রক্ষা পাবে কি সব জাতির মাতৃভাষা
বর্ণমালা নিয়ে ম্রো সমাজে প্রচলিত একটি লোককাহিনী দিয়ে শুরু করছি। ম্রোদের বিশ্বাস চাঁদ, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, পৃথিবী বা ভূম-লের জীবকুল ও উদ্ভিদকুল সৃষ্টির পেছনে রয়েছেন এক মহাশক্তিমান। তিনি হচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা বা থুরাই। একদিন সৃষ্টিকর্তা তার সৃষ্ট মানুষজাতিসহ জীবকুলকে সঠিক পথে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বর্ণমালা সংবলিত ধর্মীয় গ্রন্থ দান করবেন বলে মনস্থির করেন। তিনি ওই পুস্তক বা ধর্মীয় গ্রন্থ গ্রহণের জন্য পৃথিবীর সব জাতির নেতাকে উপস্থিত থাকার জন্য একদিন ডেকে পাঠালেন। তখন জুমের ফসলাদি উঠছিল। তাই কাজের ব্যস্ততায় ওই অনুষ্ঠানে ম্রো জাতির নেতা যথাসময়ে উপস্থিত থাকতে পারেননি। অন্য জাতির নেতারা যখন গ্রন্থখানা নিয়ে ফিরে আসছেন তখন ম্রো প্রধান সেখানে উপস্থিত হন। ততক্ষণে সৃষ্টিকর্তা বা থুরাই স্বর্গে ফিরে গেছেন।
পরদিন সকালে সৃষ্টিকর্তা বা থুরাই গরুর মাধ্যমে ম্রোদের কাছে তাদের গ্রন্থ পাঠানোর উদ্যোগ নিলেন। গ্রন্থে বারোমাসিক চাষাবাদ, ধর্মীয় নীতিমালা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষয় সম্পর্কে উল্লেখ ছিল। ধর্মীয় সব বিধিনিষেধ ও উপদেশবাণীও লেখা ছিল কলার পাতায়। থুরাইয়ের নির্দেশে গরু গ্রন্থখানা নিয়ে রওনা হলো। সময়টা ছিল গ্রীষ্মকাল। প্রখর রোদে গরুটি হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। পথে ছিল বিরাট এক বটগাছ। তার ছায়ায় গরু গ্রন্থের ওপর মাথা রেখে বিশ্রাম নিতে গিয়ে মনের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল ততক্ষণে বিকেল ঘনিয়ে এলো, সন্ধ্যা হয় হয়। ক্ষুধার জ্বালায় তার পেট চুঁ চুঁ করতে লাগল। কোনো উপায় না দেখে কলাপাতার গ্রন্থখানা সে খেয়ে ফেলল।
বর্ণমালা ও ধর্মীয় বিষয় ছাড়াও ওই পুস্তকে আরও নির্দেশাবলি ছিল যে, বছরে তিনবার ধান, তিনবার তুলা, তিনবার তিল-তিসি ফসল তোলা যাবে এবং মাত্র একবার নিড়ানি দিতে হবে। পুস্তকবিহীন গরু যখন ম্রোদের কাছে উপস্থিত হলো, তখন সে সব বিষয়ই ভুলে গেল।
কোনো উপায় না দেখে গরু ম্রোদের কাছে গিয়ে বলল, ‘গতকাল পুস্তক প্রদান অনুষ্ঠানে তোমরা যে সঠিক সময়ে উপস্থিত থাকতে পারনি তার জন্য থুরাই তোমাদের ওপর ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়েছেন। তাই তোমাদের গ্রন্থ দেওয়া হবে না বলে তোমাদের ভবিষ্যৎ করণীয় বিষয় জানাতে তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন।’ নির্দেশাবলি জানতে চাইলে গরুটি বলে, ‘জুম থেকে একবার ফসল উত্তোলন করা যাবে এবং জুমের ফসল রক্ষণাবেক্ষণসহ বহুবার নিড়ানি দিতে হবে।’ এ কথা বলেই সে সৃষ্টিকর্তার কাছে ফিরে যায়।
গরু ফিরে গেলে থুরাই ম্রোদের কাছে সঠিকভাবে গ্রন্থ পৌঁছানো হয়েছে কি না প্রশ্ন করলে গরুটি অগোছালোভাবে জবাব দিতে থাকে। থুরাই বা সৃষ্টিকর্তা তখনই বুঝতে পারেন বিষয়টি। এদিকে ম্রোরা দেখল জুম চাষ নিয়ে অপরাপর জাতির নির্দেশনার সঙ্গে তাদের নির্দেশনাটির কোনোই মিল নেই। তাই একদিন তারা সৃষ্টিকর্তার কাছে গেল এর কারণ জানতে।
সব শুনে থুরাই গরুকে মিথ্যা বলার অপরাধে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করল। পাশাপাশি তিনি বললেন, ‘যতদিন ম্রো জাতি বর্ণমালা সংবলিত ধর্মীয় গ্রন্থ পাবে না, ততদিন পর্যন্ত তোমাদের (গরুর) ওপর ম্রোরা নির্যাতন চালাবে। তোমাদের শাস্তি হবে ম্রোদের গ্রামের মধ্যখানে লিম্পুতে (পাড়ার মাঝখানে) পিঞ্জরে আবদ্ধ করে তোমাদের চারদিকে ঘুরে ঘুরে তারা সারা রাত নাচবে। আর ভোরে বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করবে। আর তোমাদের মিথ্যাশ্রিত জিহ্বা কেটে বাঁধানো খুঁটির মাথায় গেঁথে রাখবে। এটাই হচ্ছে তোমাদের মিথ্যা বলার উপযুক্ত শাস্তি।’
ম্রো আদিবাসীদের বিশ্বাস এ ঘটনার পর থেকেই তাদের পূর্বপুরুষরা গো-হত্যা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। কিন্তু বর্তমানে ম্রোদের মধ্যে যারা ‘ক্রামা’ ধর্ম গ্রহণ করেছে তারা গো-হত্যা থেকে বিরত থাকেন। কারণ ‘ক্রামা’ ধর্মাবলম্বীদের কাছে বর্তমানে বর্ণমালা ও ধর্মীয় গ্রন্থ রয়েছে। ম্রো সমাজের এমন কাহিনীগুলোই যুগে যুগে সমৃদ্ধ করেছে আদিবাসী সাহিত্যকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এমন লোকসাহিত্য তুলে আনা ও সংরক্ষণের সরকারি উদ্যোগ ও চেষ্টা নেই বললেই চলে।
আমরা সেই জাতি যারা নিজের বর্ণমালা ও মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য রক্ত দিয়েছি। ফলে আমাদের দেশের ‘ভাষা শহীদ দিবস’ আজ সারা পৃথিবীর ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। কিন্তু ভাষার দেশে মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের অগ্রগতি সত্যিকার অর্থে কতটুকু?
