রাজারবাগে পুলিশের প্রতিরোধযোদ্ধাদের ৫০ বছরেও জোটেনি রাষ্ট্রীয় সম্মাননা
“ছোটবেলায় খুব দুষ্ট প্রকৃতির ছিলাম। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ছি। এরপর লেহাপড়া করি নাই। বাবার কথা শুনতাম না। কাম-কাজও করি নাই। খালি ঘুরাঘুরি করছি। একদিন বাবায় খুব রাগ করছে। আমিও মন খারাপ কইরা ট্রেনে চইলা যাই ঢাকায়, মালিটোলায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে। ওখানে কয়েকটা ছেলের সঙ্গে আলাপ হয়। ওরা বলে, প্রতি সোমবার পুলিশে লোক ভর্তি করে, তুই যাবি নাকি বেডা। বললাম চল যাই। রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে গিয়া দাঁড়াইলাম। বডির মাপ নিয়া বলল, ৫ ফিট ৭ ইঞ্চি। নাম জিগাইলো। এরপর বলে ‘ওকে’। টিকে গেলাম পুলিশে।
৬ মাসের ট্রেনিংয়ে পাঠায় সারদায়। সত্তরের নির্বাচন আসে। ট্রেনিং ক্যাম্প থেকেই আমগো ডিউটি দেয়, মানিকগঞ্জের সিংগাইরে। তখন দেখছি নিরবে মানুষ ভোট দিছে নৌকায়।
ট্রেনিং শেষে সারদা থেকে আমাদের পাঠানো হয় ঢাকায়, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে। কনস্টেবল ছিলাম, ব্রাশ (বডি) নম্বর ছিল ৫০৩৪। ঢাকায় তহন তুমুল আন্দোলন চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ কলেজের ছাত্ররা আন্দোলন করছে বেশি। রাস্তায় রাস্তায় তারা বেরিকেড দিতো। স্লোগানে উত্তাল ছিল রাজপথ। তোমার-আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব– এমন স্লোগানে মুখরিত ছিল ঢাকা শহর। ডিউটি দিলেও সত্যিকার অর্থে বাঙালিদের বিরুদ্ধে আমরা নিরব ভূমিকা পালন করতাম।
পুরো অস্ত্রাগারের দায়িত্বে ছিলেন সুবেদার আবুল হাশেম। তিনি বললেন, ‘অস্ত্রাগারে তুই অস্ত্র ইস্যু ও জমা করবি। গুলি দিবি বিশটা কইরা’। একটা অস্ত্রগারে দুইটা দরজা। এক দরজা দিয়ে ঢুকে অস্ত্র নিয়ে আরেক দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় লেইখা দেওয়ার নিয়ম। কোন রাইফেল নিলো থ্রি নট থ্রি নাকি মার্ক ফোর, কয় রাউন্ড গুলি নিলো এগুলোও লেইখা রাখতে হতো। আমার লগে টাঙ্গাইলের এক কনস্টেবল ছিল। নাম বাবর আলী। আমি আর সে শিফট ভাগ কইরা ডিউটি করতাম।”
পুলিশে যোগদান ও একাত্তর পূর্ববর্তী নানা ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা কনস্টেবল মো. আবু শামা। এক সকালে তার বাড়িতে বসেই চলে আলাপচারিতা।
আব্দুর রশিদ ভূঁইয়া ও মাজেরা খাতুনের বড় সন্তান আবু শামা। বাড়ি কিশোরগঞ্জ কুলিয়ারচর উপজেলার পীরপুর গ্রামে। তার লেখাপড়ায় হাতেখড়ি বেকি চন্দ্রগ্রাম প্রাইমারি স্কুলে। সেখানে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ার পর সিক্সে ভর্তি হন সরারচর শিবনাথ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে।
