নৌকমান্ডো মতিউরদের নারায়ণগঞ্জ বন্দর অপারেশন
২৫ মার্চের পর দেশের অবস্থা বদলে যেতে থাকে। খেলোয়াড় ছিলাম, খেলতে গেলে প্রায়ই গ্রামের মাঠে বোম্বিং হতো। ভয়ে সবাই পালাতাম। পাকিস্তানি আর্মিদের অত্যাচারের খবরে ঠিক থাকতে পারতাম না। একসময় নূর ইসলাম, শহিদ, কাউসার ফরাজীর সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। মে মাসের শেষের দিকের কথা। এক দুপুরে খেলার কথা বলে বাড়ি ছাড়ি। পাশের গ্রামের শহিদুল ইসলাম ছিল পথপ্রদর্শক। ফরিদপুর দিয়ে যশোর হয়ে ভারতের চব্বিশ পরগনায় যাব। কিন্তু বাগদা বর্ডার পার হওয়ার আগেই সঙ্গের দুই বন্ধু মত পাল্টাল। তারা বাড়ি ফেরত গেল। আরেকজন ভারতে গিয়ে ট্রেনিংয়ে যেতে চাইল না। আমি তখন একা। কিন্তু সিদ্ধান্তে অটল। লোকমুখে ঠিকানা জেনে চলে যাই বনগাঁ, টালিখোলা ক্যাম্পে। প্রায় দুই সপ্তাহ লেফট-রাইট আর ক্রলিং করানো হয় ওই ক্যাম্পে।
একাত্তরে ট্রেনিংয়ে যাওয়ার ঘটনা এভাবেই তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নৌকমান্ডো মো. মতিউর রহমান (বীরপ্রতীক)। এক সকালে তার বাড়িতে বসেই চলে আলাপচারিতা। তার বাবা আবদুল আলী ছিলেন কাপড়ের ব্যবসায়ী আর মা জোলেখা বেগম গৃহিণী। ৫ ভাই ২ বোনের সংসারে মতিউর তৃতীয়। বাড়ি মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার সাতঘড়িয়া গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ক্লাস টেনের ছাত্র।
নৌকমান্ডো ট্রেনিং কি ওই ক্যাম্পেই হয়েছিল?
‘না, টালিখোলা ক্যাম্পে এক দিন আসেন আতাউল গণি ওসমানী সাহেব। সঙ্গে ছিলেন ইন্ডিয়ান নেভির প্রধান। একাত্তরে আটজন বাঙালি সাবমেরিনার জাহাজ আনতে গিয়েছিলেন ফ্রান্সে। তারা ওখান থেকে পাকিস্তান পক্ষ ত্যাগ করে পালিয়ে চলে আসেন ইন্ডিয়ায়। ওইদিন ওসমানীর সঙ্গে তারাও আসেন। প্রথমে সবাইকে ফলিং করানো হয়। পরে বাছাই করা হয় ৬০ জনকে। মেডিকেল টেস্টের পর বাতিল হয় বিশজন। আমিসহ চল্লিশজনকে বলা হলো, একটা গ্রুপ করা হবে যারা অপারেশনে গেলে মরতেও হতে পারে। শুনে আমরা রাজি হয়ে যাই, মরতে হলে দেশের জন্য মরমু।
আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় মুর্শিদাবাদে, ভাগীরথী নদীর পাড়ে। ওটা ছিল পলাশীর প্রান্তর। বিভিন্ন ক্যাম্প থেকেও বাছাই করে আনা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। অপারেশন জ্যাকপটে আমরা ছিলাম সুইসাইডাল স্কোয়াড। তাই ট্রেনিংয়ের শুরুতেই একটা ফরমে সই নেওয়া হয়। ইন্ডিয়ান নেভিরা ট্রেনিং করান। প্রথম দিকে প্রত্যেককে পায়ে ফিন্স পরে চিতসাঁতারের অভ্যাস করায়। বুকে গামছা দিয়ে ৪ থেকে ৫ কেজি ওজনের মাটির ঢিবি বা ইট বেঁধে নদীতে চিতসাঁতার করানো হতো। সবচেয়ে কঠিন ছিল ডুব দিয়ে পানির নিচে লোহার প্লেটের গায়ে মাইন লাগিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সাঁতার কেটে ফেরত আসা। এ ছাড়া কেউ মারতে এলে তাকে প্রতিহত করার যুদ্ধও শেখানো হয়। প্রতিদিন প্রায় ১৭-১৮ ঘণ্টা প্রশিক্ষণ হতো। আমার নৌকমান্ডো নম্বর ছিল ০০৪৪। বিশেষ এই নৌকমান্ডো ট্রেনিং চলে প্রায় আড়াই মাস।’
