নবম শ্রেণিতে পড়ি তখন। স্টিমারঘাটে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের নিয়োগ চলছে। পরদিন স্কুলে না গিয়ে বই হাতেই ঘাটে যাই। বড় একটা জাহাজে রিক্রুটিং চলছে। দাঁড়াতেই অফিসার মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে রইলেন। অতঃপর বুকে একটা সিল মেরে দেন। টিকে গেলাম। এরপরই ট্রেনিংয়ে যেতে হয়। রাতে স্টিমারে করে নেওয়া হয় খুলনায়। সেখান থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঠাকুরগাঁওয়ে, ইপিআর ক্যাম্পে। ইপিআরের জিডি সিপাই ছিলাম, বডি নম্বর ছিল ১৯২৭৫। ট্রেনিং শেষে পোস্টিং হয় প্রথমে সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স, দিনাজপুরে। পরে সতেরো উইংসহ আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকার পিলখানায়।
ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর) যোগ দেওয়ার কথা এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মাকসুদুর রহমান। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই আলাপ চলে যুদ্ধদিনের নানা বিষয় নিয়ে। আবদুল সামাদ হাওলাদার ও লালবরু বেগমের বড় সন্তান মাকসুদুর রহমান। বাড়ি ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার সারদল গ্রামে।
সত্তরের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। বাঙালিদের দমাতে ভেতরে ভেতরে তারা সামরিক প্রস্তুতি নিতে থাকে। ওই সময় মাকসুদুর রহমানদের সতেরো উইংসহ পুরো ব্যাটালিয়নকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কাপ্তাইয়ে। মূলত কাপ্তাই বিদ্যুৎকেন্দ্র আর বাঁধের ৩৬টি স্পটে ডিউটি ছিল ইপিআরের সৈনিকদের। ওখানে তিনি ছিলেন সি কোম্পানিতে। ওটা ছিল হেডকোয়ার্টার কোম্পানি। উইংয়ের কমান্ডার ছিলেন একজন পাকিস্তানি। তবে তার অবর্তমানে এই কোম্পানির কমান্ড করতেন বাঙালি ক্যাপ্টেন হারুনুর রশিদ চৌধুরী।
মাকসুদুরের ভাষায়, “ওয়্যারলেসে যারা ডিউটি করত তারা সবাই ছিলেন বাঙালি। নায়েক সুবেদার শফিউল্লাহ ওয়্যারলেসের ইনচার্জ। এ ছাড়া স্বাধীনতার পক্ষে উদ্যোগী ছিলেন নায়েক সুবেদার খোরশেদ আলম, হাবিলদার আক্তার, হাবিলদার বজলু, সুবেদার জব্বুল হোসেন প্রমুখ। তারা বলতেন ‘হুঁশিয়ার, যেকোনো সময় কিছু হতে পারে।’ পরে ক্লাস নেওয়ার সময় গোপনে ডিটেইল জানাতেন।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরই ব্যারাকে ননবেঙ্গলি ও বেঙ্গলি দুটি ভাগ হয়ে যায়। ওরা বেলুচ, পাঞ্জাব ভাষায় নিজেদের মধ্যে ও উচ্চমহলে কথা বলত। এগুলো সিনিয়ররা বুঝতেন। তারা তা আমাদের জানিয়ে ঐক্যবদ্ধ ও সতর্ক থাকতে বলতেন।”
মার্চের বিশ তারিখের পর থেকে ওদের অ্যাক্টিভিটি বেড়ে যেতে থাকল। বিভিন্ন কোম্পানি হিলের বিভিন্ন জায়গায় ডিউটিরত ছিল। নতুন ল্যাঙ্গুয়েজ প্রশিক্ষণের কথা বলে তাদের ডাকা হলো হেডকোয়ার্টার্সে। যাদের ডাকা হলো তারা সব ছিল ননবেঙ্গলি পাঠান, বেলুচ ও পাঞ্জাবি। নায়েক ও হাবিলদারদের ক্লোজ করে নেওয়া হয়। সাপোর্ট প্লাটুনের জোয়ানদের পোস্টিং দিয়ে প্রতি জায়গায় বসিয়ে দেওয়া হয় একজন পাঞ্জাবি। এর ফলে বাঙালি সৈন্যদের সন্দেহ যায় বেড়ে।
২৫ মার্চ তারিখে ব্যারাকে ঘটে আরও ঘটনা। অজানা সে ইতিহাস শুনি মাকসুদুর রহমানের জবানিতে “ওইদিন কাপ্তাই বাঁধের ৩৬টি স্পটের পাহারায় বসানো হয় নতুন সৈন্য। একেকটা স্পটে দুজন সৈনিক ও একজন এনসিও থাকত। এনসিও দেওয়া হলো ননবেঙ্গলি আর দুই সৈনিক হিসেবে থাকে বাঙালি। এটা সব জায়গাতেই করা হলো। দ্রুত কেন এত রদবদল! ধরেই নিই খারাপ কিছু ঘটবে।
মনে তখন নানা উৎকণ্ঠা। রাতে খাওয়া শেষে রোলকল হলো। জানানো হয় পরদিন সকালে দরবার প্যারেড হবে। সকল সৈনিককে সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে। ২৫ মার্চ গ্রেপ্তারের আগে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার মেসেজটি ইপিআরের ওয়্যারলেসেই থ্রো করা হয়েছিল। ওয়্যারলেসের ইনচার্জ নায়েক সুবেদার শফিউল্লাহ সেটি পেয়ে ছুটে যান হারুন সাহেবের বাংলোতে। তিনিই ছিলেন একমাত্র বাঙালি অফিসার, আমাদের ভরসার জায়গায়।
