এই মাটিতে আমাগো রক্তের গন্ধ আছে
খুলনায় তখন বিহারিদের আধিপত্য ছিল বেশি। বাঙালিদের ওরা দেখতে পারত না। ওদের অধীনে চলতে হবে, তখনো উর্দুতে কথা বলতে হবে– এসব মানতে পারত না লিবিওরা। নিউমার্কেটের পাশেই ছিল একটি খেলার মাঠ। তারা ফুটবল খেলতে যেত সেখানে। খেলা নিয়ে হাতাহাতি হতো বিহারিদের সঙ্গে। মার যেমন দিতেন, আবার মার খেতেও হয়েছে তাদের।
উল্লাসিনী আর সোসাইটি সিনেমা হলে দলবেঁধে সিনেমা দেখতে যেত তারা। বিহারিরা আগেই টিকিটগুলো নিয়ে ব্ল্যাকে বিক্রি করত। চার আনার টিকিট কিনতে হতো দুই-তিন টাকায়। লিবিওদের জাকব, কালু, মইনটে, আনন্দ, দুলু, পানু, রঙ্গ, ফারুক, আসলাম, আলীসহ একটি দল ছিল। সিনেমা হলে তারা গ্যাদারিং করে ভেতর থেকে চার আনাতেই টিকিট কাটতেন। বিহারিরা এটা মেনে নিতে পারত না। দলবেঁধে ওরাও আক্রমণ করত তাদের ওপর। ফলে বিহারিদের সঙ্গে লিবিওদের মারামারি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।
ওই সময় লিবিওরা দেশের নানা খবরাখবর জানতেন নেতাদের মুখে। বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসির থাকতেন খুলনার ছোট বয়রায়। বড় মাঠে তখন নিয়মিত মিটিং হতো। আওয়ামী লীগের নেতা ইকবাল সরদার, ফরহাদ সাহেব, মোহসিন সাহেবও বক্তব্যে দেশের বৈষম্যের কথা তুলে ধরতেন। দুই পয়সা দাম ছিল দিয়াশলাইয়ের। সেটা পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে লেবেল লাগিয়ে আনলেই বাঙালিদের তা এক আনায় কিনতে হতো। এসব বৈষম্য লিবিওদের মনে ঝড় তুলত।
দেশ তখন উত্তপ্ত। সবার দৃষ্টি শেখ মুজিবের দিকে। ৭ মার্চ ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন রেসকোর্স ময়দানে। বললেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি…তোমাদের যার যা কিছু… এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ রেডিওতে শোনা রক্ত গরম-করা ওই ভাষণই লিবিওদের দেশপাগল করে তোলে।
প্রতিরোধযুদ্ধের জন্য তারা প্রস্তুত হয় তখন। খুলনা নিউমার্কেটের পাশের মাঠেই ট্রেনিং চলে। তখন আড়াই হাত বাঁশের লাঠি ছিল রাইফেল। আর ইট ছিল গ্রেনেড। আনসার সদস্য আজগার লিবিওদের ট্রেনিং করায়। কয়েক দিন চলে লেফট-রাইটও। কিন্তু ট্রেনিং শেষ হওয়ার আগেই বিহারিরা তলোয়ার নিয়ে তাদের ওপর আক্রমণ করে। বিহারি কালু কসাই আর বান্না কসাইয়ের নেতৃত্ব দেয়। লিবিওদের কয়েকজনকে তারা রক্তাক্ত করে। ওই দিনই তারা প্রতিজ্ঞা করেন, পাকিস্তানি দালাল বিহারিদের উচিত শিক্ষা দেবেন।
মুক্তিযুদ্ধের আগে নানা ঘটনাপ্রবাহের কথা শুনছিলাম যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা লিবিও কিত্তনীয়ার জবানিতে। তাঁর জন্ম খুলনার সদর উপজেলার সোনাডাঙ্গা গ্রামে। বাবা কীরণ কিত্তনীয়া চিটার গুদামে ম্যানেজারি করতেন, চার নম্বর ঘাটে। মা কাঞ্চন কিত্তনীয়া ছিলেন গৃহিণী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ক্লাস এইটের ছাত্র।
তিনি বলেন, “নিউমার্কেটে বড় বড় নারকেলগাছ কেটে রাস্তায় ফেলে আমরা পালিয়ে থাকতাম। আর্মির জিপ এসে দাঁড়ালেই চারপাশ থেকে ইট মারতাম। তখন ইটই আমাদের বোমা। ভয় ছিল না। সাহস ছিল খুব। কিন্তু ইট দিয়ে তো একটা সামরিক বাহিনীকে হটানো যাবে না! এরই মধ্যে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন শুরু হয়। বন্ধু টুলুর বড় ভাই বুলু ছিল রাজাকার কমান্ডার। ওরা যুবকদের ধরে জোর করে রাজাকার বাহিনীতে নাম লেখাত। তা না হলেই তাকে মেরে ফেলা হতো। আসু নামের এক ছেলেও এভাবে রাজাকারে নাম লেখায়। কিন্তু জীবন গেলেও রাজাকার হতে পারব না। তাই জুনের শেষ দিকেই বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলাম।”
ট্রেনিং নিলেন কোথায়?
