ভাষায় ‘জুলাই বা অগাস্টের ঘটনা। চার নম্বর সেক্টরে আমরা টিলাবাজার ক্যাম্পে। পাশেই বিএসএফ ক্যাম্প। ওখান থেকে মাঝেমধ্যে রাঙাউটি, শমসেরনগর এলাকায় যেতাম ফাইটে। একদিন রাঙাউটি বর্ডারে পাহাড়ের ওপর থেকে ফ্রন্টফাইট করছি। রাত হলেই ফাইট শুরু হতো। আমার অস্ত্র ছিল এলএমজি। টিলার মতো বড় পাহাড়ের ওপর থেকে ফায়ার করছি পশ্চিম দিকে। হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাদের একটা গুলি এসে বাঁ হাতের জয়েন্টের নিচ দিয়ে বাহুর মাংস ভেদ করে বেরিয়ে যায়। আমিও ছিটকে পড়ি দুই পাহাড়ের কুঁচকিতে।
সহযোদ্ধারা আমাকে তুলে নিয়ে যায় ভারতের কৈলাশ শহর হাসাপাতালে। আমার মেরুদ-ের হাড় ডিসপ্লেস হয়ে গিয়েছিল। ওরা পা দুটো টানা দিয়ে রাখে প্রায় পনের দিন। এর পরই হাঁটতে পারতাম। ওখানকার ডাক্তার বলেছিলেন এখন হাঁটতে পারলেও এটার রি-অ্যাক্ট হবে বয়স হওয়া পর। তাই হয়েছে। এখন হিপজয়েন্ট ও র্যাম্বো ফিক্সড হয়ে গেছে। ফলে কুঁজো হয়ে গেছি। সারা শরীরে প্রচ- ব্যথা হয়। ডাক্তারি ভাষায় এটাকে বলে এনকোলোজিং স্পন্ডালাইসিস। ফলে দুটো লাঠি বা হুইলচেয়ার ছাড়া চলতে পারি না। তবুও আফসোস নেই। যুদ্ধ করে স্বাধীনতা তো এনেছি।’
সুস্থ হয়ে মুক্তিযোদ্ধা জানে আলম সাচন আবার রণাঙ্গনে ফেরেন। তখন যুদ্ধ করেন দুই নম্বর সেক্টরে। কামরুল হাসান ভূঁইয়ার কমান্ডে অপারেশন করেন কুমিল্লার মুরাদনগর থানা, রাজা চাপিতলাসহ বিভিন্ন স্থানে। একাত্তরে চোখের সামনে সহযোদ্ধাদের মৃত্যুযন্ত্রণা দেখেছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। সেসব স্মৃতি আজও ব্যথিত করে তাকে।
তার ভাষায় ‘চাকলা বর্ডারে এক রাতে ট্রেঞ্চে বসে গুলি করছি। পাশেই ছিল হুমায়ুন কবির। হঠাৎ আলম ভাই বলে চিৎকার দিয়েই সে ছিটকে পড়ে। ছুটে গিয়ে তাকে ধরি। তার সারা শরীর কাঁপছিল। বুকে ও পেটে গুলি লেগে তার কলিজাটা বেরিয়ে এসেছে। যন্ত্রণা আর কষ্টে খুব ছটফট করে সে। কাঁদতে কাঁদতে আমিও তাকে জড়িয়ে ধরি। বুকের সঙ্গে শক্ত করে চেপে রাখি তার শরীরটাকে। কিছুক্ষণ ধরফর করে তার শরীর আমার বুকের মধ্যেই নিথর হয়ে যায়। আরেকবার মনু নদীর ব্রিজ উড়িয়ে রাতের অন্ধকারে দ্রুত ফিরে আসছিলাম আমরা। মতলবের মজনু দলছুট হয়ে ইন্ডিয়াতে আসার রাস্তা ভুল করে অন্য রাস্তায় চলে যায়। ফলে সকালে ধরা পড়ে রাজাকারদের হাতে। ওরা পাঞ্জাবিদের ক্যাম্পে নিয়ে টর্চার করে। ওদের অমানবিক টর্চারে মারা যায় মজনু। লাশটা ওরা মনু নদীতে ফেলে দিয়েছেলোকমুখে এমন খবর পেয়ে কয়েক রাত নদীতে সহযোদ্ধার লাশ খুঁজেছি। সহযোদ্ধা হারানো কী যে কষ্ট! তবুও ভয় হতো না। বরং প্রতিশোধের আগুন মনের শক্তিটাকেই বাড়িয়ে দিত।’
প্রশ্ন করি, যে দেশের জন্য রক্ত দিলেন, সে দেশ কি পেয়েছেন? আনমনা হয়ে এই যুদ্ধাহত বলেন ‘বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন সোনার বাংলার কথা। ওটাই ছিল আমাদের স্বপ্ন। একটা উন্নত জাতি হব আমরা। পৃথিবীর বুকে আমাদের পতাকাকে সবাই শ্রদ্ধা করবে। বলবে, ওরা বীরের জাতি, মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। সেই দেশ তো হয়নি। এখনো এদেশে রাজাকার আছে, এখনো আলবদর আছে, এখনো ধর্মীয় গোঁড়ামি আছে। আমরা তো বাঙালি জাতি। এটাই তো বড় পরিচয় হওয়ার কথা। স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি থাকবে এটা তো কামনাও করিনি। একাত্তরে পাকিস্তানিরা ধর্মের দোহাই দিয়েই ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল। তাহলে স্বাধীন এ দেশে কেন ধর্মীয় গোঁড়ামি থাকবে!’
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৪ নভেম্বর ২০২১
© 2021, https:.