একাত্তরে লাখো মায়ের দোয়া ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে
“১৯৬৯ সাল। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাংলা সাহিত্যে এমএ পড়ছি। ইকবাল হলের ২১৮ নম্বর রুমে থাকতাম। ছাত্র রাজনীতিতে খুবই সক্রিয় ছিলাম। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ করতাম। সিটি কমিটির সদস্য ছিলাম। তবে অধিকাংশ কাজই কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় করতে হয়েছে। শেখ মুজিবকে তখনও কাছ থেকে দেখিনি। তবে তার দৃঢ়চেতা মানসিকতা আমাদের অনুপ্রেরণা দিত। কোনও অবস্থাতেই পাকিস্তানিদের কাছে আত্মসমর্পন করবেন না এই নেতা। অনেক দমন-পীড়ন করেও আইয়ুব খান তাকে বশে আনতে পারছে না। বাঙালির ভেতর এমন কঠিন ও সাহসী মানসিকতার মানুষ থাকতে পারে, শেখ মুজিবই ছিলেন সেই উদাহরণ। তার এসব গুণ আমাদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করত। ফলে সারা দেশের ছাত্রসমাজের মনে শেখ মুজিব জায়গা করে নেন খুব সহজে।
আবার মুজিবের রাজনৈতিক আদর্শ ছিল অন্যরকম। তার ছয় দফা সত্যিই বাঙালির মুক্তির সনদ। ছয় দফার প্রতিও আমাদের প্রবল দুর্বলতা ছিল। পরে সেটা এগার দফা হয়। ওইসময় আমাদের একটা প্রিয় স্লোগান ছিল, ‘ছয় দফা বা এগার দফা মানতে হবে, মানতে হবে; নইলে পরে এদেশ– ছাড়তে হবে, ছাড়তে হবে।’
ছাত্র আন্দোলন আর প্রতিবাদের মুখে শেখ মুজিবকে জেল থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। রেসকোর্স ময়দানে তাকে বঙ্গবন্ধু খেতাব ও সংবর্ধনা দেওয়া হয়। শেখ মুজিবকে কাছ থেকে প্রথম দেখি ওই দিনই, ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি।
ছাত্রনেতা হিসেবে ওইদিন মঞ্চে ওঠার সুযোগ পেয়েছিলাম। এক কোণে বসে আছি। হঠাৎ তোফায়েল ভাই (তোফায়েল আহমেদ) ডাক দিলেন।
বললেন– ‘সালাম কর, নেতাকে’।
বঙ্গবন্ধুর পা ছুঁয়ে সালাম করলাম।
তোফায়েল ভাই পরিচয় করিয়ে বললেন– ‘ও সিটি কমিটির সদস্য, ছাত্রলীগের’।
বঙ্গবন্ধু বললেন– ‘কোন দায়িত্বে আছে?’
তোফায়েল ভাই বললেন– ‘আমরা ওকে পাবলিসিটির দায়িত্বে রেখেছি’।
শুনে বঙ্গবন্ধু মুচকি হাসলেন। এরপর প্রিয় নেতার হাতটি স্নেহের স্পর্শ করে যায় আমার মাথা ও পিঠে। সেই অনুভূতি ঠিক বোঝাতে পারব না। বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখায় আমার মনে হয়েছিল, যেন একটা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থান করেছি মাত্র। সে অনুভূতি সত্যি অন্যরকম ছিল।”
বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখার অনুভূতির কথা এভাবেই তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন খান। এক বিকেলে তার শ্যামলীর বাড়িতে বসেই আলাপ চলে যুদ্ধদিনের নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে।
ওয়াজেদ আলী খান ও কাঞ্চন বানুর পঞ্চম সন্তান আনোয়ার হোসেন খান। বাড়ি বরগুনা জেলার বামনা উপজেলায়, বড় ভাইজোড়া গ্রামে। তার লেখাপড়ায় হাতেখড়ি বড় ভাইজোড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন গুলিসাখালি হাই স্কুলে। সেখান থেকেই ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯৬৫ সালে। আনোয়ার হোসেন ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন ১৯৬৭ সালে, বরিশালের বিএম কলেজ থেকে। অতঃপর চলে আসেন ঢাকায়। জগন্নাথ কলেজ থেকে বিকম পাসের পর তিনি বাংলা সাহিত্যে এমএ–তে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭১ সালে এমএ ফাইনাল পরীক্ষাও শেষ হয়ে যায়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় ফল প্রকাশ বন্ধ থাকে।
