২৫ মার্চ ১৯৭১। রাত তখন ৯ টা। জহরুল হক হলের মাঠ থেকে ট্রেনিং শেষে ফিরেছি বাসায়। পেটে প্রচণ্ড ক্ষিদে। মা খাইয়ে দিচ্ছিলেন। হঠাৎ নাম ধরে ডাকতে থাকে বন্ধু জিন্না, কাইয়ুম, নয়নসহ অনেকেই। খাবার ফেলেই বেরিয়ে পড়ি তখন।জহরুল হক হলের পাশে ছিল লন টেনিস খেলার মাঠ। সেখানে অপেক্ষায় ছিলেন তোফায়েল আহমেদ, রাজ্জাক ভাই, চার নেতাসহ আরও কয়েকজন। তাদের মুখে শুনলাম দেশের সর্বশেষ অবস্থার কথা। নির্দেশ দিলেন গাছ কেটে রাস্তায় ব্যারিকেড ফেলে প্রতিরোধ গড়ার।
আজিমপুর মোড়ের দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসে আওয়ামী লীগের কর্মীরা। রাত তখন সোয়া বারোটা। বর্তমান বিজিবি গেইটের দিক থেকে গুলির শব্দ পাই। ক্রমেই তা এগিয়ে আসে। পাকিস্তানি আর্মিরা আজিমপুর কবরস্থান পার হয়ে এসেই বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়ে। সে সময় রহমান নামে আমাদের এক কর্মী গুলিবিদ্ধ হন। আমি ও বাচ্চু ভাই তাকে এক বাড়িতে রেখে আত্মগোপন করি আজিমপুর কলোনিতে। ভোর হতেই ফিরে আসি পলাশীর নিজ বাড়িতে।
২৮ মার্চ ১৯৭১। কারফিউ ভাঙ্গে দুই ঘন্টার জন্য। সে-সুযোগে সপরিবারে চলে আসি জিনজিরার আঁটি এলাকায়। করম আলী চাচার বাড়ি ওখানে। বাবার সঙ্গেই চাকরি করতেন তিনি। সেখানে কয়েকদিন থাকার পর চলে যাই ঢাকার সৈয়দপুরে, এক দারোগার বাড়িতে। তিন-চার দিন থাকার পর নৌকা ভাড়া করে রওনা হই গ্রামের বাড়ি, সিলেটের বিয়ানীবাজারের দিকে। রাস্তায় রাস্তায় নানা বাঁধা পেরিয়ে আমরা গ্রামে পৌঁছি।
একাত্তরের ২৫ মার্চের ঘটনাগুলো এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নাজির আহমদ চৌধুরী। তার বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার চারাবই গ্রামে। বাবা আবদুল গাফফার চৌধুরী ছিলেন সরকারি চাকুরে। কাজ করতেন পূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে ইডেন বিল্ডিং ডিভিশনে। মা আনোয়ারা চৌধুরী ছিলেন গৃহিণী। চার ভাই ও চার বোনের সংসারে তিনি সবার বড়। বাবার চাকরির সুবাদেই পরিবার চলে আসে ঢাকাতে। আজিমপুরের পলাশীতেই নাজির আহমদ চৌধুরীর জন্ম।
লেখাপড়ায় হাতেখড়ি পলাশী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং পরে নবকুমার ইনস্টিটিউশনে (বর্তমান শহীদুল্লাহ কলেজ)। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন এসএসসি পরীক্ষার্থী। ছাত্র বয়সেই যুক্ত ছিলেন ছাত্রলীগের সঙ্গে। স্কুল কমিটির প্রচার সম্পাদক ছিলেন।সেসময় ছাত্ররা দেশটাকে ভালোবেসেই রাজনীতিতে যুক্ত থাকত। বড়দের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ ছিল অনেক। নাজির জানালেন তেমনি একটি স্মরণীয় ঘটনার কথা। তার ভাষায়, ‘গোলাম রব্বানী ফকরু, খোকন, বাবুল প্রমুখরা একসাথে বড় হয়েছি। ক্রিকেট ও ফুটবল খেলতাম বুয়েটের মাঠে। ক্লাস এইটে থাকতেই সিগারেট খাওয়া শিখি। বুয়েটের সোহরাওয়ার্দী হল তখন মাত্র একতলা উঠছে। চারপাশ ঘের দিয়ে কাজ চলছে। বড়দের যাতায়াত না থাকায় ওখানেই লুকিয়ে সিগারেট খেতাম।
