গ্রামের নাম বিষ্ণুপুর। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার এ গ্রামেই বসবাস করছেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ উদ্দিন ভূঁইয়া। ফোরকান উল্লাহ ভূঁইয়া ও মালেকান্নেছার পঞ্চম সন্তান তিনি। ম্যাট্রিক পাসের পর বাবার সঙ্গে রাগ করে চলে যান কুমিল্লায়। সেখানে লোকমুখে জানতে পারেন আর্মিতে লোক নেওয়ার খবর। আগ্রহী হয়ে দাঁড়ান কান্দিরপাড় রিক্রুটিং অফিসে। টিকে যেতেই তের-সাত-উনিশ’শ চৌষট্টিতে জয়েন করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে, সৈনিক পোস্টে। পরে তিনি ওয়ারেন্ট অফিসার হয়েছিলেন। বিজেও নম্বর ১৪০৮২।
১৯৬৪ সালের আগস্টের ৩১ তারিখে শহিদ উদ্দিনকে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয় পশ্চিম পাকিস্তানে, রিসালপুরে। এক বছর ট্রেনিং শেষে প্রথমে লাহোর ক্যান্টনমেন্টে এবং পরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় খ্যামকারান সেক্টরের ইঞ্জিনিয়ার কোরে। দায়িত্ব ছিল ব্রিজ ভাঙা, রাস্তাঘাট ভাঙা, মাইন লেয়িং অ্যান্ড লিফটিং, ওয়াটার সাপ্লাই প্রভৃতি। যুদ্ধবিরতির পর তাকে প্রথমে পোস্টিং দেওয়া হয় সোয়াদ গিলগেটে, ওয়ান ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়নে। অতঃপর তিনি কাজ করেন রাওয়ালপিন্ডিতে, ১০১ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়নে। সত্তরের শেষের দিকে তিন মাসের ছুটিতে শহিদ আসেন দেশে। ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১। ছুটি শেষ হওয়ায় রিপোর্ট করেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে, কুর্মিটোলা ট্রানজিট ক্যাম্পে। সেখানে ব্যারাকের ভেতরের পরিস্থিতি তুলে ধরেন তিনি “যহন পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলাম নির্বাচনে তহন বঙ্গবন্ধু পাস করছে। পাঞ্জাবি সৈনিকেরা আমগো টিটকারি দিয়া কইত, ‘শহিদ উদ্দিন, আবিতো তেরা হাতমে পাওয়ার চালা গিয়া’।’’
‘প্রমোশনের বেলায় পাঞ্জাবিগো আগে দিত। আমগো লোকদের দিত খুব কম। কুর্মিটোলায় ট্রানজিট ক্যাম্পে এক ব্যাটালিয়নের ক্যান্টিন থেকে অন্য ব্যাটালিয়নের ক্যান্টিনে গেলেই ওরা চেক করত। তহনই সন্দেহ করছি কিছু একটা ঘটব। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর সব ওলটপালট হইতে থাকে। অসহযোগের সময় আমগো রেশন আসে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে, কার্গো বিমানে। একদিন এয়ারপোর্টে আমগো নিয়া যায় রেশনের মাল আনতে। দেহি পাকিস্তানি সেনারা ওগো পরিবারের লোকদের বিমান ভর্তি কইরা পাঠায়া দিতাছে। স্টাফরোডে মধ্যরাতে তহন ট্যাংক নিয়া ওরা ঘুরাঘুরি করত। ট্রেন বন্ধ ছিল। ১৯ মার্চ তারিখে আমরা ট্রেন পাইলাম। তহন আমি আর বশির বাড়িত চইলা আসি।’
ঢাকায় গণহত্যার খবর শহিদরা পান রেডিওতে। মনে তখন অজানা শঙ্কা। আর্মির লোক পাইলেই পাকিস্তানি সেনারা মেরে ফেলবে। শহিদ ট্রেইন্ড সোলজার। চুপ করে বসে থাকতেও পারেন না। তাই লড়াই-ই একমাত্র পথ। ৩১ মার্চ ১৯৭১। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফোর বেঙ্গল বেরিয়ে এসে অবস্থান নিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিন ছিলেন সেখানে। খবর পেয়ে শহিদ উদ্দিনও জয়েন করেন তার কাছে। এরপরই দেশের স্বাধীনতার জন্য সম্মুুখযুদ্ধ শুরু করেন দুই নম্বর সেক্টরের ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আখাউড়া ও কসবার বিভিন্ন স্থানে। এক অপারেশনে গুলিবিদ্ধ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ উদ্দিন। রক্তাক্ত ওইদিনের কথা মনে হলে আজও এ যোদ্ধার দুচোখ সিক্ত হয়। জানতে চাই কী ঘটেছিল ওই দিনটিতে? খানিক নীরবতা। অতঃপর তিনি বলতে থাকেন রক্তাক্ত ওইদিনের আদ্যোপান্ত:
