২৫ মার্চ ১৯৭১। গণহত্যা শুরু হয় ঢাকায়। সে খবর আমরা পাই লোকমুখে। বুঝে যাই যুদ্ধ করেই স্বাধীনতা আনতে হবে। জামালপুরে তখনো আর্মি আসেনি। কিন্তু আমরা উদগ্রীব। ট্রেনিং করেই যুদ্ধে নামব। তাই এক রাতে কাউকে কিছু না বলেই ঘর ছাড়ি। কামালপুর বর্ডার পার হয়ে চলে যাই ভারতে। প্রথমে নাম লেখাই মাহেন্দ্রগঞ্জ ইয়ুথ ক্যাম্পে। আমাদের তখন পাঠিয়ে দেওয়া হয় তুরা ট্রেনিং ক্যাম্পে। ২৮ দিন ট্রেনিং করায় ইন্ডিয়ান আর্মিরা। ট্রেনিং শেষে কয়েকটা কোম্পানিতে ভাগ করা হয়। আলফা কোম্পানির কমান্ডের দায়িত্ব দিয়ে আমাকে পাঠানো হয় পুরাখাসিয়ায়। ১১ নম্বর সেক্টরের সাব সেক্টর ছিল ওটা। তখন দায়িত্বে ছিলেন পুলিশের আলম ভাই।
আমরা গেরিলা অপারেশন করতাম। ‘হিট অ্যান্ড রান’ ছিল মূলমন্ত্র। ম্যাকসিমাম অস্ত্র ছিল এলএমজি, এসএলআর আর গ্রেনেড। তারিখটা ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। একটা ফাইটে রওনা হই ইসলামপুরে। ৬৫ জন মুক্তিযোদ্ধা। কমান্ডে আমি। পাকিস্তানি বাহিনীর একটা ক্যাম্প আক্রমণ করেই ওদের আর্মসগুলো নিয়ে আসব। এমনটাই ছিল পরিকল্পনা।
নৌকায় রওনা হই সন্ধ্যার দিকে। রাত কেটে যায় নদীতেই। ভোরে ইসলামপুর এসে আত্মগোপন করে থাকি। বিকেলের দিকে যাই অ্যাটাকে। ওদের ক্যাম্প ছিল একটু উঁচুতে। ঢালু রাস্তায় কিছুটা নিচে আমরা অ্যামবুশ করি। সবুজ ফায়ার হলেই বুঝতে হবে উইথড্রো। তখন সবাই কোথায় একত্র হবে? সেটাও বলা ছিল।
প্রথম আমিই ফায়ার ওপেন করি। শুরু হয় গোলাগুলি। খুব কাছে গিয়ে এক পাকিস্তানি সেনাকে গুলি করে ফেলি দিই। একটু দাঁড়িয়ে ওর দিকে এগোতে যাব, অমনি একটা গুলি এসে লাগে আমার বাঁ পায়ের থাইয়ে। প্রথম কিছুই বুঝতে পারিনি। বাড়ি লাগছে, মনে হলো। পায়ের দিকে চোখ পড়তেই দেখি রক্তে ভেজা। থাইয়ে আঙুল দিতেই গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। বুঝে যাই মাংস ছিঁড়ে গর্তের মতো হয়ে গেছে। পিনপিন করে রক্ত বেরোচ্ছিল তা দিয়ে। তখনো তুমুল গুলি চলছে। ওদের অস্ত্রের মুখে আমরা টিকতে পারি না। এভাবে চললে সবাই মারা পড়ব। তাই তখনই উইড্রোর সিগন্যাল দিই।
আমার পায়ের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। দাঁড়াতে পারছিলাম না। ফার্স্ট এইড নিয়ে এগিয়ে আসে সহযোদ্ধা মুজিবর আর জহিরুল মুন্সি। ওরা আমায় নৌকায় তুলে নেয়। ভোরে নৌকা ভেড়ে বর্ডারে। চোখ মেলতেই দেখি দাঁড়িয়ে আছেন কর্নেল তাহের। সেক্টর কমান্ডার হয়েও আমার মতো মুক্তিযোদ্ধাকে দেখতে উনি চলে এসেছিলেন। খুব অবাক হয়েছিলাম সেদিন।
বড় একটি পিঁড়ির মধ্যে শুইয়ে দুদিকে দড়ি বেঁধে সহযোদ্ধারা আমায় নিয়ে যায় মাহেন্দ্রগঞ্জে। পা দিয়ে তখনো রক্ত ঝরছিল। চিকিৎসার জন্য যেতে হবে তুরাতে। রাতে একটা ট্রাকে আমাকে তুলে দেওয়া হয়। ট্রাক চলছে। ঝাঁকুনিতে পায়ের ব্যথাও বাড়ছে। যন্ত্রণায় মনে হচ্ছিল জীবন চলে যাবে। কী যে কষ্ট পেয়েছি! এখনো মনে হলে চোখ ভিজে যায়। তুরা মিলিটারি হাসপাতালে আমার চিকিৎসা চলে মাসখানেক। হাসপাতালে বসেই ভাবতাম—দেশটা ঠিকই একদিন স্বাধীন হবে। আমাদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। তাই-ই হয়েছে। আমরা পেয়েছি ‘বাংলাদেশ’ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র আর লাল-সবুজের পতাকা। এটা যে কত বড় পাওয়া, বোঝাতে পারব না ভাই।
মুক্তিযুদ্ধে রক্তাক্ত হওয়ার ইতিহাস এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. হাবিবুর রহমান। এক বিকেলে তাঁর বাড়িতে বসে আলাপ চলে একাত্তরের নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে।
