মুক্তিযুদ্ধ

রক্তের মানচিত্রের বিজয় ইতিহাস

গৌরব ও বেদনার একাত্তরে বাংলার জমিনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাভূত করেছিলেন আমাদেরই বীর সন্তানরা। যুদ্ধ করেই স্বাধীনতা এনেছেন তারা। শহীদ ও যুদ্ধাহতদের রক্ত দিয়ে স্বাধীন দেশের মানচিত্র হয়েছে। তাই আমাদের মানচিত্র রক্তের মানচিত্র, ৩০ লাখ শহীদের মানচিত্র, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত মানচিত্র। এটা ভেবেই পরম তৃপ্তি অনুভব করি আমরা। তাই এটা জরুরি যে, জাতির বীর সন্তানদের বিজয় ও বীরত্বের কাহিনীসহ তাদের স্বপ্নের কথাগুলো জানা ও ছড়িয়ে দেওয়া।

একাত্তরে প্রাদেশিক ইলেকশন কমিশন অফিস উড়িয়ে দেন ঢাকার গেরিলারা। দুর্ধর্ষ ওই অপারেশনটির কথা শুনি বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হক নান্টুর মুখে। ‘খোকা’ গ্রুপে গেরিলা ছিলেন তিনি। তার ভাষায়‘প্রাদেশিক ইলেকশন কমিশন অফিস তখন ছিল মোমিনবাগে, রাজারবাগের উল্টো পাশে, দুটো ভাড়াবাড়িতে। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচিত ‘এমপিএ’ আর ‘এমএনএ’ সদস্যরা স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষ নিয়ে চলে গেছেন মুক্তাঞ্চল ও ভারতে। এ সময় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ফন্দি আঁটে। নির্বাচিত ওই সব ‘এমএনএ’ ও ‘এমপিএ’-দের পদ শূন্য ঘোষণা করে আসনগুলোতে উপনির্বাচনের গোপন প্রস্তুতি নিতে থাকে তারা। এ খবর জেনে যাই আমরা। ফলে ইলেকশন কমিশন অফিসটি উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করি।

সাদেক হোসেন খোকার নেতৃত্বে ওই অপারেশনে আমি ছাড়াও অংশ নেয় লস্কর, সুফি আর হেদায়েত। সময়টা ১ নভেম্বর ১৯৭১। রোজার মাস ছিল। তারাবির নামাজ চলছে। রাস্তাঘাট সব ফাঁকা। ওই সময়েই বিল্ডিংয়ে ঢুকে ১২ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ ফিট করে বিস্ফোরণ ঘটাই। গোটা ঢাকা শহর তখন কেঁপে ওঠে। বিল্ডিংয়ের এক পাশ ধসে পড়ে। আগুনে পুড়ে ছাই হয় অফিসের সব কাগজপত্র। ওই অপারেশনটির খবর ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ব গণমাধ্যমে।

বিজয়ের ৫০ বছরে এই গেরিলার কাছে প্রশ্ন ছিলকেমন বাংলাদেশ চান?

তিনি বলেন, ‘ভালো বাংলাদেশ চাই। পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো বাংলাদেশ চাই।’ পরবর্তী প্রজন্মের  উদ্দেশে তিনি শুধু বলেন ‘মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ও বীরত্বের কাহিনী তোমরা জেনে নিয়ো। মনে রেখো, একাত্তরের ইতিহাসই তোমাদের পথ দেখাবে।’

বিজয় নিয়ে কথা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা সাব-সেক্টর কমান্ডার মাহফুজ আলম বেগের সঙ্গেও। নয় নম্বর সেক্টরের শমশেরনগর সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন তিনি। স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন একাত্তরের কথা।