“মাছের নৌকায় করে চলে গেলাম খুলনা তেরোখাদার পাতলায়। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প ছিল। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন ফমুদ্দিন। নৌ কামান্ডো নুরুল হক মোল্লা আমাদের ২০ দিনের ট্রেনিং করান। ছিলাম ৬০-৬৫ যোদ্ধা। কিন্তু ক্যাম্পে অস্ত্র ছিল কম। পাতলা ক্যাম্পে স্থলযুদ্ধ কম হতো। জলযুদ্ধ ছিল বেশি। লঞ্চে করে পাকিরা আসত। ওরা বালির বস্তা দিয়ে লঞ্চের ওপরই বাঙ্কার করে রাখত। এক মাইল দূরে গিয়ে তা দেখে আসতাম। ক্যাপ্টেন সাহেবকে রিপোর্ট করার পর সে অনুসারেই সবাই পজিশনে চলে যেতাম। একবার আঠারোবাগির মোড়ে ওদের একটা লঞ্চ আমরা ডুবিয়ে দিই। এভাবেই নয় নম্বর সেক্টরের অধীনে গেরিলা হিসেবে যুদ্ধ করি আটারবাগি, সাতপার, বুঝনা, মানিকদা প্রভৃতি এলাকায়।”
এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের রকেট শেলের আঘাতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধা লিবিওর ডান পা। পরে তাঁর পা-টি হাঁটুর ওপর থেকে কেটে ফেলতে হয়েছে। ওই দিনের ঘটনা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন এ বীর। একজন যোদ্ধার কান্না আমাদেরও স্পর্শ করে। অতঃপর তিনি বলেন রক্তাক্ত ওই দিনটির কথা।
“১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। দেশ তখন স্বাধীন হয়-হয়। পাকিস্তানি সেনাদের লঞ্চ কম আসে। ফাইটও কমে গেছে। আমরা অলস সময় কাটাচ্ছি। নুরুল হক মোল্লা পাগলের ছদ্মবেশে আমাকে খুলনা শহরের অবস্থা রেকি করতে পাঠায়। ছেঁড়া শার্ট, ছেঁড়া প্যান্ট পরা। সকাল ১০টায় পাতলা ক্যাম্প থেকে প্রথমে খুলনায় আসলাম। শহর মোটামুটি নরমাল। চার আনা দিয়ে পেট ভরে ডাল ভাত খেলাম এক হোটেলে। খুলনা নিউমার্কেটের পাশেই ছিল ফায়ার সার্ভিস অফিস। ওখানেই আর্মি ক্যাম্প। প্রতিদিন গাড়িতে করে ওরা নিউমার্কেটে খাদ্য নিতে আসে।
এ খবরটি শোনার পর আমরা ওই দিকে যাই। সঙ্গে ছিল আক্তার নামে এক ছেলে। দূরে একটা আর্মির জিপ দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়িতে মেশিনগান ফিট করা। বেলা তখন তিনটা। কীভাবে ওদের ওপর আক্রমণ করা যায়, সেটি দেখছিলাম। হঠাৎ ওদের গাড়িটা দ্রুত সরে পড়ে। আমরা তো অবাক! ওদের ইনফর্মাদের নজরে পড়ে গিয়েছিলাম। ওরা সে খবর পৌঁছে দিয়েছিল ক্যাম্পে। কিন্তু এটা আমরা বুঝতেও পারিনি।
অল্প কিছুক্ষণ পরেই হঠাৎ ওরা ক্যাম্প থেকে আমাদের দিকে রকেট শেল ছুড়তে থাকে। রক্ত যেখানে আছে রকেট সেখানে লাগবেই। কিছু বোঝার আগেই একটা রকেট শেল দোকানে বসা একজনের মাথায় লেগেই আমার ডান পায়ে প্রচণ্ড আঘাত করে। আমি ছিটকে গেলাম। দেখলাম ডান পা-টা বিচ্ছিন্ন হয়ে চামড়ার সঙ্গে হালকা লেগে আছে। জ্ঞান তখনো ছিল। গলগলিয়ে রক্ত পড়ছে। তাতে হাত পড়তেই অনুভব করলাম গরম ফেনের মতো রক্ত। এরপরই বেহুঁশ হয়ে গেলাম।
রাত তখন দশটার মতো। জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম খুলনা সদর হাসপাতালের মেঝেতে। মিশনারির লোকেরা আমায় তুলে নিয়ে গিয়েছিল সেখানে। হাসপাতাল ভর্তি ছিল পাকিস্তানি সেনারা। সকালের দিকে এক পাকিস্তানি ‘মাদারচোদ মুক্তি’ বলেই এক লাথি দিয়ে আমায় ফেলে দেয় সিঁড়িতে। পরে আমাদের চার্চের ফাদার দ্রি আর বিশব মাইকেল ডি রোজারিও আমাকে নিয়ে ভর্তি করে যশোর ফতেমা হাসাপাতালে। সেখানেই ডান পা-টা হাঁটুর ওপর থেকে কেটে ফেলা হয়।”
যে দেশের জন্য রক্ত দিলেন স্বপ্নের সে দেশ কি পেয়েছেন?