একদিন একা ওখানে ঢুকে সিগারেট ধরিয়েছি, অমনি এসে কানে ধরেন দারোয়ান কাকা। আমার হাত-পা তখন কাঁপছিল। তিনি বাসার ঠিকানা জানতে চাইলেন। আমি ভয়ে তার পা জড়িয়ে ধরি। শাস্তিস্বরূপ কান ধরে প্রতিজ্ঞা করি, ‘কোনোদিন আর সিগারেট খাব না।’ তখন দোকানদাররা ওই বয়সীদের কাছে সিগারেট বিক্রি করত না। এখন তো সবই সম্ভব। সবার সামনে সিগারেট খাওয়াকে ছাত্ররা কোনো বিষয়ই মনে করে না। অথচ এটা আমরা চিন্তাও করতে পারতাম না।‘
দেশের প্রতি বৈষম্যের কথাগুলো নাজির আহমদরা শুনতেন ছাত্রনেতাদের মুখে। ওইসময় জহুরুল হক হলে মিটিং করতেন আবদুল কুদ্দুস মাখন, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী, রাফিয়া আক্তার ডলি, মতিয়া চৌধুরী প্রমুখ। পূর্ব পাকিস্তানে পেপার তৈরি হয়ে চলে যেত পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে কাগজের বান্ডেলে সিল পড়ত মেড ইন পাকিস্তান, করাচি, পিণ্ডি, পেশোয়ার। সেই কাগজই আমাদের বেশি দামে কিনতে হতো।
ঊনসত্তরের আন্দোলন সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন নাজির। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে তিনি কাজ করেন পলাশী এলাকায়। ৭ মার্চে পলাশী থেকে মিছিল নিয়ে তিনিও যান রেসকোর্স ময়দানে। মঞ্চ থেকে মাত্র দুশো গজ দূরে বসে শোনেন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি। তার ভাষায়: ‘সেদিনকার ফিলিংস বোঝাতে পারব না। স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ আসতে থাকে। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাছারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।…যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে– খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়া হলো। কেউ দেবে না।’ এই নির্দেশ কিন্তু পরে সবাই পালন করলেন। তিনি বললেন, ‘মনে রাখবা– রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ! এরপর স্বাধীনতার ঘোষণার আর কিইবা বাকি থাকে?
ভাষণ শোনার পর আপনারা কী করলেন?
নাজির আহমদ বলেন, ‘এর আগেই আমরা সংগ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ফেব্রুয়ারির শেষ দিক থেকেই বিকেলে বুয়েট মাঠে লেফট-রাইট এবং সন্ধ্যার পর জহুরুল হক হলের মাঠে ডামি রাইফেল দিয়ে আমাদের টেনিং দেওয়া হতো। সেটি চলে ২৫ মার্চ পর্যন্ত। ট্রেনিং করাতেন চিশতি ভাই। ২ মার্চ বটতলায় পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানেও আমরা গার্ড অব অনার দিই।
বঙ্গবন্ধুকে দূর থেকে দেখলেও নাজির খুব কাছ থেকে দেখেন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারিখে। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। আজও সেটি মনে রেখেছেন তিনি। তার ভাষায়: “শেখ জামাল ভাইয়ের কাছে আমাদের যাওয়া-আসা ছিল। তিনি তুই বলে সম্বোধন করতেন। ওইদিন সকাল ১০টায় গোলাম রব্বানী ফকরু, জিন্না, খোকন প্রমুখের সঙ্গে যাই বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। আমি বসি বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে। দেশ তখন উত্তপ্ত। সেসময় আজিমপুর বেবি আইসক্রিম এলাকা থেকে আসে একটি মিছিল। তাদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজকের পর কি হবে বলতে পারি না। তবে তোমরা প্রস্তুত থেকো।’ রাতেই শুনলাম বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হয়েছেন।”
গ্রামে ফিরে কী করলেন?