নৌকমান্ডোরা ছিলেন দশ নম্বর সেক্টরের অধীনে। কোনো সেক্টর কমান্ডার ছিল না এই সেক্টরে। প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানী এটা নিয়ন্ত্রণ করতেন। অপারেশনের জন্য যখন নৌকমান্ডোদের বিভিন্ন সেক্টরে পাঠানো হতো তখন তারা ওই সেক্টরের অধীনেই কাজ করতেন। অপারেশন শেষে আবার ১০ নম্বর সেক্টরের অধীনে চলে আসতেন তারা। নৌকমান্ডো ট্রেনিং শেষেই অপারেশন জ্যাকপটের পরিকল্পনা করা হয়। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরসহ দাউদকান্দি ফেরিঘাটে নৌ-অ্যাটাকের পরিকল্পনা এটি। ১৬০ জন নৌকমান্ডোকে কয়েকটি দলে ভাগ করা হয় প্রথমে। যেমন চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর অ্যাটাকের জন্য সাবমেরিনার আবদুল ওয়াহিদের নেতৃত্বে ৬০ জন নৌকমান্ডো, মোংলা বন্দরের জন্য সাবমেরিনার আহসান উল্লাহর নেতৃত্বে ৬০ জন, চাঁদপুর নদীবন্দরের জন্য সাবমেরিনার বদিউল আলমের নেতৃত্বে ২০ জন এবং নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরসহ দাউদকান্দি ফেরিঘাটের জন্য সাবমেরিনার আবিদুর রহমানের নেতৃত্বে ২০ জন নৌকমান্ডোকে পাঠানো হয়। মতিউর রহমান ছিলেন নারায়ণগঞ্জের গ্রুপটিতে।
অপারেশন জ্যাকপট অ্যাটাকটি কীভাবে করলেন?
বীর-প্রতীক মতিউরের ভাষায়, ‘ট্রেনিংয়ের পর আমাদের পাঠানো হয় আগরতলায়, নিউ ট্রানজিট ক্যাম্পে। সেখানে প্রত্যেককে দেওয়া হয় একটি লিমপেট মাইন, ফিন্স, সুইমিং কস্টিউম, নাইফ, কাঁধে ঝোলানোর চটের ব্যাগ, কিছু কাপড়-চোপড়, বন্দরের ম্যাপ এবং জোয়ার-ভাটার চার্ট প্রভৃতি। প্রত্যেক গ্রুপকে একটি রেডিও দেয়। নারায়ণগঞ্জের গ্রুপে সাবমেরিনার আবিদুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা ছিলাম বিশজন। বর্ডার পার হলে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা পথ দেখিয়ে নিরাপত্তা দিয়ে আমাদের গন্তব্যে নিয়ে আসে। নারায়ণগঞ্জে মুসার চরে আমরা আত্মগোপন করে থাকি। নদীবন্দর থেকে সেটি ছিল প্রায় এক মাইল দূরে। লিমপ্যাট মাইন গামছা দিয়ে বুকে বেঁধে জাহাজে লাগাতে হবে, বড় জাহাজে তিনটা আর ছোট হলে দুইটা মাইনেই চলবে, ডুব দিয়ে আগে দেখতে হবে জাহাজের গায়ে শ্যাওলা আছে কি না, থাকলে জায়গাটা পরিষ্কার করে মাইন ফিট করতে হবে, নোঙর করা আর্মস ও গোলাবারুদপূর্ণ পাকিস্তানি জাহাজই