‘মনতলি স্কুল থাইকা আমাগো পাঠায় কামথানা বিওপিতে। ওখানে শালদা নদীর উত্তর পাশে পাকিস্তানিরা পজিশনে ছিল। ওগো পজিশনে অতর্কিত হামলা করতে হইব। আমরা ছয়জন। তিনটা দলে ভাগ হইয়া ওগো বাংকারের সামনে গিয়া মুখোমুখি ফায়ার করমু। ওরা মনে করব শত্রু সামনে আছে। তহন উত্তর দিকের রেললাইনের নিচ দিয়া একটা কালভার্ট হইয়া আমগো আরও ৩০-৩৫ জন পেছন দিক দিয়া ওগো বাংকার চার্জ করব। সন্ধ্যায় এইডাই হয় পরিকল্পনা। ৪ জুন ১৯৭১। রাত তহন সাড়ে ৩টা। মুখোমুখি হইয়াই ফায়ার করি। পাকিস্তানি সেনারা তহন টু-ইঞ্চি মর্টারের ফায়ার করে। সব গোলা গিয়া পড়ে আমগো পেছনে। প্রচ- গোলাগুলি চলছে। আমি ছিলাম ধানক্ষেতের আইলে। দুই পাশে সউদ মিয়া, আবুল কালাম আর হামিদ। পাকিস্তানিরা একটু উঁচুতে। হঠাৎ বুকে একটা ধাক্কা খাইলাম। তহনও কিছু বুঝি নাই। মনে হইছে বুকের ডান পাশে একটা গুঁতা লাগছে। ভাবছি লাঠির গুঁতা। কিছুক্ষণ পরেই আমগো লোকেরা পেছন থাইকা ওগো ওপর আক্রমণ করে। গোলাগুলি তহন শেষ। কোনো আওয়াজও নাই। আমরা তহন আসি গৌরাংগোলা গ্রামের মসজিদের পাশে। খালি গা। বুক দিয়া রক্ত পড়তেছিল। গা’ও শিরশির করছে। জোঁকে ধরছে নি! আঙুল দিয়া ধরতেই দেহি বুকের ভিতরে আঙুল ঢুইকা যায়। তহনই বুঝছি গুলি খাইছি। আমি যে বাইচা থাকমু এইডা স্বপ্নেও ভাবি নাই ভাই। একাত্তরের পরে বোনাস লাইফ নিয়া চলতাছি।’
চিকিৎসা নিলেন কোথায় : “এক বাড়ির দরজার একটা পাল্লা খুইলা সহযোদ্ধারা আমারে তুইলা নেয়। গ্রামের এক ডাক্তার প্রথমে দেখে। জ্ঞান তহনও ছিল। উনি শুধু বললেন, ‘আশা নাই’। তবুও কোরামিন আর একটা ইনজেকশন দিতেই শরীরটা গরম হইল। এরপরই আমারে নেওয়া হয় আগরতলা জিবি হাসপাতালে। রক্তে হাসপাতালের ফ্লোর ভাইসা গেছিল। অপারেশন থিয়েটারে ডাক্তার রতিন দত্তর হাত ধইরা হাউমাউ কইরা কাইন্দা কইছিলাম, ‘যদি মইরা যাই তাইলে আমার ডেডবডিটা বাংলাদেশে পাঠাইয়েন স্যার।’ উনি আমার মুখের দিকে শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। পাকিস্তানি সেনাগো গুলিটি আমার বুকের ডান পাশ বিদ্ধ করে ফুসফুস ফুটা কইরা দেয়। অপারেশনে ফুসফুসের কিছু অংশ কাইট্টা ফেলতে হয়। তহন রক্তও লাগছিল। তৎকালীন এমপিএ লুৎফুল হাই সাচ্চু আমারে রক্ত দিছেন। তার রক্তেই আজ বাঁইচা আছি।”
স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তান ফেরত বাঙালি সেনাদের নিয়া সেনাবাহিনী গঠন প্রসঙ্গে এ যোদ্ধা অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত: ‘যুদ্ধবিধস্ত দেশ গড়ার উদ্যোগ নিছিলেন শেখ মুজিব। পরিস্থিতিগত কারণে বাঙালি সেনারা পশ্চিম পাকিস্তানে আটকা পড়ছিল। তাই পাকিস্তান ফেরত বইলাই কোনো বাঙালি সেনা সদস্য দেশবিরোধী হবেনএই ভাবনাটা মোটেই ঠিক নয়। আমি মনে করি এইটা বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত ছিল। বরং আগে সেনাবাহিনীতে তেমন রাজনীতি ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেনাবাহিনীতেও রাজনীতি ঢুইকা গেছিল।’
যে দেশের জন্য রক্ত দিলেন স্বপ্নের সে দেশ পেয়েছেন কি : তিনি বলেন, ‘চাইছিলাম সুন্দর একটা দেশ। যেখানে হত্যা, রাহাজানি, অন্যায় থাকব না। খাই খাই থাকব না। সে দেশ এখনো হয় নাই। তবে দেশ উন্নতির পথেই আছে। প্রথম কথাই হইল সবাইরে সৎ থাকতে হবে। আপনি নিজে অর্থলোভী হইবেন কিন্তু অন্যের সততা চাইবেনএইটা কিন্তু হইব না। সরকারকেও ন্যায়পরায়ণ ও সঠিক বিচার করতে হইব। তা না হইলে শত উন্নয়নেও দেশ আগাইবো না।’
প্রজন্মের হাত ধরেই এদেশ একদিন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা হবেএমনটাই বিশ্বাস যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ উদ্দিন ভূঁইয়ার। পাহাড়সম আশা নিয়ে তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন, ‘দেশপ্রেম মানুষের শক্তি। পতাকা তোমার পরিচয়। তোমার পরিচয়টাই তুমি সবার ওপরে তুইলা ধরো। মাদক থেইকা দূরে থাকো। মনে রাইখো তোমার ভবিষ্যৎ নষ্ট করতেই মাদকের সৃষ্টি।’
এমন মুক্তিযোদ্ধারা পৌরাণিক কোনো চরিত্র নয়, বাঙালি বীর। তাদের রক্ত, ঘাম, ত্যাগে সৃষ্ট বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে এই বীরদের বিজয়ের গৌরবগাথা অনাদিকাল পর্যন্ত আমাদের আলোড়িত করবে।
লেখাটি প্রকাশিত দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৭ অক্টোবর ২০২১
© 2021, https:.