আলাপচারিতায় ফিরে যাই একাত্তরে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের ভেতরের নানা ঘটনার কথা তিনি বলতে থাকেন অকপটে। তার ভাষায়, “রাজারবাগে তখন স্পেশাল আর্মড ফোর্সে ছিল প্রায় সাড়ে পাঁচশ’র মতো সদস্য। ওরা থাকত তৎকালীন চারতলা বিল্ডিংয়ে। নিচতলাতে ছিল দুটি অস্ত্রাগার। আড়াইশ থেকে তিনশর মতো সদস্য ছিল ইস্ট পাকিস্তান প্রভেনশিয়াল রিজার্ভ ফোর্সে (ইপিপিআরএফ)। চারটি টিনশেড ব্যারাকে থাকত এই ফোর্সের সদস্যরা।
৭ মার্চ ১৯৭১। রাজারবাগ থেকে আমাদের টহলে পাঠানো হয় রেসকোর্স ময়দানে। বঙ্গবন্ধু ওইদিন ভাষণে বললেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে। আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়……..প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে….।’ আমাদের কাছে ওটাই ছিল যুদ্ধের নির্দেশনা।
এর পর থেকেই ডিএসবি, এসবি, বিভিন্ন সোর্স ও গোয়েন্দাদের মাধ্যমে আসছিল নানা খবর। পাকিস্তানের আইএসআই গোয়েন্দা সংস্থা রাজারবাগকে সিরিয়াসভাবে টার্গেট করে রেখেছে। কারণ ইস্ট পাকিস্তানের বৃহত্তম পুলিশ লাইনস ছিল রাজারবাগ। যেখানে বাঙালি সদস্য ছিল সবচেয়ে বেশি।”
২৫ মার্চ ১৯৭১। পাকিস্তানি সেনারা নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে। আবু শামা সেই হত্যাযজ্ঞ দেখেছেন খুব কাছ থেকে, নিজে বেঁচে এসেছেন দৈবক্রমে। ওইদিনের রক্তাক্ত ইতিহাস মনে হলে আজও তার বুকের ভেতরটা খামচে ধরে। তার মুখে শুনি ওই রাতের আদ্যোপান্ত।
তিনি বলেন, “রাজারবাগের প্রতিরোধযুদ্ধে কোনো অফিসার কিন্তু নেতৃত্ব দেয়নি। আক্রমণটা হবে এটা ২৩ ও ২৪ মার্চেই আমরা ক্লিয়ার হয়ে যাই। ২৫ মার্চ ১৯৭১। শুধু স্পেশাল আর্মড ফোর্স ও ইস্ট পাকিস্তান প্রভেনশিয়াল রিজার্ভ ফোর্সের ইয়ং পুলিশ সদস্যরা ছাড়া নায়েক ফারুক, হাবিলদার আফসারসহ কিছু হাবিলদার ও নায়েক ব্যারাকে ছিলেন।
সন্ধ্যার ঠিক পরের ঘটনা। ম্যাগজিন ঘাটে তখনো পাকিস্তানের চাঁদতারা পতাকা উড়ছিল। আমরা ‘জয় বাংলা’ ও ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ স্লোগান তুলে ওই পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিই।
রাত আনুমানিক ১০.৩০। একটা ওয়্যারলেস মেসেজ আসে তেজগাঁও এলাকায় পেট্রোলে থাকা ওয়্যারলেস অপারেটর আমিরুলের কাছ থেকে। মেসেজে বলা হয় ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৩৭ ট্রাক সশস্ত্র সেনা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে। খবরটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সেন্ট্রিও তখন পাগলা ঘন্টি পিটায়।