ফজলুল হক ও লতিফুন হকের ছোট সন্তান হাবিবুর রহমান। বাড়ি জামালপুরের বকশিগঞ্জ উপজেলার মেষেরচর গ্রামে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি মেষেরচর প্রাইমারি স্কুলে। এরপর তিনি ভর্তি হন বকশিগঞ্জ এন এম (নুর মোহাম্মদ) হাইস্কুলে। ১৯৬৫ সালে তিনি ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজ থেকে। অতঃপর চলে যান ঢাকায়, বিএসসিতে ভর্তি হন কায়েদে আজম কলেজে। ওই সময়ই যুক্ত হন রাজনীতিতে। কলেজ ছাত্রসংসদে ছাত্রলীগের এলাহি-ইব্রাহিম কেবিনেট থেকে তিনি ওয়েলফেয়ার সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছিলেন। যুক্ত ছিলেন তখনকার সব ছাত্র-আন্দোলনেও। এরপর চলে আসেন মিরপুর বাংলা কলেজে। সেখানে ছাত্র সংসদের জিএস হন। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন বিএসসি ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র।
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যের কথা বলতে গিয়ে এই যোদ্ধা বলেন, ‘অর্থনৈতিক বৈষম্য তো ছিলই। এখানের আয় দিয়ে উন্নত হতো পশ্চিম পাকিস্তান। তখন বিহারি আর পাকিস্তানিদের গুরুত্ব সব জায়গায় ছিল বেশি। আর্মিতে অধিকাংশই ছিল ওদের লোক। ওই সময় আর্মিতে কমিশন্ড র্যাঙ্কে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। আইসিএসবি থেকে আউট হয়ে যাই। কেন? কোনো কারণ নেই। ছুটে যাই বাঙালি অফিসার খলিলুর রহমান স্যারের (পরবর্তী সময়ে জেনারেল হন) কাছে। উনি মুখের দিকে তাকিয়ে প্রথম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অতঃপর আশপাশ দেখে বললেন–‘হইছো তো বাঙাল। চাকরি হইব কেমনে?’
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটি হাবিবুর রহমানের কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণ। রেসকোর্স ময়দানে তিনি খুব কাছ থেকে শোনেন ভাষণটি। ভাষণের প্রতিটি কথাই উদ্দীপ্ত করে তাকে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেই ধরে নেন স্বাধীনতার ঘোষণা হয়ে গেছে। এর জন্য যা কিছু করার করতে হবে তাদেরই। তাই তিনি গ্রামে ফিরে যান। ওখান থেকেই চলে যান ট্রেনিংয়ে।
১১ নম্বর সেক্টরের সাব সেক্টর পুরাখাসিয়ার আওতায় কামালপুর থেকে ডালু পর্যন্ত এলাকায় একাধিক অপারেশন করেন মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান। আহত হওয়ার বেশ কিছুদিন পর তিনি আবার রনাঙ্গণে ফেরেন। সাব সেক্টর কমান্ডারের টুয়াইসি হিসেবে তখন দায়িত্ব পালন করেন।
তুরাতে চিকিৎসা শেষে কয়েক দিনের জন্য কলকাতায় গিয়েছিলেন যুদ্ধাহত হাবিবুর রহমান। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় আবেগ আপ্লুত হন তিনি। কী ঘটেছিল সেখানে।
শুনি তার জবানিতে, ‘আমি তখন ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটি। কলকাতায় গিয়েছি ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর বাসায়। একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এসেছে, এমন খবর পেয়ে আশপাশের মানুষ দেখতে আসে আমায়। মায়ের বয়সী এক বৃদ্ধা সামনে হাঁটু গেড়ে ভক্তি দেয়। আমি তো অবাক! ‘খালা’ বলে তাকে জড়িয়ে ধরি। বলি, ‘কী করেন এটা? আমার তো পাপ হবে।’ শুনে উনি মুচকি হেসে বলেন, ‘ভগবান কোথায় থাকে বাবা। ভগবান তো তোমরাই। তোমরাই তো মানুষের জন্য যুদ্ধ করতেছো।’ কথাগুলো মনে হলে এখনো গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়।