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি বলেন, “পতাকা পেয়েছি, মানচিত্র পেয়েছি, এটাই ছিল তখন স্বপ্ন। এই মাটিতে আমাগো রক্তের গন্ধ আছে, এটা ভাবলেই মন ভরে যায়। দেশ পেয়েছি এটা বড় কথা।”
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে নানাভাবে সাহায্য পেয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা লিবিও কিত্তনীয়া। চিকিৎসার জন্য এক হাজার টাকা ছাড়াও ভাতা পেতেন পঁচাত্তর টাকা করে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেন:
“১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়েছিলাম। হানিফ সাহেব তখন পিএ। সকালে গেছি। উনি সাদা লুঙ্গি আর কোড়া গেঞ্জি পড়া। নিজের অভাবের কথা বললাম বঙ্গবন্ধুকে। আমার সব কথা তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। অতঃপর হানিফ সাহেবকে বলে দিলেন ৫০০ টাকা দিতে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘চিন্তা করিস না, তোদের জন্য ট্রাস্ট বানাচ্ছি। ভারত থেকে ৪ লক্ষ টাকাও পেয়েছি। বিহারিদের যেসব প্রতিষ্ঠান ছিল সেগুলো ট্রাস্টে দিয়ে সেখান থেকেই আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করা হবে।’ ওনার হাত দিয়েই পরে কল্যাণ ট্রাস্ট হয়েছে। তার মতো মানুষ আর দেখিনি ভাই। বঙ্গবন্ধুর তুলনা শুধু বঙ্গবন্ধুই।”
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে শেখ হাসিনা সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে এ বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন: “আমাদের মনের ভেতরের কষ্টের মেঘ শেখের মেয়ে সরিয়ে দিয়েছেন। খালিশপুরের রায়েরমহলে মনু শেখ নামের এক রাজাকার কমান্ডার বাঙালিদের ধরে এনে জবাই করে নদীতে ফেলত। জেলে সেজে তাকে ধরতে গিয়েছিলাম একাত্তরে। কিন্তু তার আগেই সে সরে যায়। রাজাকাররা না থাকলে পাকিস্তানি সেনারা এত গণহত্যা চালাতে পারত না। স্বাধীনতা লাভের পর বিএনপির হাত ধরেই ওরা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিল। এদের ক্ষমতা দেখে কখনো ভাবিনি বিচার করা যাবে। রাজাকারদের ফাঁসি হয়েছে। এখন মরেও মুক্তিযোদ্ধারা শান্তি পাবে।”
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালো লাগা অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তরে মুক্তিযোদ্ধা লিবিও বলেন, “আগে বিমানে যশোর যেতে ওপর থেকে ছোট ছোট বাড়ি দেখতাম। এখন মনে হয় সিঙ্গাপুরে আসছি। এত উন্নত হয়েছে। মানুষের আয় বাড়ছে। পদ্মা সেতু হলে তো দেশের চেহারাই বদলে যাবে। স্বাধীন দেশের উন্নতিটাই মন ছুঁয়ে যায়।”
কী করলে দেশের আরও উন্নতি হবে?
মুচকি হেসে তিনি বলেন, “সরকারের উচিত দেশের যুবদের কর্মসংস্থান তৈরির দিকে বিশেষ নজর দেওয়া। শিক্ষার উন্নতি করতে হবে সবার আগে। হেফাজতের শিক্ষা নীতিতে থাকলে তো দেশে অন্ধকার নামবে। তবে সবচেয়ে বড় কথা সবাই যদি নিজের কাজের প্রতি সৎ আর একনিষ্ঠ থাকে তাহলেই দেশ এগোবে।”
পরবর্তী প্রজম্মের কথা উঠতেই নিজের পাঁচ বছর বয়সী আদরের নাতি লিয়ন কিত্তনীয়ার দিকে চোখ রাখেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা লিবিও কিত্তনীয়া। বুকভর আশা আর আনন্দে চোখ ভেজানো কান্নায় পরিবেশ তখন অন্য রকম। আমরাও নীরব থাকি। অতঃপর নীরবতা ভেঙে প্রজম্মের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন, “তোমরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধরে রেখ। দেশের মঙ্গল হয় সে কাজ কর। আমাদের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ এনেছি। এ দেশ অন্য কার না, তোমাদের। তোমরাই হচ্ছ দেশের ভবিষ্যৎ। স্বাধীন এ দেশটা তোমাদের হাতেই দিয়ে গেলাম। যুগে যুগে তোমরাই এর স্বাধীনতাটা রক্ষা কর।”
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সংবাদ প্রকাশে, প্রকাশকাল: ৫ নভেম্বর ২০২১
© 2021, https:.