মানবতা পদদলিত হয়েছে রাজারবাগে
ট্রেনিং শেষে সারদা থেকে আমাদের পাঠানো হয় রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে। কনস্টেবল ছিলাম। দায়িত্ব ছিল অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র ইস্যু ও জমা করা। পুরো অস্ত্রাগারের দায়িত্বে ছিলেন সুবেদার আবুল হাশেম। রাজারবাগে তখন স্পেশাল আর্মড ফোর্সে ছিল প্রায় সাড়ে পাঁচশ’র মতো সদস্য। ওরা থাকত তৎকালীন চারতলা বিল্ডিংয়ে। নিচতলাতে ছিল দুটি অস্ত্রাগার। আড়াইশ থেকে তিনশোর মতো সদস্য ছিল ইস্ট পাকিস্তান প্রভেনশিয়াল রিজার্ভ ফোর্সে (ইপিপিআরএফ)। চারটি টিনশেড ব্যারাকে থাকত এই ফোর্সের সদস্যরা।
৭ মার্চ ১৯৭১। রাজারবাগ থেকে আমাদের টহলে পাঠানো হয় রেসকোর্স ময়দানে। বঙ্গবন্ধু ওইদিন ভাষণে বললেন ‘আর যদি একটা গুলি চলে। আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়… প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে…।’ আমাদের কাছে ওটাই ছিল যুদ্ধের নির্দেশনা। এর পর থেকেই ডিএসবি, এসবি, বিভিন্ন সোর্স ও গোয়েন্দাদের মাধ্যমে আসছিল নানা খবর। পাকিস্তানের আইএস গোয়েন্দা সংস্থা রাজারবাগকে সিরিয়াসভাবে টার্গেট করে রেখেছে। কারণ ইস্ট পাকিস্তানের বৃহত্তম পুলিশ লাইনস ছিল রাজারবাগ। যেখানে বাঙালি সদস্য ছিল সবচেয়ে বেশি।’ রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে একাত্তরপূর্ব নানা ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কনস্টেবল মো. আবু শামা। এক সকালে তার বাড়িতে বসেই আলাপ চলে। আব্দুর রশিদ ভূইয়া ও মাজেরা খাতুনের বড় সন্তান আবু শামা। বাড়ি কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার পীরপুর গ্রামে। আলাপচারিতায় ফিরি যাই একাত্তরে। আবু শামা বলেন, ‘রাজারবাগের প্রতিরোধযুদ্ধে কোনো অফিসার কিন্তু নেতৃত্ব দেয়নি। আক্রমণটা হবে এটা ২৩ ও ২৪ মার্চেই আমরা ক্লিয়ার হয়ে যাই। ২৫ মার্চ ১৯৭১। শুধু স্পেশাল আর্মড ফোর্স ও ইস্ট পাকিস্তান প্রভেনশিয়াল রিজার্ভ ফোর্সের ইয়ং পুলিশ সদস্যরা ছাড়া নায়েক ফারুক, হাবিলদার আফসারসহ কিছু হাবিলদার ও নায়েক ব্যারাকে ছিলেন। সন্ধ্যার ঠিক পরের ঘটনা। ম্যাগজিন ঘাটে তখনো পাকিস্তানের চাঁদতারা পতাকা উড়ছিল। আমরা ‘জয় বাংলা’ ও ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ সেøাগান তুলে ওই পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিই।
রাত আনুমানিক ১০.৩০। একটা ওয়্যারলেস মেসেজ আসে তেজগাঁও এলাকায় পেট্রোলে থাকা ওয়্যারলেস অপারেটর আমিরুলের কাছ থেকে। মেসেজে বলা হয় ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৩৭ ট্রাক সশস্ত্র সেনা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে। খবরটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সেন্ট্রিও তখন পাগলা ঘণ্টি পিটায়। অস্ত্রাগারে চলে যাই আমি। দেখলাম তালা মারা। সেন্ট্রি বলে, ‘হাশেম স্যার (সুবেদার আবুল হাশেম) তালা মাইরা চাবি নিয়া গেছে মফিজ স্যারের বাসায়।’ দৌড়িয়ে গেলাম সেখানে। দেখি একটি ট্রাকের ভেতর মফিজ স্যার পরিবারসহ উঠে গেছে। তাকে থামাই। অস্ত্রগারের চাবি চাই। প্রথম বলেছেন চাবি নেই। চাপের মুখে একটা অস্ত্রাগারের চাবি দেন।
ওই চাবি নিয়ে একটা অস্ত্রাগারের দরজা খুলে দিই। রাইফেল দিয়ে আরেকটা অস্ত্রাগারের তালার মধ্যে গুলি করে একজন। তবু তালাটা ভাঙে না। এরপর একটা শাবল দিয়ে ওই তালাটা ভেঙে ফেলি। ভেতরের অস্ত্রগুলো তখন যে যার মতো নিয়ে যায়। অবাঙালি সদস্যরা আগেই পালায় পুলিশ লাইনস থেকে। শুধু সুবেদার বদরুদ্দিন খান অবাঙালি হয়েও আমাদের পক্ষে ছিলেন।