ওই বৃদ্ধার বাড়ি ছিল পাশেই। উনি তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। যেখানে বসতে দেন তার পাশেই পুজোর ঘর। পুজোঘরের দেয়ালে টাঙানো ছিল বঙ্গবন্ধুর বড় একটি ছবি। দেখে অবাক লেগেছে। বঙ্গবন্ধুর জন্য অকাট্য ভালোবাসা ছিল ভারতীয় বাঙালিদেরও।
স্বাধীনতা লাভের পর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান যোগ দেন রক্ষীবাহিনীতে। তিন মাস ট্রেনিং শেষে লেফটেন্যান্ট হিসেবে ফিরতেই বড় দায়িত্ব পান। গ্রেটার ফরিদপুরে রক্ষীবাহিনীর ইনচার্জ ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর রক্ষীবাহিনীকে বাতিল করে সদস্যদের সেনাবাহিনীতে নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে আটকে যায় এই যোদ্ধার প্রমোশন। ফলে মেজর হিসেবেই তিনি অবসর নেন।
এ প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান অকপটে বলেন, ‘রক্ষীবাহিনী থেকে এসেছি। কিছু বৈষম্য তো ছিলই। জিয়াকে ভীষণভাবে ঘৃণা করতাম। মুক্তিযোদ্ধা হয়েও উনি রাজাকারদের পুনর্বাসিত করেছেন। তার আমলেই এমআই ক্লিয়ারেন্সের নামে প্রমোশন আটকে যায়। একটু আপস করলেই প্রমোশন পেতাম, করিনি। বিএনপির আমলে আর্মস ফোর্সেস ডের দাওয়াতে গিয়েছিলাম একবার। রাজাকার মন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ কাছে এসে হ্যান্ডশেক করতে হাত বাড়িয়ে দেয়। আমি হাত বাড়াইনি। সবার সামনেই বলেছিলাম, ‘সরি, ফ্রিডম ফাইটার হয়ে রাজাকারের সাথে হাত মেলাতে পারব না।’
যে দেশের জন্য রক্ত দিয়েছেন স্বপ্নের সে দেশ কি পেয়েছেন?
‘আগে পাইনি। তবে এখন আশাবাদী। স্বাধীন দেশে সব মানুষ মিলেমিশে একত্রে থাকবে– এটাই ছিল স্বপ্ন। মানুষ তো এখন বদলে গেছে। সবাই ছুটছে নিজের চিন্তায়। দুর্নীতি তৃণমূলে ছড়িয়ে পড়েছে। আগে নেতারা খুব সৎ ছিল। তারা মানুষের জন্য পলিটিকস করত। এখন কোটি টাকা খরচ করে ক্ষমতায় এসেই তারা তা ওঠায়। রাজনীতিতে বিজনেসম্যানরা বেশি এলে তা রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর হবে। শেখ হাসিনা সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দিয়েছে। এটা করতে পারলে সত্যি দেশ বদলে যাবে। তবে দলের অসৎ লোকদের বিরুদ্ধেও কঠোর হতে হবে।’
প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে সরকারের বিশেষ কর্মসূচি নেওয়া উচিত বলে মনে করেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান। তার যুক্তি, ‘জিয়াউর রহমান, এরশাদ আর খালেদা জিয়ার আমলে মনে হয়েছে দেশটা এমনি এমনি এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা তখন প্রজন্মের কাছে ভুলভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নাম তখন উচ্চারণও করা হতো না। এভাবে কয়েক প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ভুল শিক্ষা পেয়েছে। তাই এখন একাত্তরের সত্যিকারের বীরত্বের ইতিহাস তাদের জানাতে হবে। তাহলেই প্রজন্ম সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।’
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. হাবিবুর রহমান আশায় বুক বাঁধেন প্রজন্মের কথা ভেবে। একদিন তাদের হাত ধরেই দেশটা উন্নত হবে। স্বাধীনতাও তখন অর্থবহ হবে। তাই প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি বললেন, শেষ কথাটি, ‘তোমরা লেখাপড়া করে জ্ঞান অর্জন করো। সত্যিকারভাবে দেশটাকে এগিয়ে নিও। দেশের মানুষকে ভালোবেসো। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সংবাদ প্রকাশে, প্রকাশকাল: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১
© 2021, https:.