১৯৭০-এ ছাত্রলীগ থেকে প্রচারণার কাজে আনোয়ারদের নিয়ে একটি গ্রুপ করে দেওয়া হয়। সেই সুবাদে বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি থাকার সুযোগ পান তিনি। একবার তার সঙ্গে গিয়েছিলেন টুঙ্গিপাড়ায়। সেখান থেকে মোল্লারহাট ও খুলনায় প্রচারণা সেরে ফিরে আসেন ঢাকায়। তাদের সঙ্গে ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল হক মনি, কাছের বন্ধু কাজী ফিরোজ রশীদ (বর্তমানে জাতীয় পার্টির এমপি), আ স ম ফিরোজ (পটুয়াখালীর এমপি) প্রমুখ। সেসব দিনের স্মৃতি আজও জীবন্ত হয়ে আছে আনোয়ার হোসেন খানের মনে।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। ফলে সারাদেশে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। নেতাদের নির্দেশে ইকবাল হলের পুকুর পাড়ে কাঠের ডামি রাইফেল নিয়ে ট্রেনিং শুরু করেন আনোয়াররা।
তার ভাষায়– “মার্চের এক তারিখ থেকেই ট্রেনিং চলে সকাল-বিকাল। নীলক্ষেত পুলিশ পোস্টের দুই জন পুলিশ রাইফেল ট্রেনিং করায়। আমাদের কাছে ছিল কাঠের ডামি রাইফেল। ট্রেনিং চলে সাত দিন। বিকেলের ব্যাচে ছিলাম আমি। দুটো ব্যাচে ৫০ জনের মতো ছাত্র ট্রেনিং নেয়। আমার সঙ্গে বন্ধু মহসিন, সিরাজ, ফজলুর রহিমও ছিল।”
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন– “কথাগুলো কিছু মানুষের জন্য অপ্রিয়ও হতে পারে। বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রচণ্ড চাপ ছিল স্বাধীনতা ঘোষণা করার। ছাত্রলীগে তখন দুটো গ্রুপ। মনি ভাইয়ের একটা গ্রুপ, যেটার লিডিংয়ে ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন। তাদের ফলোয়ার ছিলাম আমরা। আরেকটা গ্রুপে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ছিলেন আ স ম আব্দুর রব ও শাহজাহান সিরাজরা। মার্চের শুরু থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য ওই গ্রুপটাই চাপ দিচ্ছিল বঙ্গবন্ধুকে। তাদের ধারণা ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা করলেই স্বাধীনতা এসে যাবে। কিন্তু আমরা সেটা বিশ্বাস করতাম না। বিভিন্ন আলোচনায় বঙ্গবন্ধুও বলতেন–‘এটা হাস্যকর চিন্তা।’ আমাদের কাছে বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণটিই ছিল স্বাধীনতার স্পষ্ট ঘোষণা। কী করতে হবে– ওই ভাষণ থেকেই নির্দেশনা পেয়ে যাই। সাধারণ মানুষও বুঝে যায় ওটাই বঙ্গবন্ধুর শেষ নির্দেশনা।”
আপনারা তখন কী করলেন?
“নেতাদের নির্দেশে গ্রামে চলে যাই। বরগুনা, বেতাগী ও আমতলী এলাকার এমএনএ ছিলেন আসমত আলী সিকদার। তার নেতৃত্বেই প্রতিটি হাইস্কুল ও কলেজে ট্রেনিং শুরু হয়। ট্রেনিং পরিচালনা করে সংগ্রাম কমিটি। বামনা থানায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবুল হাসেম খান ছিলেন সংগ্রাম কমিটির চেয়ারম্যান।
২৫শে মার্চ সারা দেশে শুরু হয় গণহত্যা। আমরা তখন দলবেঁধে বামনা থানার নিয়ন্ত্রণ নিই। থানা থেকে পাই চারটা রাইফেল আর কিছু দোনলা বন্দুক। সেগুলো নিয়ে ছোট ছোট গ্রুপ করে থাকতাম। মানুষকে বোঝাতাম– আমরা অস্ত্র আনব। যুদ্ধ করব। ভয় পাওয়ার কিছু নাই।”
পাকিস্তানি সেনারা বিভিন্ন সাব-ডিভিশন শহর দখল করা শুরু করে। প্রতিটি মহকুমা শহরে একজন পাঞ্জাবি বা বেলুচ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন বা মেজরকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠায় তারা। বরগুনায় আর্মি আসে পটুয়াখালী থেকে, মে মাসের ২৯ তারিখে। এরপরই ওরা কিলিং শুরু করে।”
আনোয়াররা তখন আত্মগোপন করে থাকেন। একবার খবর আসে আর্মিরা বরগুনা থেকে চলাভাঙ্গা খাল হয়ে ডৌয়াতলা বাজারে আসবে। আনোয়াররা ওখানেই আটকে রেখেছিল পিস কমিটির কিছু লোককে, যারা লুটপাট আর মানুষের ওপর অত্যাচার চালাত। তাদের মুক্ত করাই ছিল পাকিস্তানি আর্মিদের লক্ষ্য।
এরপর কী ঘটল?