শান্তিনগরে ডন স্কুলের ছাদের ওপরে আর মালিবাগ এসবি ব্যারাকের ছাদের ওপর আমাদের দুইটা গ্রুপ চলে যায়। প্যারেড গ্রাউন্ডে একটা গ্রুপ, এক নম্বর ও দুই নম্বর গেইট, মূল ভবনের ছাদ ও বিভিন্ন স্থানে পজিশন নিয়ে অপেক্ষায় থাকি আমরা। রাত আনুমানিক ১১টা। পাকিস্তানি কনভয়ের ওপর শান্তিনগরে ডন স্কুলের ছাদের ওপর থেকে পুলিশ প্রথম গুলি চালায়। আমরাও শব্দ পাই। পাকিস্তানি আর্মিদের ওপর ওটাই ছিল প্রথম আক্রমণ। শাহজাহান, আব্দুল হালিম, ওয়্যারলেস অপারেটর মনির, গিয়াসউদ্দিনসহ পজিশনে থাকি মূল ভবনের ছাদে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে রাজারবাগের দিকে ওরা আক্রমণ করে। আমাদের ১০টা গুলির বিপরীতে ওরা জবাব দিয়েছে প্রায় কয়েক হাজার গুলির মাধ্যমে। ওরা ট্যাংক, রকেট লঞ্চার ও হেভি মেশিনগান ব্যবহার করে। অল্প সময়ের ভেতর টিনশেডের ব্যারাকগুলোতে আগুন লেগে যায়। জীবন বাঁচাতে ভেতর থেকে পুলিশ সদস্যরা দৌড়ে বের হওয়ার চেষ্টা করে। তখন পাকিস্তানি সেনারা ব্রাশফায়ার করে তাদের নির্মমভাবে হত্যা করে। ফজরের আজান দিছে তখন। আর্মিরা রাজারবাগের এক ও দুই নম্বর গেইট দুটি ট্যাংকের সাহায্যে ভেঙে ভেতরে ঢোকে। আসে ১০টি খালি ট্রাকও। এক থেকে দেড়শো পুলিশের লাশ ছিল পড়ে। ওগুলো ট্রাকে করে ওরা সরিয়ে ফেলে। ভেতরে ঢুকে ছাদে উঠে টেনেহিঁচড়ে নামায় আমাদের। বেয়োনেট দিয়েও খুঁচিয়েছে, অস্ত্র কেড়ে নিয়ে হাত ওপর দিকে তুলে মারতে মারতে নিচে নামিয়েছে। রাস্তায় ফেলে ক্রলিং করায়। নির্দয়ভাবে পেটায়ও। দেখলাম একটা ময়লার ড্রেনে পড়ে আছে আমাদের ক্যান্টিন বয়। বয়স চৌদ্দর মতো। আর্মিরা তাকে সেখান থেকে উঠিয়া পিচঢালা রাস্তায় এনে আছড়ায়। তার মুখ ফেটে রক্ত বের হতে থাকে। ছেলেটা কাঁপতে কাঁপতে বলছিল ‘পানি পানি।’ এক পাকিস্তানি আর্মি পাশে নিয়ে প্যান্টের জিপার খুলে তার মুখে প্রস্রাব করে দেয়। ওই মুহূর্তটা খুবই খারাপ লাগছিল। একাত্তরে মানবতা প্রতি মুহূর্তে পদদলিত হয়েছে রাজারবাগে!
আপনাদের কী করল? ‘তিনদিন ওখানেই আটকে রাখে। নির্মমভাবে টর্চার করে। রাইফেলের বাঁটের আঘাত, বুটের নিচে ছিল লোহার পাত, সেটা দিয়ে দেয় লাথি, শরীরের প্রতিটি জায়গা ছিলে যায়, রক্তাক্ত হই। মুখেও আঘাত করেছে। সবগুলো দাঁতের গোড়া ভেঙে যায়। ফলে সব দাঁতই পড়ে গেছে। এখন বেঁচে আছি কৃত্রিম দাঁত লাগিয়ে।
এক ফোঁটা পানিও খেতে দেয়নি। শরীরের রক্ত মুখে চলে এলে লবণ কাটা লাগত। ভাবিওনি বেঁচে থাকব। বেঁচে আছি এটাই আল্লাহর রহমত। ২৮ মার্চ বিকেলে ঢাকার পুলিশ সুপার ইয়ে চৌধুরী আসেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে। তিনি আমাদের তার জিম্মায় নেন। মিল ব্যারাকে রিপোর্ট করার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে না গিয়ে চার-পাঁচদিন হেঁটে চলে যাই গ্রামের বাড়িতে।’ আবু শামা পরে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। তিন নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেন কিশোরগঞ্জের গুতালিয়া মাইলপাশা, নিকলি থানা, বগামারা রেলওয়ে ব্রিজ, গুরাউতরা নদীতে, বাজিতপুর, সরারচর প্রভৃতি এলাকায়। বাজিতপুর যুদ্ধে পাকিস্তানিদের একটি গুলি তার বুকের ডান দিক দিয়ে ঢুকে রগগুলো ছিঁড়ে বেরিয়ে যায়। সেই ক্ষত এখনো একাত্তরকে মনে করিয়ে দেয়। তবুও আফসোস নেই তার। স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিতে পেরেছেন এটাই পরম পাওয়া বলে মনে করেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু শামা যুদ্ধ শেষে আবার পুলিশের চাকরিতে ফিরে যান। সবশেষে হাবিলদার হিসেবে প্রমোশন নিয়ে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। স্বাধীনতা লাভের পর মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়নি। সেটি হলে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের প্রতিরোধ যোদ্ধারাও বঙ্গবন্ধুর দেওয়া বীরউত্তম বা বীরপ্রতীক উপাধি লাভ করতেন এমনটাই মনে করেন এই বীর যোদ্ধা। পরবর্তী প্রজন্মই বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে। তাদের নিয়েই স্বপ্ন দেখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কনস্টেবল মো. আবু শামা। তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে তোমরা অনুসরণ করো। চার নেতাকেও স্মরণে রেখো। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস যদি তোমরা জেনে নাও, তাহলে দেশপ্রেমিক হবে। তোমরাই এ দেশকে সোনার বাংলা করবে।’
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৩ মার্চ ২০২২
© 2022, https:.