সরকার সব শিশুর মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ নিশ্চিত করার অংশ হিসেবে প্রথম দফায় পাঁচটি নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং সে অনুযায়ী শিশুদের পড়াশোনা শুরুর উদ্যোগ গ্রহণ করে ২০১২ সালে। এর জন্য প্রথমে জাতীয় পর্যায়ে তিনটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে পরিকল্পনা নেওয়া হয়। প্রথম দফায় পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা এবং সমতলের সাদরি ও গারো এই পাঁচটি ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ম্রো, মণিপুরি, তঞ্চঙ্গ্যা, খাসি, বমসহ ছয়টি ভাষায় এবং তৃতীয় পর্যায়ে কোচ, ওঁরাও (কুড়–ক), হাজং, রাখাইন, খুমি ও খ্যাং ভাষার পর অন্যান্য ভাষাতেও প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হবে। সে অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ের ৫টি ভাষায় ২০১৪ সালের জানুয়ারিতেই প্রাক-প্রাথমিকে আদিবাসী শিশুদের হাতে নিজ নিজ ভাষার বই তুলে দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি সম্ভব হয় ২০১৭ সালে। এ বছরও ওই পাঁচটি মাতৃভাষায় পাঠদানের বই বিতরণ করা হয়। কিন্তু ওই ভাষার শিক্ষক বা প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি কাজে আসছে না। আবার কভিড-১৯ মহামারীর কারণে পার্বত্য অঞ্চলে শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। মহামারীর কারণে অন্যভাষীদের মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের কাজও চলছে ঢিমেতালে। ফলে সার্বিকভাবে অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর শিশুরা মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে।
এদেশে অন্য জাতির মাতৃভাষাগুলোর অবস্থা এখন কেমন? এ নিয়ে একাধিক বেসরকারি জরিপ পরিচালিত হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা প্রয়োজনীয়তার চাপে পড়ে নিজ মাতৃভাষা থেকে এখন বাংলাকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। তবে এর প্রভাব সমতলের আদিবাসীদের মধ্যেই বেশি। সাঁওতালদের ৪৯ শতাংশই মনে করে, নিজ মাতৃভাষার চেয়ে আজ বাংলাই বেশি প্রয়োজনীয়। উত্তরবঙ্গের কোদা ও কোল জাতির কেউই এখন আর নিজ ভাষায় পড়তে বা লিখতে পারে না। একই অবস্থা টাঙ্গাইলের কোচ ও দিনাজপুরের কড়া, ভুনজার, মুসহরদের। সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, গারো, ত্রিপুরা এই প্রধান পাঁচটি জাতি ছাড়া অন্যদের ভাষা বিপন্নের দ্বারপ্রান্তে। ঘরের মধ্যে ছাড়া তাদের মাতৃভাষা চর্চার সুযোগ নেই বললেই চলে। তাদের নতুন প্রজন্ম শিক্ষার সুযোগ ও বাস্তবতার কারণে নিজের ভাষার চেয়ে বাংলা ও ইংরেজি চর্চাকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। ফলে এখন আদিবাসীদের ভাষার উচ্চারণে শুধু পরিবর্তনই ঘটছে না; বরং তাদের শব্দভা-ারে অনেক বাংলা শব্দও স্থান করে নিয়েছে। আবার যেসব আদিবাসী দীর্ঘদিন ধরে শহরে বসবাস করছে, পারিপার্শ্বিকতার নানা কারণে তাদের মাতৃভাষাও আজ তারা প্রায় ভুলতে বসেছে।
তাই মাতৃভাষা রক্ষায় সব নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী পরিবারকেও উদ্যোগী হতে হবে। নিজেদের ভেতর নিজস্ব ভাষার চর্চা বাড়াতে হবে। আর বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় দায়সারা পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করলেই হবে না। সেটি ক্লাসরুমে পঠন ও শিক্ষা প্রদান নিশ্চিত করার উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। মাতৃভাষায় পুস্তক প্রণয়নের সঙ্গে সমন্বয় রেখে শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও সংশ্লিষ্ট ভাষার শিক্ষক নিয়োগে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি তুলে আনতে হবে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর লোকসাহিত্যও। তবেই রক্তে পাওয়া বর্ণমালার এ দেশে রক্ষা পাবে সব জাতির মাতৃভাষা।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২
© 2022, https:.