তিনি বলেন, ‘ভারত থেকে আসা কুশিয়ারা নদীটি বিয়ানীবাজারকে ভাগ করেছে। নদীর তীরে বসে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পরিকল্পনা করি আমরা কয়েকজন। কিন্তু সীমান্ত পার হতে লাগবে কিছু টাকাপয়সা। টাকা পাই কোথায়? চাচাতো ভাই আতাউর রহমান পঙ্খিসহ ধান চুরির বুদ্ধি করি। একরাতে কয়েক মন ধান চুরি করে বিক্রি করি হাটে। যা পাই তা নিয়ে ওইদিনই রওনা হই ভারতের উদ্দেশে।
৯ মে ১৯৭১। সুতারকান্দি বর্ডার পাড় হয়ে আমরা পৌঁছি ভারতের করিমগঞ্জ ট্রানজিট ক্যাম্পে। সেখান থেকে আসি কলকলি ইয়ুথ ক্যাম্পে। ক্যাম্পটির ইনচার্জ আব্দুল মুনিম চৌধুরি আর সামরিক ইনচার্জ ছিলেন মেজর ফাত্তা চৌধুরী। একদিন পরেই ক্যাম্পে আসেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল বাকসি। ক্যাম্প থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ছেলেদের বাছাই করতেন তিনি।
আমার স্বাস্থ্যটা বেশ খারাপ ছিল। তাই প্রথম ব্যাচে ট্রেনিংয়ের সুযোগ পেলাম না। বাকসি সাহেব বললেন, ‘তুমি যুদ্ধ করতে পারবা না। খেয়ে স্বাস্থ্য বানাও, পরের ব্যাচে তোমাকে নিব।’ শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। তবুও হাল ছাড়লাম না। ক্যাম্পেই থাকলাম। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যাচে বাছাইয়ের সময়ও ঘটল একই ঘটনা। বাকসি সাহেব এবারও বললেন, ‘ইয়ুথ ক্যাম্পের ফিল্ড ইনচার্জ বানিয়ে দিব তোমাকে। তুমি এখানেই থাকো।’ এবার আমি ক্ষেপে গেলাম। বললাম, ‘এখানে বসে বসে খেতে আসিনি। গুলি ফোটাতে এসেছি। আমি তাইলে দেশে ফিরে যাই। মরতে হয় দেশে গিয়ে পাকিস্তানিদের হাতেই মরমু।’
তৎকালীন এমপিএ ছিলেন দেওয়ান ফরিদ গাজী সাহেব। উনি উপস্থিত ছিলেন। আমার পক্ষে তিনি সুপারিশ করতেই নিয়ে নিলো। এরপর পাঠিয়ে দেওয়া হয় আটাশ দিনের ট্রেনিংয়ে।
ট্রেনিং হয় ভারতের লোহারবনে। বি কোম্পানির সিএইচএম ছিলাম আমি। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর: ই-৬৯৬৩। ওস্তাদ মহাদেবের কথা এখনো মনে পড়ে। ট্রেনিং শেষে আমাদের অস্ত্র দেওয়া হয় জালালপুর থেকে। চার নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল সেখানে। কমান্ডার ছিলেন মাহবুবুর রব সাদী এবং কোম্পানি কমান্ডার আশরাফ আলী। প্রথম দিকে গেরিলার অপারেশন করতাম। আক্রমণ করেই সরে পড়াই ছিল নিয়ম। এভাবে অপারেশন করি আটগ্রাম, শাহবাগ, শরতের বাজার প্রভৃতি এলাকায়। শেষের দিকে ভারতীয় সেনাদের সহযোগিতায় আমরাও অংশ নিই সম্মুখযুদ্ধে।’
১৯৭১ সালে আটগ্রাম ডাকবাংলো অপারেশনের সময় পাকিস্তানিদের একটি গুলি নাজির আহমদের ডান চোখের পাতার নিচ দিয়ে ঢুকে নাকের হাড় ভেঙ্গে বাম পাশের গাল দিয়ে বেরিয়ে যায়। ফলে নষ্ট হয়ে যায় তার ডান চোখটি।