‘১১-১৪ বছর বয়সীদের নিয়ে একটা গ্রুপও করেছিলাম তখন। সাতক্ষীরা, খুলনা ও বরিশালের কিশোররা ছিল চল্লিশজনের মতো। গ্রুপটির নাম দিই ‘হার্ড কর্পস অব সার্জেন্টস’। আসলে ওরা ‘বিচ্ছুবাহিনী’। গল্প করে, মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কথা বলে পাকিস্তানি সেনাদের বিশ্বস্ততা অর্জন করত ওরা। পরে আর্মি ক্যাম্পে ঢুকে ওদের ঠ্যাং টিপে ফিরে এসে বয়ান করত ক্যাম্পের কোথায় কী আছে। ঝুঁকি ছিল অনেক। যেখানে ট্রেইন্ড মুক্তিযোদ্ধারাও যেতে চাইত না, সেখানে ওরা বলত স্যার আমি যাব।’

‘বরিশালের দোয়ারিকায় পাকিস্তানি সেনাদের একটা ক্যাম্প ছিল। পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন কাহারের নেতৃত্বে সেখানে ছিল বেলুচ রেজিমেন্টের একটা কোম্পানি। আমাদের পুরো ব্যাটালিয়ান ঘিরে ফেলে ওদের। কিন্তু পাকিস্তান আর্মির সদস্যরা ছাড়া ওরা সারেন্ডার করবে না। ফলে তারা অস্ত্র ফেলে আমার নিয়ন্ত্রণে থাকে। দোয়ারিকা থেকে তাদের নিয়ে আসা হয় ওয়াবদায়। পাকিস্তান আর্মি মাথা নিচু করে ওয়াবদার দিকে মার্চ করছে। আর অস্ত্র উঁচিয়ে তাদের নিয়ে যাচ্ছে ছেঁড়া শার্ট আর ছেঁড়া লুঙ্গি পরা মুক্তিযোদ্ধারা। এই দৃশ্যটা কখনো ভুলতে পারব না।’

নয় মাসে দেশ স্বাধীন হওয়ার অন্তর্নিহিত কারণ তুলে ধরেন এই সূর্যসন্তান। অকপটে বলেন, ‘স্লোগান দিয়েই তো আমরা দেশ জয় করেছি। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানই ছিল সবচেয়ে বড় অস্ত্র। প্রথম দিকে সবাই ছিল আইডিওলজিক্যাল ফ্রিডম ফাইটার। যারা মন দিয়ে বিশ্বাস করত বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। পাকিস্তানিরা আসছে অন্যের দেশে। জোর করে একটা যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে মাতবরি করতে আসছে তারা। এখানে আমরাই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। প্রতিটি মুুক্তিযোদ্ধার বুকে তখন একটাই আগুন ছিল মাতৃভূমিকে মুক্ত করা। পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও শুনেছেন ৯০ হাজার ওয়েল ইকুয়েপড সেনা সারেন্ডার করেছে। একমাত্র যদি তারা কাপুরুষ না হয়। সারেন্ডার করতে বাধ্য হয়েছিল পাকিস্তান সেনারা। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যই এটা হয়েছে।’

একাত্তরের বীরত্বের ইতিহাস নিয়ে কথা বলেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা কনস্টেবল মোহাম্মদ আবু শামা। ইস্ট পাকিস্তান পুলিশের কনস্টেবল ছিলেন তিনি। ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন এই যোদ্ধা। পরে ভারতের আগরতলায় নাইনটিওয়ান বিএসএফ শালবন থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে তিনি তিন নম্বর সেক্টরে অপারেশন করেন।