টার্গেট, বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দ্রুত ফিরে যেতে হবে ট্রানজিট ক্যাম্পে এমন নির্দেশনাই দেওয়া ছিল অপারেশন জ্যাকপটের নৌকমান্ডোদের। আরও নির্দেশ ছিল ভারত থেকে সিগন্যাল আসবে রেডিওতে গানের মাধ্যমে। নির্ধারিত প্রথম গানটি বাজে ১৯৭১ সালের ১৩ আগস্ট সকালে। আমরা তখন রেকি করতে বেরোই। আদমজী জুটমিলের মসজিদের উঁচু মিনারে উঠে বন্দরে আর্মিদের পজিশন, জাহাজের পজিশন দেখে কমান্ডারকে গিয়ে বলি। রেডিওতে প্রথম গানটি শোনানোর ২৪ ঘণ্টা পর দ্বিতীয় গানটি বাজবে এবং ওইদিন রাতেই আক্রমণ করতে হবে। এমনটাই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু দ্বিতীয় গানটি শোনানো হয় একদিন পর অর্থাৎ ১৫ আগস্টের সকালে। ফলে ওইদিন রাতেই নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরে অপারেশনের প্রস্তুতি নিই আমরা। আবিদুর রহমানের নেতৃত্বে অপারেশনে আমি ছাড়াও অংশ নেন আবদুর রহিম, হেদায়েত উল্লাহ, আজহার হোসেন, আনোয়ার হোসেন, হাবিবুল হক, মাহবুব আহমেদ মিলন, জি এম আইয়ুব, আবদুল মালেক, আবদুল জলিল, ফজলুল হক ভূঞা প্রমুখ। আমার কাজ ছিল এক্সপ্লোসিভ দিয়ে নদীবন্দরের টার্মিনাল উড়িয়ে দেওয়া। যাতে অন্য কোনো জাহাজ ভিড়তে না পারে। এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে দ্রুত সরে আসি। সঙ্গের তিনজন একটি পাকিস্তানি মালবাহী জাহাজের গায়ে মাইন ফিট করে চলে আসে। নির্ধারিত সময় পর জাহাজ ও টার্মিনালে বিস্ফোরণ ঘটে। পাকিস্তানি আর্মিরা তখন এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। দূর থেকে আমরা বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনি। অন্যরকম আনন্দ লেগেছিল তখন। এরপরই দ্রুত ফিরে যাই আগরতলায়, নিউ ট্রানজিট ক্যাম্পে। অপারেশন জ্যাকপটের পর আমাদের দ্বিতীয় অপারেশন ছিল কাঁচপুর ফেরিঘাটে জাহাজ ও ফেরি ডুবিয়ে দেওয়া। সেটিতেও সফল হই।
তৃতীয় নৌ-অ্যাটাক করি কলাগাইছায়, পাকিস্তানি জাহাজে।’
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মনে করেন নতুন প্রজন্মকে খেলাধুলার প্রতি উৎসাহিত ও নিয়োজিত করা প্রয়োজন। বড় কিছু করতে হলে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে। প্রজন্মের উদ্দেশেই নৌকমান্ডো মো. মতিউর রহমান (বীরপ্রতীক) বললেন শেষ কথাগুলো। তার ভাষায় ‘মুক্তিযোদ্ধারা ঘরে বসে থাকলে কি দেশ স্বাধীন হতো? মরার চিন্তায় যদি যুদ্ধে না যেতাম তাহলে কি স্বাধীনতা আসত? তোমরাও স্বপ্নটাকে বড় করো। অলস হইও না, সব সময় চেষ্টা করে যাও। দেশের ও নিজের জন্য কাজ করো। কাজই তোমাকে এগিয়ে নিবে।’
লেখাটি প্রকাশিত দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১৪ অক্টোবর ২০২১
© 2021, https:.