তার ভাষায়– “ওরা যদি ডৌয়াতলায় যেতে চায় তাহলে একটা খালের ভেতর দিয়ে আসতে হবে। আর খালে ঢুকতে হলে জোয়ারের সময় ছাড়া পারবে না। পরিচিত এক অবসরপ্রাপ্ত আর্মির লোক আমাদের কমান্ড করে। পাকিস্তানি সেনারা কবে আসবে নিশ্চিত ছিলাম না। ফলে প্রায়ই পজিশন নিয়ে থাকতাম।
২০ জুন ১৯৭১, সকালবেলা। অপেক্ষার পালা শেষ হয়। পাকিস্তানি আর্মিরা একটা কাঠবডির লঞ্চে খালের ভেতর দিয়ে আসতে থাকে। দুদিক থেকে আমরা তখন গুলি চালাই। প্রতিরোধের মুখে পড়বে– এটা ওরা ভাবতেই পারেনি। কিন্তু আমাদের টার্গেটটা ঠিক ছিল না। দুই-একজনের গায়ে গুলি লাগলেও অধিকাংশ গুলি গিয়ে লাগে লঞ্চের তলায়। ফলে লঞ্চ ফুটো হয়ে ভেতরে পানি ঢুকতে থাকে। আর্মিরা তখন ঝাঁপ দিয়ে জীবন বাঁচায়। অতঃপর খালের উল্টো দিকে কাকছিড়া বাজার দিয়ে সরে পড়ে। তখনও পুরো ট্রেনিং ছিল না আমাদের। তবু ওই অপারেশন সফল হয়েছিল। কারণ বুকে তখন প্রচণ্ড সাহস। পাকিস্তানিদের এ দেশ থেকে তাড়াতে হবে– এটাই ছিল সবার একমাত্র লক্ষ্য।”
ট্রেনিংয়ে গেলেন কোন সময়টায়?
তিনি বলেন– “ওই সময়ই এমপিএ সওগাতুল আলম সগির ইন্ডিয়া থেকে একটা চিঠি পাঠান। তাতে লেখা ছিল– ‘তোমরা যদি মুক্তিযুদ্ধ করতে চাও, তাহলে এখানে এসে আধুনিক অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নাও, অস্ত্রও সংগ্রহ করো। যত তাড়াতাড়ি পারো যত সংখ্যায় পারো চলে আসো।’ চিঠিটা পেয়েই আমরা ট্রেনিংয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। ৮৪ জনের একটি গ্রুপের সঙ্গে জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পৌঁছাই ইন্ডিয়াতে।”
পরিবারকে জানিয়ে গিয়েছিলেন?