তার ভাষায়, ‘অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে একটা গোপন মিটিং হয় আমাদের, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের খইকুড়ি নামক জায়গায়। সিদ্ধান্ত হয় কুলিয়ারচরের মুক্তিযোদ্ধারা বকতারপাড়া রেলওয়ে ব্রিজটা ভেঙে দেবে। আর আমরা বগামারা রেল ব্রিজ উড়াব। ভৈরব আর কিশোরগঞ্জ থেকে পাকিস্তানি আর্মিরা যেন সাহায্য করতে আসতে না পারে এ কারণেই এমন পরিকল্পনা হয়। কুলিয়ারচরের মুক্তিযোদ্ধা জিল্লু, মঞ্জু ভাইসহ একটি গ্রুপ বকতারপাড়া রেলওয়ে ব্রিজটা ভেঙে দেয়। বগামারা ব্রিজটা উড়িয়ে দিই আমরা। এতে যোগাযোগ হয় বিচ্ছিন্ন। ফলে বাজিতপুর ও সরারচরের আর্মি ও রাজাকারদের জন্য সমস্যা হয়ে যায়। অক্টোবরের বিশ তারিখের পর সরারচর ও বাজিতপুরে ‘এট-এ-টাইম’ আক্রমণ করে শত্রুমুক্ত করার জন্য অ্যাটাক করি। আমাদের গ্রুপটি বাজিতপুর আর আরেকটি গ্রুপ সরারচর আক্রমণ করে। আক্রমণটা হয় ভোর রাতে। বাজিতপুরের বাশমল নামক জায়গায় ছিল পাক আর্মিরা। আর থানায় ছিল পাকিস্তানি মিলিশিয়া ফোর্স আর রাজাকার। সব মিলিয়ে ওরা সত্তর বা ছিয়াত্তর জন। অপারেশনে ওরা সবাই মারা পড়ে। আমি বুকে গুলিবিদ্ধ হই। ওই অপারেশনেই বাজিতপুর শত্রুমুক্ত হয়। স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিতে পেরেছি এটা ভেবেই তৃপ্ত হই। কোনো আফসোস নাই। শুধু চাই স্বাধীন দেশটা ভালো থাকুক।’

৫০ বছরে স্বপ্নের দেশ পেয়েছেন কি না এমন প্রশ্নে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু শামা অকপটে বলেন‘আমরা যা আশা করছিলাম। দেশটা ওই পথেই আছে। জাতির জনক চেয়েছিলেন সোনার বাংলা। এদেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের মুখে হাসি দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। ওই স্বপ্নকেই বাস্তবায়ন করতে হবে।’

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সিদ্ধার্থ শংকর রায়কে বলেছিলেন, ‘আমি বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার একটা বীজ পুঁতে রেখে গেলাম। এই বীজ যেদিন উৎপাটন করা হবে, সেদিন বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে যাবে।’ আমরা কি তাহলে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নের পথে এগোচ্ছি?

একাত্তরে সাধারণ মানুষ, আদিবাসীসহ সব ধর্মের লোক এক হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য। মুক্তিযোদ্ধারাও চেয়েছিলেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। কিন্তু এখন তা ধর্মান্ধতার দিকে এগোচ্ছে বলে মনে করেন অনেকেই। কেননা জাতির জনকের ভাস্কর্য ভাঙার মতো ঘটনাও ঘটেছে এ সময়ে। থেমে নেই হিন্দু বাড়িতে হামলা, প্রতিমা ভাঙা, ভাস্কর্য ভাঙার ঘটনাও। এ বিষয়ে সরকারকে জিরো টলারেন্স দেখনো উচিত বলে মনে করেন মুক্তিযোদ্ধারা।

বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছর উদযাপন করছি আমরা। অথচ এ সময় পর্যন্ত একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি পাকিস্তান। বরং তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এখনো ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। পারেনি একাত্তরে পরাজয়ের গ্লানি ভুলতেও। পাকিস্তানের পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভুল তথ্য উপস্থাপন করে তারা তাদের নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের জন্ম নিয়ে ভুল বার্তা দিচ্ছে এখনো। যা আরেক নির্লজ্জতার প্রতিফলন। তাই বিজয়ের এ সময়ে একাত্তরে গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে পাকিস্তানকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগই হতে পারে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। তবেই আমাদের রক্তের মানচিত্রে রচিত হবে আরেক বিজয়ের ইতিহাস।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১৬ ডিসেম্বর ২০২১

© 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button