অস্ত্রাগারে চলে যাই আমি। দেখলাম তালা মারা। সেন্ট্রি বলে, ‘হাশেম স্যার (সুবেদার আবুল হাশেম) তালা মাইরা চাবি নিয়া গেছে মফিজ স্যারের বাসায়।’ দৌড়ায়া গেলাম সেখানে। দেখি একটি ট্রাকের ভেতর মফিজ স্যার পরিবারসহ উঠে গেছে। তাকে থামাই। অস্ত্রগারের চাবি চাই। প্রথম বলছেন চাবি নাই। চাপের মুখে একটা অস্ত্রাগারের চাবি দেন।
ওই চাবি নিয়া একটা অস্ত্রাগারের দরজা খুলে দিই। রাইফেল দিয়ে আরেকটা অস্ত্রগারের তালার মধ্যে গুলি করে একজন। তবু তালাটা ভাঙে না। এরপর একটা শাবল দিয়া ওই তালাটা ভেঙে ফেলি। ভেতরের অস্ত্রগুলো তখন যে যার মতো নিয়ে যায়। অবাঙালি সদস্যরা আগেই পালায় পুলিশ লাইনস থেকে। শুধু সুবেদার বদরুদ্দিন খান অবাঙালি হয়েও আমাদের পক্ষে ছিলেন।
শান্তিনগরে ডন স্কুলের ছাদের ওপরে আর মালিবাগ এসবি ব্যারাকের ছাদের ওপর আমাদের দুইটা গ্রুপ চলে যায়। প্যারেড গ্রাউন্ডে একটা গ্রুপ, এক নম্বর ও দুই নম্বর গেইট, মূল ভবনের ছাদ ও বিভিন্ন স্থানে পজিশন নিয়ে অপেক্ষায় থাকি আমরা। রাত আনুমানিক ১১টা। পাকিস্তানি কনভয়ের ওপর শান্তিনগরে ডন স্কুলের ছাদের ওপর থেকে পুলিশ প্রথম গুলি চালায়। আমরাও শব্দ পাই। পাকিস্তানি আর্মিদের ওপর ওটাই ছিল প্রথম আক্রমণ।
শাহজাহান, আব্দুল হালিম, ওয়্যারলেস অপারেটর মনির, গিয়াসউদ্দিনসহ পজিশনে থাকি মূল ভবনের ছাদে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে রাজারবাগের দিকে ওরা আক্রমণ করে। আমাদের ১০টা গুলির বিপরীতে ওরা জবাব দিয়েছে প্রায় কয়েক হাজার গুলির মাধ্যমে। ওরা ট্যাংক, রকেট লঞ্চার ও হেভি মেশিনগান ব্যবহার করে। অল্প সময়ের ভেতর টিনসেডের ব্যারাকগুলোতে আগুন লেগে যায়। জীবন বাঁচাতে ভেতর থেকে পুলিশ সদস্যরা দৌড়ে বের হওয়ার চেষ্টা করে। তখন পাকিস্তানি সেনারা ব্রাশফায়ার করে তাদের নির্মমভাবে হত্যা করে।
ফজরের আজান দিছে তখন। আর্মিরা রাজারবাগের এক ও দুই নম্বর গেইট দুটি ট্যাংকের সাহায্যে ভেঙ্গে ভেতরে ঢোকে। আসে ১০টি খালি ট্রাকও। এক থেকে দেড়শ পুলিশের লাশ পড়ে ছিল। ওগুলো ট্রাকে করে ওরা সরিয়ে ফেলে।
ভেতরে ঢুকে ছাদে উঠে টেনেহিঁচড়ে নামায় আমাদের। বেয়োনেট দিয়েও খুঁচিয়েছে, অস্ত্র কেড়ে নিয়ে হাত ওপর দিকে তুলে মারতে মারতে নিচে নামিয়েছে। রাস্তায় ফেলে ক্রলিং করায়। নির্দয়ভাবে পেটায়ও।
দেখলাম একটা ময়লার ড্রেনে পড়ে আছে আমাদের ক্যান্টিন বয়। বয়স চৌদ্দর মতো। আর্মিরা তাকে সেখান থেকে উঠিয়ে পিচঢালা রাস্তায় এনে আছড়ায়। তার মুখ ফেটে রক্ত বের হতে থাকে। ছেলেটা কাঁপতে কাঁপতে বলছিল ‘পানি পানি।’ এক পাকিস্তানি আর্মি পাশে নিয়া প্যান্টের জিপার খুলে তার মুখে প্রস্রাব করে দেয়। ওই মুহূর্তটা খুবই খারাপ লাগছিল। একাত্তরে মানবতা প্রতি মুহূর্তে পদদলিত হয়েছে রাজারবাগে!”
আপনাদের কী করল?
