যশোরের রাজনৈতিক অবস্থা তখন অন্যরকম ছিল। বাম রাজনীতির চর্চা ছিল বেশি। পাড়ায় থাকতেন আহমেদ আলী সরদার, শওকত আলী ও অ্যাডভোকেট আবদুল রাজ্জাক। কমরেড আবদুল হক, অ্যাডভোকেট মশিউর রহমান, অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন, অ্যাডভোকেট এনামুল হক, ডা. রবিউল ইসলাম প্রমুখের সান্নিধ্য পেয়েছি। ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপ ছিল বেশ তৎপর। সমাজের মানুষকে সচেতন করার ক্ষেত্রে তাদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। সব মিলিয়ে যশোরের অধিকাংশ মানুষই ছিলেন রাজনীতি-সচেতন। ৭ মার্চের ভাষণ আমরা শুনি রেডিওতে। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। আমাদের জন্য ওটাই ছিল সবচেয়ে বড় নির্দেশনা।
২৫ মার্চ ১৯৭১। সারা দেশে শুরু হয় গণহত্যা। রাতেই পরিবার নিয়ে চলে যাই গ্রামে, যশোর শহর থেকে ৪-৫ মাইল ভেতরে। পরে চাচির মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ২৬ মার্চ সকালে আবার আসি যশোর শহরে। ওইদিনই আমার সামনে অ্যাডভোকেট মইনুদ্দিন আহম্মেদ নিয়াজিকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি আর্মিরা। সত্তরের নির্বাচনে তিনি এমএনএ নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর পরই যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি সেনাদের ঘেরাও করে রাখে সাধারণ জনতা। সবার হাতে লাঠি, দা, কুড়ালসহ নানা অস্ত্র। নেতৃত্বে ছিলেন পালিয়ে আসা বাঙালি আর্মি, ইপিআর ও পুলিশরা। পাঁচবাড়ি মোড় থেকে ক্যান্টনমেন্টের রাস্তা, পুরোটাই মানুষ অবরুদ্ধ করে রাখে। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যদের তোপের মুখে তারা টিকতে পারেনি। এপ্রিলের ১ বা ২ তারিখে চাঁচড়া মোড়ে পাওয়ার হাউজ নামক জায়গায় জড়ো হয় প্রায় ১০-১২ হাজার লোক। সবাই ‘জয় বাংলা’ সেøাগান তুলছে। সন্ধ্যা হয় হয়। খুলনা থেকে আসা পাকিস্তানি আর্মিদের গাড়ি দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল। ওরা এসে ঢুকবে যশোর ক্যান্টনমেন্টে। সবাই ভেবেছে বাঙালি আর্মি। কিন্তু মুখোমুখি হতেই ঘটল অঘটন। তারা ফায়ার ওপেন করে দিল। ফলে পাখির মতো মারা পড়ে প্রায় বহু সাধারণ মানুষ। পথে পথে ছিল লাশ আর লাশ। যে যার মতো পালাতে থাকল। আমি তখন চলে যাই ঘুটে গ্রামে, পরিবারের কাছে। একাত্তরের কথা এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আবদুল লতিফ। তার বাড়ি যশোরের সদর উপজেলার চাঁচড়া রেলগেট নামক স্থানে। বাবা মোহাম্মদ মোকসেদ আলী ও মা রাহেলা বেগম।
পাকিস্তানি সেনারা যশোর শহরের নিকটবর্তী গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। পরিবারসহ লতিফরা তখন চলে আসেন মণিরামপুর থানার ভোজঘাটি গ্রামে। সেখানে মা-বোনকে রেখেই তিনি ঘর ছাড়েন। পণ ছিল, মরতে হয়, লড়াই করেই মরবেন। পায়ে হেঁটে হাসনাবাগ ও কালীগঞ্জ হয়ে প্রথমে চলে আসেন ভারতের হিঙ্গলগঞ্জ। পরে বশিরহাট হয়ে পৌঁছান বনগাঁয়, চাপাবাড়িয়া ইয়ুথ ক্যাম্পে। শাহ হাদিউজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মুখার্জি ছিলেন এর দায়িত্বে। সেখান থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিহার প্রদেশের সিংভূম জেলার চাকুলিয়া ক্যান্টনমেন্টে। আবদুল লতিফ বলেন, ‘পাঁচ সপ্তাহের সেই ট্রেনিং ছিল খুবই কষ্টের। পাহাড়ের ওপর তাঁবু টাঙিয়ে থাকতে হতো। ওই সময় দুই সঙ্গীকে সাপে কেটে মেরে ফেলে। খুব ভয় হতো তখন। কিন্তু দেশের চিন্তায় ভয়ও জয় হয়ে যায়। ট্রেনিংয়ে শেখানো হয় রাইফেল, এসএলআর, এলএমজি, টুইনস মর্টার, গ্রেনেড থ্রোইং প্রভৃতি। সাতদিনের ট্রেনিং হয় এক্সপ্লোসিভের ওপর। ট্রেনিং ক্যাম্পে আসেন আতাউল গনি ওসমানী ও অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ। লতিফের এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর ছিল-৪৭৬১৯। ট্রেনিং শেষে তাদের আনা হয় কল্যাণীতে। গ্রুপ করে দুইশ জনকে পাঠানো হয় অ্যাকশন ক্যাম্পে। পরবর্তী সময়ে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় আট নম্বর সেক্টরের বয়রা সাব-সেক্টরে। সেখানকার কমান্ডার ছিলেন কাজী নাজমুল হুদা। তিনি একদিন বললেন, ‘ছাত্র যারা আছ, তারা গেরিলা অপারেশন করবে।’ আলাউদ্দিন, কোরবান ও লতিফসহ বাছাই করা যোদ্ধাদের নিয়ে গঠন করা হয় দশজনের একটি গেরিলা দল। কমান্ডে লতিফ নিজেই। তারা অপারেশন করেন চুরামনকাঠি রেলস্টেশনে (বর্তমানে মুন্সি মেহেরউল্লাহ স্টেশন), হালশা, ছুটিপুর, কায়েমখোলা, শাহবাজপুরসহ যশোরের বিভিন্ন এলাকায়।
গেরিলাদের কাজ কী ছিল?