দ্রুত ওয়্যারলেস সেন্টারে চলে আসেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর মেসেজসহ ওয়্যারলেসে ঢাকার পিলখানা, রাজারবাগ ও ইউনিভার্সিটি আক্রমণের খবর নিশ্চিত হন। তখন সুবেদারদের নিয়ে ৩৬টি পোস্টে ননবেঙ্গলি এনসিওদের অ্যারেস্ট করান।
অস্ত্রাগারের দায়িত্বে ছিলেন এক পাঠান। তাকে অ্যারেস্ট করার পরই হারুন সাহেব বললেন, ‘যারা ননবেঙ্গলি আছো এনসিও, জেসিও অথবা সিপাহি তোমরা ব্যারাকের ভেতর বসে থাকবে। যারা বাঙালি আছো তাড়াতাড়ি অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র নিয়ে নাও।’ আমরা দ্রুত অস্ত্র নিয়ে ব্যারাকের ভেতর ওদের অ্যারেস্ট করি।
এরপরই পুরো একটা কোম্পানি বের হয়ে আসি। পাশেই ছিল ফায়ার ব্রিগেডের অফিস। সিনিয়ররা পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন খারাপ কিছু ঘটলে তাদের মাধ্যমে শহরে সাইরেন বাজানো হবে। তাই করা হলো। দেখলাম শত শত মানুষ সাহায্য করার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। এই সাধারণ মানুষগুলোই আমাদের সাহস জুগিয়েছিল। ফজরের আজানের সময় আমরা পৌঁছি কালুরঘাটে। ওইদিকে ছিলাম বেশ কিছুদিন। এপ্রিলের প্রথম দিকে পটিয়া ও বান্দরবান হয়ে চলে যাই ভারতের দেমাগ্রিতে।”
ভারতে গিয়ে কি আবারও ট্রেনিং করতে হলো? তিনি বলেন, ‘অস্ত্র প্রশিক্ষণ তো আগেই ছিল। ওখানে হাই এক্সপ্লোসিভের, পিকে ওয়ান, বুবিট্র্যাপস, মাইনস, অ্যান্টি ট্যাঙ্কক, অ্যান্টি পারসোনাল মাইনস
প্রভৃতির ওপর বিশ থেকে পঁচিশ দিন ট্রেনিং করানো হয়। জুনের দিকে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় চার নম্বর সেক্টরের কমলগঞ্জে, ক্যাপ্টেন এনামের কাছে।
প্রথম প্রথম ভারত থেকে বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে আক্রমণ করেই ফিরে যেতাম। পরে অপারেশন করি সিলেট কমলগঞ্জের ধলাই, পাথরঘাটা ব্রিজ, খুরমা প্রভৃতি স্থানে। সিলেটে প্রচুর জোঁক ছিল। আমরা জঙ্গল বা চা বাগানে পজিশন নিতাম। সারা শরীরে জোঁক লেগে থাকত। ফিরে এসে শরীর থেকে জোঁক ছাড়াতাম। রক্তে লাল হয়ে যেত গোটা শরীর।’
কমলগঞ্জের ধলাইয়ে পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালী ঘাঁটিতে অপারেশনের সময় রক্তাক্ত হন মুক্তিযোদ্ধা মাকসুদুর রহমান। আর্টিলারির স্পিøন্টার বিদ্ধ হয় তার মাথায়, নাকে, পায়ে ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায়। ডান পায়ের ভেতরে দুটি স্পিøন্টার এখনো রয়ে গেছে। চিকিৎসা হয় ভারতের কমলপুর হাসপাতালে। চিকিৎসা শেষে তিনি আবারও ফিরে যান রণাঙ্গনে। সিলেট মুক্ত হলে জামিয়াতে অস্ত্র জমা দিয়ে চলে আসেন ঢাকায়, পিলখানায়।
কিন্তু স্বাধীন দেশে চাকরি হারাতে হয় এই যোদ্ধাকে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশ উল্টো দিক চলতে থাকে। বিভিন্ন বাহিনীতে ফাইটার ও ননফাইটার দ্বন্দ্ব শুরু হতে থাকে তখন। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে আমাকেও বিডিআর থেকে চাকরি হারাতে হয়। সিনিয়ররা অধিকাংশই ছিলেন ননফাইটার। মুক্তিযুদ্ধের কথা উঠলেই বলতেন থোও তোমার ওই যুদ্ধটুদ্ধর কথা। কেউ কেউ বলত গ-গোল। খুব খারাপ লাগত তখন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কোনো দাম ছিল না মুক্তিযোদ্ধাদের।’
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দেশ নেই যেখানে স্বাধীনতাবিরোধীরা রাজনীতি করতে পারে। এটা আছে শুধু বাংলাদেশে। জিয়ার কারণেই স্বাধীনতাবিরোধীরা রাজনীতি করার বৈধতা পেয়েছে বলে মত দেন মুক্তিযোদ্ধা মাকসুদুর রহমান। তিনি মনে করেন জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধসহ এ দেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতি পুরোপুরি বন্ধ করা উচিত।
আজকে যখন অকপটে শিশুরা জয় বাংলা বলে, বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকে, তাকে অনুভব করতে পারে তখন মন ভরে যায় এই বীরের। তিনি মনে করেন ওই শিশুর হাত ধরেই এক দিন সোনার বাংলা হবে। মাকসুদুর রহমানের মতো মুক্তিযোদ্ধারাই বাঙালি বীর। একাত্তরে তাদের বীরত্বের ইতিহাসগুলো অনাদিকাল পর্যন্ত প্রজন্মকে আন্দোলিত করবে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১
© 2021, https:.