“তিনদিন ওখানেই আটকে রাখে। নির্মমভাবে টর্চার করে। রাইফেলের বাঁটের আঘাত, বুটের নিচে ছিল লোহার পাত, সেটা দিয়ে দেয় লাথি, শরীরের প্রতিটি জায়গা ছিলে যায়, রক্তাক্ত হই। মুখেও আঘাত করেছে। সবগুলো দাঁতের গোড়া ভেঙে যায়। ফলে সব দাঁতই পড়ে গেছে। এখন বেঁচে আছি কৃত্রিম দাঁত লাগিয়ে।
এক ফোঁটা পানিও খেতে দেয়নি। শরীরের রক্ত মুখে চলে এলে লবণ কাটা লাগত। ভাবিওনি বেঁচে থাকব। বেঁচে আছি এটাই আল্লাহর রহমত। ২৮ মার্চ বিকেলে ঢাকার পুলিশ সুপার ই এ চৌধুরী আসেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে। তিনি আমাদের তার জিম্মায় এবং মিল ব্যারাকে রির্পোট করার কথা বলেন।
মিল ব্যারাকের দিকে হেঁটে রওনা হই। শরীর তখন খুব দুর্বল, জ্বরও। পুলিশের পোশাক পরা। তাতে শরীরের রক্ত শুকিয়ে টিনের মতো শক্ত হয়ে গেছে। কয়েকজন চিন্তা করলাম মিল ব্যারাকে আর যাব না। বাড়ি ফিরব। তাই গেন্ডারিয়ার দিকে এগোই আমরা। সুত্রাপুর লোহার ব্রিজটার কাছে গিয়ে বুকের ভেতরটা আতকে উঠে। লোহার ব্রিজ থেকে একটা ক্যানেল গেছে বুড়িগঙ্গার দিকে। সেখানে হাজার হাজার লাশ পানিতে ভাসছে। মরা মানুষের দেহ ফুলে ভেসে আছে তাতে ঠোকরাচ্ছে শত শত কাক। এ দৃশ্য যারা চোখে দেখে নাই তারা একাত্তরকে অনুভবও করতে পারবে না ভাই।
আমাদের দেখে সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসে। বলে, আপনারা রাজারবাগের পুলিশ! কীভাবে বেঁচে আছেন? ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার মাটি কেঁপেছে। আগুনের লেলিহান শিখা এখান থেকেই দেখা গেছে। আমি ঠিকমতো হাঁটতে পারছিলাম না। তারা কাঁধে তুলে নিয়ে যায় এক বাড়িতে। কাপড় খুলে ক্ষত জায়গায় ওষুধ লাগিয়ে পুরানো কাপড় পরিয়ে দেয়। কয়েক বাড়ির থেকে নিয়ে আসে খাবার। গেন্ডারিয়ার ওই মানুষগুলোর কথা এখনো মনে পড়ে। এরাই শান্তিকামী, মুক্তিকামী মানুষ। আমি এখনও দোয়া করি তাদের জন্য। এরপর হেঁটে ৪-৫ দিনে চলে আসি গ্রামে। পরিবার জানত রাজারাবাগের কোনো পুলিশ বেঁচে নাই। আমাকে পেয়ে বাবা-মার সেকি কান্না!”
বাড়িতে কয়েকদিন থাকার পরই আবু শামা তার বাবাকে বলে চলে যান আগরতলায়, নাইনটি ওয়ান বিএসএফ শালবনে। আগেই ট্রেনিং ছিল। তাই ওখান থেকে শুধু অস্ত্র সংগ্রহ করে দেশের ভেতরে চলে আসেন। ১৭ জনের একটা গ্রুপ ছিল তাদের। গ্রুপটিতে আর্মি, ইপিআর আর পুলিশের সদস্যরা ছাড়া সিভিল কেউ ছিলেন না। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেন তিন নম্বর সেক্টরে। অপারেশন করেছেন কিশোরগঞ্জের গুতালিয়া মাইলপাশা, নিকলি থানা, বগামারা রেলওয়ে ব্রিজ, গুরাউতরা নদীতে, বাজিতপুর, সরারচর প্রভৃতি এলাকায়।
এক অপারেশনে মারত্মকভাবে আহত হন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু শামা। পাকিস্তানি সেনাদের একটি গুলি তার বুকের ডান দিকের নিচ দিয়ে ঢুকে রগগুলো ছিড়ে বেরিয়ে যায়। ছোট ছোট কিছু স্প্লিন্টারও বুকের ডান পাশ দিয়ে ঢুকে বাম পাশের ভেতরে চলে যায়। সরিষা দানার মতো ওই স্প্লিন্টারগুলো এখনো আবু শামার বুকের ভেতর রয়ে গিয়েছে। ডাক্তার বলেছিল শরীরে চর্বি যখন কমে যাবে তখন পেইন হবে। তাই হয়েছে। এখন তার বুকের ভেতর ব্যথা হয় মাঝেমধেই। ফলে স্বাধীনতার জন্য রক্ত দেওয়া এই যোদ্ধার যুদ্ধ চলছে শরীরের সঙ্গে।
কী ঘটেছিল রক্তাক্ত ওই দিনে?
জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা আবু শামা বলেন, “অক্টোবর মাসের ঘটনা। আমাদের গোপন মিটিং হয় বাজিতপুরের খইকুড়ি নামক জায়গায়। গ্রুপ কমান্ডার মেজবাহ উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন সেখানে। সিদ্ধান্ত হয় বকতার পাড়া ও বগামারা রেল ব্রিজটা ভেঙ্গে দেওয়ার। যাতে ভৈরব ও কিশোরগঞ্জ থেকে ট্রেনে পাকিস্তানি ফোর্স ঢুকতে না পারে। পরিকল্পনা মোতাবেক কুলিয়ারচরের মুক্তিযোদ্ধা জিল্লুর, মঞ্জু ভাইসহ একটি গ্রুপ বকতারপাড়া ব্রিজ আর আমরা বগামারা ব্রিজটা ভেঙ্গে দিই। এর পর অক্টোবরের বিশ তারিখের পর সরারচর ও বাজিতপুরের ভেতরে থাকা আর্মি ও রাজাকারদের ওপর একই টাইমে আক্রমণ করি। ওই অপারেশনেই একইসঙ্গে সরারচর ও বাজিতপুর শক্রুমুক্ত হয়।
বাজিতপুর আক্রমণের গ্রুপটিতে ছিলাম। আক্রমণটা হয় ভোর রাতে। বাজিতপুরের বাঁশমল নামক জায়গায় ছিল পাকিস্তানি আর্মিরা। আর থানা এলাকায় ছিল মিলিশিয়া ফোর্স আর রাজাকাররা। সব মিলে ওরা পঁচাত্তরজনের মতো, সবাই নিহত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে।
উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব– আমরা তিন দিক থেকে আক্রমণ করি। পশ্চিম দিকটা ছিল খোলা। আমাদের গ্রুপে সুবেদার মেজর নুরুল আজিম চৌধুরী, প্রফেসার ইয়াকুব, সুবেদার বজলুর রহমান, হাবিলদার ইদ্রিস, নায়েক আব্দুল হাইসহ ছিলেন অনেকেই। একেবারে থানার কাছাকাছি চলে আসি আমরা। গোলাগুলি চলছে প্রচণ্ড। একতলা বিল্ডিংয়ের মতো উঁচু ছোট্ট একটা জায়গা। ওখানে একটা আমগাছ। গাছের পাতার ভেতর ওদের একটা বাঙ্কার। পাকিস্তানি মিলিশিয়া এক সৈনিক ওত পেতে ছিল সেখানে। প্রথম দিকে সে নিরব থাকে। ফলে আমরাও খেয়াল করিনি।
মার্ক ফোর রাইফেল নিয়ে লাইন পজিশনে ছিলাম। পরে ক্রলিং করে এগোচ্ছি। ঠিক তখনই আমার মাথা লক্ষ্য করে একটা গুলি আসে ওই বাঙ্কার থেকে। নিচের দিকে থাকায় গুলিটি আমার বুকের ডান দিকের নিচ নিয়ে ঢুকে রগগুলো ছিড়ে বেরিয়ে যায়। ফলে নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বেরুতে থাকে। রগ ছেড়ার কারণে ডান হাতটা ঝুলে ছিল। বুকের চামড়া ছিড়ে মাংস বেরিয়েও যায়। সহযোদ্ধারা দ্রুত সরিয়ে নেয় আমাকে। সুবেদার মেজর নুরুল আজিম চৌধুরী তখনই ওই আমগাছের বাঙ্কারে একটা থ্রি-ইঞ্চি মর্টার নিক্ষেপ করে। বুকের দিকে তাকিয়ে রক্ত দেখে খানিক পরেই জ্ঞান হারাই। ভেবেছি মরে যাবো। বেঁচে আছি এটাই আল্লাহর রহমত।”
চিকিৎসা হয় কোথায়?