সেদিনের ঘটনাটি জানতে চাই আমরা। মুক্তিযোদ্ধা নাজির খানিকটা নীরব থাকেন। মনের ভেতরে জমে থাকা তার কষ্টগুলো যেন বাষ্প হয়ে ওঠে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাটি শুনি তার জবানিতে।
তার ভাষায়, ‘৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। আমরা ছিলাম জালালপুর হেডকোয়ার্টারে। অপারেশনটি নিয়ে সেখানে কয়েকদিন চলে ব্রিফিং। পাকিস্তানি সেনাদের একটি ডিফেন্স ছিল জকিগঞ্জের আটগ্রাম ডাকবাংলোতে, অন্যটি সড়কের বাজারে। ডাকবাংলো দখলে নিয়েই আমরা আক্রমণ চালাব সড়কের বাজারের ক্যাম্পে– তেমনটাই ছিল পরিকল্পনা।
সুরমা নদীর তীরে ছিল ডাকবাংলোটি। নদীর ওপারেই ভারত। তিনটি গ্রুপে আমরা ছিলাম ৭৬ জন। কমান্ডে আশরাফ ভাই। ভোর তিনটার দিকে ডাকবাংলোর কাছাকাছি অবস্থান নিই। ২৫ জনের একটি দল সুরমা নদীর ভারত অংশে অবস্থান নেয় কাভারিং ফায়ারের জন্য। দূর থেকে ডাকবাংলো ঘিরে অবস্থান নেয় আরও ২৫ জন। অবশিষ্ট ২৬জন অ্যাডভান্স করি। কথা ছিল ৩টা বা ৩টা ৫ মিনিট পর্যন্ত ভারত থেকে ডাকবাংলো লক্ষ্য করে আর্টিলারি ছোড়ার। কিন্তু আর্টিলারির লক্ষ্য সঠিক ছিল না। বেশি দিলে ডিফেন্স নষ্ট হয় আবার কম দিলে আমাদের ওপর পড়ে। সবগুলো আর্টিলারি এসে পড়ে মাঝামাঝিতে। পাকিস্তানি সেনারা তখন অ্যালার্ট হয়ে যায়। আমার কাছে ছিল একটি এসএলআর।
আর্টিলারি বন্ধ হতেই আশরাফ ভাই বললেন, ‘অ্যাডভান্স’। ক্রলিং করে সামনে এগোই। পাকিস্তানি সেনারা আমাদের ওপর বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়ছিল। বোঝার বাকি থাকে না আর্টিলারিতে তাদের ডিফেন্সের কোনো ক্ষতি হয়নি। তবুও আমরা সামনে এগোই। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। গড়িয়ে ধানক্ষেতের আইল ধরে এগোই। ওদের পঞ্চাশ গজ ভেতরে ঢুকে পড়ি। আমার ডান পাশে ছিল হায়দার। হঠাৎ তার পেটে গুলি লাগে। নিমিষে রক্তে লাল হয়ে যায় আইলের পথটি। বামপাশে তাকিয়ে দেখি মাথায় গুলি লেগেছে আরেকজনের। তার নিথর দেহটি পড়ে আছে মাটির ওপর।
আমি ক্রলিং করে হায়দারকে বাঁচাতে যাই। তার অস্ত্রটি নিয়ে তাকে পেছনে টানতে থাকি। হঠাৎ শোঁ করে একটি গুলি এসে লাগে আমার ডান চোখে। মুখটা ধপ করে মাটিতে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আমি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়ি। মুখ তুলতেই খেয়াল করলাম ডান চোখ দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত পড়ছে। আশরাফ ভাই ছিলেন পেছনে। তার থাইয়েও লেগেছে গুলি। ওই অবস্থায়তেই আমাকে তিনি কাঁধে তুলে পেছনে নিয়ে যান।
সুরমা নদীতে নৌকা দিয়ে আমাকে নেওয়া হয় ক্যাম্পে। শরীরটা নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিল। খুব ঠান্ডা লাগছিল। শুধু চিৎকার করছিলাম। পরে ইনজেকশন দিতেই জ্ঞান হারাই। যখন চোখ মেলি তখন আমি গোহাটি সামরিক হাসাপাতালে। সেখান থেকে লক্ষ্ণৌ বেইস হাসপাতালে এবং পরে কম্বাইন্ড হাসপাতালে চোখের অপারেশন করে লিড রিপিয়ার করা হয়। গুলিটি আমার ডান চোখের পাতা ভেদ করে নাকের বোন ভেঙ্গে দেয়। ফলে এক চোখে আর দেখতে পাই না। দেশ স্বাধীনের খবর পাই হাসপাতালে। আনন্দে খুব কেঁদেছিলাম।’