মুচকি হেসে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফের উত্তর : ‘আমরা দেশের ভেতরে আত্মগোপন করে থাকতাম। রেললাইন, কালভার্ট, গ্রিডলাইনের পিলার উড়িয়ে দিতাম। পাকিস্তানি সেনারা যেন নির্বিঘেœ চলতে না পারে সেদিকে নজর থাকত। তাদের ভয়-ভীতি দেখানোই ছিল গেরিলাদের কাজ। আক্রমণ করেই মানুষের সঙ্গে মিশে যেতাম। এক্সপ্লোসিভের বড় কোনো ঘটনা ঘটাতে ডাক পড়ত আমার।’
একাত্তরে এক অপারেশনে বাম পা হারান মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফ। কীভাবে? তার ভাষায়, ‘৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। সকাল তখন ১১টা হবে। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী সম্মিলিতভাবে দখল করে নিচ্ছিল যশোর শহর। তুমুল গোলাগুলি চলছে। ভারতীয় বিমান হামলার জবাবে পাকিস্তানি সেনারা শেলিং করছে অবিরত। চারপাশে আগুন আর আগুন। আমরা ছিলাম শংকরপুর এলাকায়। রাজারহাটের দিকে অগ্রসর হব। হঠাৎ শত শত শেল এসে পরে আশপাশে। নিজেকে বাঁচাতে সবাই ছত্রভঙ্গ হই। পাঁচজন ছিলাম একসঙ্গে। দেখলাম বঙ্কিম আর কাউসারের নিথর দেহ মাটিতে পড়ে আছে। শেলিংয়ের শব্দ হতেই একটি বাংকারের ভেতর আমি আশ্রয় নিতে লাফ দিই। মাথাসহ শরীরের অর্ধেক বাংকারের ভেতরে পৌঁছালেও পা দুটি থেকে যায় বাইরে। সে সময়ই শত শত স্পিøন্টার বিদ্ধ হয় দুই পায়ে। সারা শরীর জ্বলতে শুরু করে। চারপাশে সহযোদ্ধাদের লাশ। ভেবেছিলাম আমিও মরে যাব। প্রচন্ড পিপাসা পাচ্ছিল। মায়ের মুখখানা চোখে ভাসছিল বারবার। বাংকারের পাশেই ছিল কচুরিপানা ভর্তি একটি পুকুর। সেখানে পানি খেতে গিয়েই মাটিতে পড়ে যাই। এরপর আর কিছুই মনে নেই।
জ্ঞান ফেরে পরদিন সকালে। তখন আমি যশোরের ফাতেমা ক্যাথলিক হসপিটালে। স্পিøন্টারের আঘাতে আমার দু’পা হয় ক্ষতবিক্ষত। বাম পায়ের হাড় ভেঙে যাওয়াতে তা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়েছে। অন্য পায়ের অনেক জায়গাতেই মাংস নেই। আমরা রক্তাক্ত হলেও ওইদিনই যশোর শহর হানাদারমুক্ত হয়েছিল। এখনো পায়ের দিকে তাকালে সবকিছু জীবন্ত হয়ে ওঠে। তবুও আফসোস নেই। বরং আমি গর্বিত। আমার ত্যাগ উৎসর্গ করে দিয়েছি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।’ স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালোলাগার অনভূতি জানতে চাই আমরা। এই বীর বলেন : ‘ভালো লাগে স্বাধীন দেশে রেললাইনের ধার দিয়ে শিশুদের যখন বই হাতে বাড়ি ফিরতে দেখি; যখন শুনি এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বিদেশে নানা কাজে আমাদের পতাকার সম্মান বাড়িয়েছে; জেলায় জেলায় মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তরুণদের আগ্রহ দেখলে সত্যি আনন্দে মন ভরে যায়।’ এ দেশ একদিন অনেক উন্নত হবে। তবে তার কা-ারি হতে হবে পরবর্তী প্রজন্মকে। তাই তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন : ‘মেধায়, বুদ্ধিতে, সততায় আর দেশপ্রেমে তোমরা উজ্জীবিত হয়ো। দুর্নীতি ও সাম্প্রদায়িক চিন্তাকে প্রশয় দিয়ো না। মনে রেখ, সবার ওপরে দেশ। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের দেশ তোমাদেরই গড়তে হবে।’ আব্দুল লতিফের মতো মুক্তিযোদ্ধারা পৌরাণিক কোনো চরিত্র নয়, বাঙালি বীর। তাদের রক্ত, ঘাম, ত্যাগে সৃষ্ট বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। তাই মুক্তিযুদ্ধে বীরদের এমন গৌরবগাথা আমাদের আলোড়িত করবে অনন্তকাল।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৯ ডিসেম্বর ২০২১
© 2021, https:.