“গ্রামের ভেতরেই চিকিৎসা চলে। ডাক্তার মঞ্জু ও ওয়াহাব চিকিৎসা করেন। প্রথম গজ ঢুকিয়ে সেলাই করার চিন্তা ছিল। কিন্তু ওয়াহাব ডাক্তার বললেন এটা করলে ইনফেকশন হয়ে যাবে। বরং প্রতিদিন গজ ঢুকিয়ে লোশন দিতে হবে। এতে ধীরে ধীরে ক্ষত ভেতর থেকে শুকিয়ে আসবে। তাই করা হয়। লোশন দিয়ে প্রতিদিন ওয়াশ করার সময় জীবনটা যেন বেরিয়ে যেত। কষ্টে চিৎকার করতাম। ছোট ছোট কিছু স্প্লিন্টারও বুকের ডান পাশ দিয়ে ঢুকে বাম পাশের ভেতরে চলে যায়। সেগুলো বের করা সম্ভব হয়নি। মাস দেড়েক চিকিৎসা চলে। এর পর আর রণাঙ্গণে ফিরতে পারিনি। আহত হলেও ওই অপারেশনে জয়লাভ করেছি। এটা ভেবেই তৃপ্ত হই।”
যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু শামা যুদ্ধ শেষে আবার পুলিশের চাকরিতে ফিরে যান। সবশেষে হাবিলদার হিসেবে প্রমোশন নিয়ে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
স্বাধীনতা লাভের পর মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়নি বলে মনে করেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু শামা। তখন যারা পুলিশের দায়িত্বে ছিলেন তারা রাজারবাগের প্রতিরোধ যুদ্ধের ইতিহাস সঠিকভাবে বঙ্গবন্ধুর নিকট উপস্থাপন করতে পারেনি। সেটি হলে পুলিশ লাইনসের প্রতিরোধযোদ্ধারাও বঙ্গবন্ধুর দেওয়া বীরউত্তম বা বীরপ্রতীক খেতাব লাভ করতেন। এছাড়া স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি আমরা। অথচ পঞ্চাশ বছরেও রাজারবাগের প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেওয়া কোনো পুলিশ সদস্যকেই স্বাধীনতা পুরস্কার বা অন্য কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেওয়া হয়নি। ২৫ মার্চে পুলিশের প্রথম প্রতিরোধ ও আত্মত্যাগের ইতিহাসটিও যুক্ত হয়নি কোনো পাঠ্যপুস্তকে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাত্তরের বিদেশী বন্ধুদেরও ডেকে এনে সম্মানিত করেছেন। এটিও ভাল উদ্যোগ। কিন্তু এই পঞ্চাশ বছরে আমরা সেটা পাইনি। আক্ষেপ নিয়ে বলেন পুলিশের এই বীর যোদ্ধা।
এমন নানা কষ্ট বুকে পুষেই বেঁচে আছেন রাজারবাগের প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেওয়া আবু শামার মতো পুলিশ যোদ্ধারা। তবুও স্বাধীন দেশ নিয়ে গর্বিত তারা। একাত্তরে পুলিশের প্রথম প্রতিরোধ, বীরত্ব ও আত্মত্যাগের ইতিহাস জেনে প্রজন্ম উজ্জীবিত হবে– এমনটাই আশা তাদের। তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন, “বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে তোমরা অনুসরণ করো। চার নেতাকেও স্মরণে রেখো। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস যদি তোমরা জেনে নাও, তাহলে দেশপ্রেমিক হবে। তোমরাই এ দেশেকে সোনার বাংলা করবে।”
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৪ মার্চ ২০২২
© 2022, https:.