কথা বলতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা নাজিরের চোখ ভিজে যাচ্ছিল বারবার। আমরা তখন নীরব থাকি। একজন বীরের চোখের জল হৃদয়কে স্পর্শ করে।
কথা ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পর পরই এ তালিকা চূড়ান্ত করা দরকার ছিল। তখন ভারতীয় ট্রেনিং ক্যাম্পগুলোতে ছিল সকলের তালিকা। একজন ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফিরে দেখল দেশ স্বাধীন। স্বাধীন না হলে সে তো যুদ্ধ করত। যেহেতু সে ট্রেনিং করেছে। তাই তার নামটি জায়গা করে নেয় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায়। আবার ট্রেনিং নিয়ে এসেও অনেকেই যুদ্ধ না করে বাড়িতে চলে গেছেন, তিনিও আছেন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায়। এগুলো তখনই যাচাই করে চূড়ান্ত করা যেত।’
এত বছর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা কেন বাড়ে?
মুচকি হেসে মুক্তিযোদ্ধা নাজির বলেন, ’রাজনৈতিক কারণে সব সরকারের সময়ই তালিকা বেড়েছে। কিন্তু কোনো মুক্তিযোদ্ধা সুপারিশ না করলে তো আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা হতে পারে না। তাই এর জন্য দায়ী আমরা মুক্তিযোদ্ধারাই। অচিরেই এটা বন্ধ হওয়া উচিত। এখন তো এই তালিকাই আমাদের বিতর্কিত করছে।’
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘এদের বিচার তো স্বাধীনের পর শুরু হয়েছিল। ছোট ছোট অপরাধীদের বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা করেছিলেন সত্য। ১৯৭১-এ অনেকেই জীবন বাঁচাতে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীতে নাম লেখায়। কেউ কেউ গোপনে নানা সংবাদ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করত। তাই তাদের শাস্তি দিলে তো অন্যায় হতো। কিন্তু ক্ষমার তালিকায় ছিল না কাদের মোল্লার মতো রাজাকারের নাম। যারা প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধী তাদের তো বঙ্গবন্ধু ক্ষমা করেননি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দালাল আইন বাতিল করা হয়। শাহ আজিজের মতো রাজাকারকে প্রধানমন্ত্রীও বানিয়েছিল জিয়া। তার দলের হাত ধরেই পরবর্তীতে আব্দুর রহমান বিশ্বাস রাষ্ট্রপতি, মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মুজাহিদ মন্ত্রী হন। তাদের গাড়িতে যখন স্বাধীন দেশের পতাকা দেখতাম, তখন মনে হতো বুকে ডিনামাইট বেঁধে ওদের গাড়ির নিচে গিয়ে পড়ি। পতাকার মান বাঁচাই। আমরা কি এমন স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম, যে দেশের রাজনীতিতে পাকা আসন গেড়ে থাকবে রাজাকাররা? এ লজ্জা তো গোটা জাতির।’
যুদ্ধাহত ও মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধির কারণে সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ’দেশের জন্য চোখ দিয়েছি। ভাতা খাওয়ার জন্য কিন্তু যুদ্ধ করিনি। একসময় ভাতা পেতাম ২০০ টাকা। চিত্তরঞ্জন দত্ত স্যারকে বলেছিলাম– এ ভাতা নেওয়ার প্রয়োজন নেই। ওই ভাতা না বাড়ালে পথে বসতে হতো। এখন এ বয়সে এই ভাতাই আমার পরিবারের রক্ষাকবচ।’
স্বাধীন দেশে ভালোলাগা অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘যখন দেখি কিছু না হলেও পাকিস্তানিদের মতো কেউ আমাকে বাইনচোদ-মাদারচোদ বলে গালি দিচ্ছে না, স্বাধীনভাবে আমি আমার মায়ের ভাষায় কথা বলছি– তখন মনে শন্তি পাই, ভালো লাগে।’
খারাপ লাগে কখন?
এই যোদ্ধার অকপট উত্তর: চেয়েছিলাম স্বাধীন দেশে অর্থনেতিক ও সামাজিক উন্নতি। কিন্তু পাইনি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর যারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিল তারা দেশটাকে মুক্তিযুদ্ধের চিন্তা-চেতনা থেকে অনেক দূরে নিয়ে গেছে। দুর্নীতি আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। আওয়ামী লীগে এখন সুসময়ের বন্ধু বেশি। স্বার্থের কারণে এখন জিন্দাবাদের লোকরা জয় বাংলা বলে। এসব দেখলে বুকটা ফেটে যায়। সুবিধাবাদীরা যেন দলকে খেয়ে ফেলতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
দেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে পরবর্তী প্রজন্ম। বুক ভরা আশা নিয়ে তাদের উদ্দেশে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নাজির আহমদ বলেন, ‘তোমরা ভালো চিন্তা করো। বড়দের সম্মান করো। খারাপটাকে বর্জন করো। তোমরা এ দেশটাকে ভালোবেসো। দেশের জন্য যারা রক্ত ও আত্মাহুতি দিয়েছেন তাদের তোমরা মনে রেখো।’
সংক্ষিপ্ত তথ্য
নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. নাজির আহমদ চৌধুরী।
ট্রেনিং নেন: আটাশ দিনের ট্রেনিং নেন ভারতের লোহারবনে। বি কোম্পানির সিএইচএম ছিলেন।
এফএফ নম্বর: ই-৬৯৬৩।
যুদ্ধ করেছেন: চার নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর এলাকায় প্রথম দিকে গেরিলা অপারেশনে অংশ নেন। কমান্ডার ছিলেন মাহবুবুর রব সাদী এবং কোম্পানি কমান্ডার আশরাফ আলী। অপারেশন করেন আটগ্রাম, শাহবাগ, শরতের বাজার প্রভৃতি এলাকায়। পরে ভারতীয় সেনাদের সহযোগিতায় অংশ নেন সম্মুখযুদ্ধে।
যুদ্ধাহত: ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। ভোরে। জকিগঞ্জের আটগ্রাম ডাকবাংলো অপারেশনের সময় পাকিস্তানি সেনাদের একটি গুলি ডানচোখের পাতার নিচ দিয়ে ঢুকে নাকের হাড় ভেঙ্গে বাম পাশের গাল দিয়ে বেরিয়ে যায়। ফলে নষ্ট হয়ে যায় তার ডান চোখটি। ওই চোখে তিনি আর দেখতে পারেন না।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১
© 2021, https:.