“বাবা-মা জানতেন। আমরা চার ভাই যুদ্ধে যাই। আমি ছাড়াও বড় ভাই দেলোয়ার হোসেন খান, ছোট ভাই আলতাফ হোসেন খান ও মনোয়ার হোসেন খান সঙ্গে ছিলেন। যাওয়ার সময় মা খুব কেঁদেছেন। তিনি শুধু বললেন– ‘যদি বেঁচে থাকি আর তোমরা যদি জিতে আসো তাহলে দেখা হবে। না জিতলে হয়তো আসতে পারবে না। দোয়া করি, তোমরা জিতে এসো বাবা।’ একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে এমন লাখো মায়ের দোয়া ছিল।”
আনোয়াররা নৌকা নিয়ে ইছামতি নদী পেরিয়ে প্রথমে ভারতের হাসনাবাদে পৌঁছান। সেখান থেকে চলে যান আমলানী ইয়ুথ ক্যাম্পে। ওই ক্যাম্পেরই দায়িত্বে ছিলেন এমপিএ সওগাতুল আলম সগীর। তাদের তিন সপ্তাহের ট্রেনিং হয় ওখানেই। এরপর উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতের বশিরহাট মহকুমায়, পিফা ক্যাম্পে।
তার ভাষায়– “ওই ক্যাম্পটি পরিচালনা করত ইন্ডিয়ান আর্মি। তবে ক্যাম্পের চেয়ারম্যান ছিলেন নূরুল ইসলাম মঞ্জুর সাহেব। তিনি বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এবং ক্যাপ্টেন হুদার বড় ভাই। দুই সপ্তাহ ট্রেনিং হয় পিফা ক্যাম্পে। আমার এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর ছিল ১৫৫১। এখনও মনে পড়ে চিফ ইন্সট্রাক্টর ক্যাপ্টেন সিপাকে। খুবই আন্তরিক ছিলেন ওখানকার ভারতীয় সেনারা। একাত্তরে তাদের সহযোগিতার কথাও আমাদের স্মরণে রাখতে হবে।”
মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন খান যুদ্ধ করেন নয় নম্বর সেক্টরে, ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগের কমান্ডে। রণাঙ্গনে লড়াইয়ের কথা শুনি এই যোদ্ধার মুখে।
তিনি বলেন– “ক্যাপ্টেন বেগের কমান্ডে যে কয়টা অপারেশন করেছি, কোনোটাতেই ব্যর্থ হইনি। সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে অপারেশন করি সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে। আক্রমণ হয় রাতের দিকে। তুমুল গোলাগুলি চলে। ভোরের দিকে ওরা ডিফেন্স ছেড়ে সরে পড়ে। আমরা বেশ কিছু আর্মসও পাই ওখানে। ওই অপারেশনে কমান্ড করেন ক্যাপ্টেন বেগ। তার অধীনে ছিলেন লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ আলী, লেফটেন্যান্ট সচি, ক্যাপ্টেন আহসান ও ক্যাপ্টেন শামসুল আরেফিন (মুক্তিযুদ্ধ গবেষক)। সঙ্গে ছিলাম আমরা ৬০-৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা।
কালিগঞ্জ আক্রমণ করতে হয়েছে কয়েকবার। পাকিস্তান আর্মিদের কাছে ওটা ছিল লোভনীয় পজিশন। আর আমরা বলতাম– ‘কালিগঞ্জ উইল আওয়ারস।’ শেষের দিকে পুরো কালিগঞ্জ দখলে রাখি আমরা।
এরপর অপারেশন করি কালিগঞ্জের ভেতরেই, নাজিমগঞ্জে। ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের রেস্ট হাউজ ছিল ওখানে। পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্প করে ওই রেস্ট হাউজেই। ওখানে বাঙালি নারী ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের ধরে এনে টর্চার করা হতো।
তুমুল গোলাগুলি চলে ওখানে। এলএমজি চালাতাম। ওই অপারেশনে কয়েকজন সহযোদ্ধা শহীদ হন চোখের সামনেই। ঘন্টাখানেক পর যুদ্ধের মোড়টা ঘুরে যায়। ক্যাপ্টেন বেগের নেতৃত্বে আমরা ঘুরে দাঁড়াই। শেষে পাকিস্তানি সেনারা পরাস্ত হয়। এরপর বসন্তপুর অপারেশনেও অংশ নিই। মৃত্যুকে মেনে নিয়েই তখন অপারেশনে যেতাম। একাত্তরে মৃত্যুভয়কে জয় করাই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম কাজ।”
কালিগঞ্জ, নাজিমগঞ্জ, পাইকগাছাসহ গোটা এলাকা তখন মুক্ত। ডিসেম্বরের ১১ তারিখ। পুরো টিম গানবোট টাইপের লঞ্চে করে সামনে মুভ করে। ক্যাপ্টেন হুদা লঞ্চেই আনোয়ারের নেতৃত্বে ১১ জনের একটি গ্রুপ করে দেন। নুরুজ্জামান খান, মনির, মনোয়ার, আলতাফ প্রমুখ ছিলেন গ্রুপে। উদ্দেশ্য গ্রামের ভেতর কোনও পাকিস্তানি সেনা বা রাজাকাররা থাকলে, তাদের সারেন্ডার করানো। লঞ্চ থেকে তাদের নামিয়ে দেওয়া হয় মানিকখালি নামক জায়গায়। ওখান থেকে গ্রামের পথে তারা চলে যান বরগুনায়। এর পর অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাধীন দেশে ফেরেন মায়ের কাছে।
তার ভাষায়– “যুদ্ধে জিতেই আমরা ফিরেছি। আমাকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে মায়ের সে কী কান্না। ওইদিন মায়ের চোখেই দেখেছি, স্বাধীনতার আনন্দটাকে! আমার কাছে এটি ছিল পরম পাওয়া।”
জিয়াউর রহমান নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করতেন কিনা– এটা নিয়ে এখনও অনেক জিজ্ঞাসা রয়ে গেছে বলে মনে করেন এই বীর যোদ্ধা। অকপটে তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান স্বাধীন দেশের পতাকা তুলে দিয়েছিলেন স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে। যুদ্ধাপরাধী শাহ আজিজকে নিয়ে ওনার বাড়াবাড়িটা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খুবই অপমানজনক ছিল। অপমানটা মেনে নিতে পারতাম না বলেই তখন টেলিভিশন ও নিউজ দেখা বন্ধ করে দিই। ওপেন ফোরামে গৌরবের সাথে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতেও পারতাম না তখন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জিয়াউর রহমানের নিজের ভেতরই একটা দোনোমনা ভাব ছিল। উনি এটা নিয়ে দ্বিধায় ভুগতেন, যা তার আচরণে প্রকাশও পেত। তখন অনুষ্ঠানে পরিচিতি পর্ব হতো। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একবার তাকে সম্বোধন করা হলে, দ্বিতীয়বার সেটা আর করতে দেওয়া হতো না।”
৫০ বছরে বাংলাদেশের মূল্যায়নটা কীভাবে করবেন?
মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন খান বলেন– “সারা বিশ্বে লাল-সবুজের পতাকার সম্মান বেড়েছে। যাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, সেই পাকিস্তানকেও অর্থনীতিতে আমরা অনেক পেছনে ফেলেছি। এটা ভাবলেই ভালো লাগে। বঙ্গবন্ধু বলতেন– ‘প্রতিটি মানুষকে ভাত ও ভোটের অধিকার দেওয়াই হচ্ছে আমার লক্ষ্য’। বঙ্গবন্ধুর সেই কথাটাই আজ উচ্চারণ করতে চাই। ১৯টি বছর দেশ তো চলেছে উল্টো পথে। যতটুকু পেয়েছি সেটাও হারাতে পারতাম। কারণ জিয়াউর রহমানের মতো শাসক আর এরশাদের মতো সামরিক শাসক যদি আবারও এসে যেত, তাহলে তো এখন যেটা জনগণ পাচ্ছে সেটাও পেত না। সুতরাং ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন খুব কম নয়।”
কী করলে দেশ আরও এগোবে?
“এ দেশে গণতন্ত্রকে যদি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যায়, প্রতিটি মানুষ যদি কথা বলার অধিকার পায়, সেই পরিমাণ সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা যদি নিশ্চিত করা যায়, মূল্যবোধের জায়গায় যদি মানুষ অটল থাকে– তবেই দেশটা আরও এগিয়ে যাবে।”
বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন খান কর্মজীবন শুরু করেন বাংলা একাডেমিতে। গবেষণা অফিসার হিসেবে যোগ দেন ১৯৭৩ সালে। পরে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন ভাষা বিশেষজ্ঞ হিসেবে। এরপর চাকরি নেন বাংলাদেশ বিমানে। সহকারী ব্যবস্থাপক পদে যোগদান করে সর্বশেষ তিনি বাংলাদেশ বিমানের জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে অবসরে যান। তিনি নিজ পছন্দে বিয়ে করেন ১৯৭৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর। তার সহধর্মিণী প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন। কথা হয় তার সঙ্গেও।
এই বীরকে নিয়ে সেলিনা হোসেন অকপটে বলেন– “বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন খান পাবিবারিক জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনে এবং সামাজিক মূল্যবোধের জায়গা থেকে একজন অগ্রগণ্য মানুষ। তার চিন্তা চেতনায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার অগ্রযাত্রা গভীরভাবে বিরাজ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের কষ্ট ও অবহেলার খবরে তাকে খুব কষ্ট পেতে দেখেছি। জীবন বাজি রেখে যারা স্বাধীনতা এনেছেন সেসব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়নটা সরকার ও জনগণের কাছে আরও গভীরভাবে থাকা উচিত বলে মনে করি।”
এই দম্পতির মেজ মেয়ে প্রয়াত বৈমানিক ফারিয়া লারা। মেয়ের মৃত্যুর পর তারা প্রতিষ্ঠা করেছেন ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন, যার মাধ্যমে বর্তমানে রাজেন্দ্রপুরে মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রেটি পরিচালিত হচ্ছে। তারা স্বপ্ন দেখেন জীবনের বাকি সময়টা দেশ ও মানুষের কল্যাণে বড় ধরনের কাজ করার। সেই স্বপ্নকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন খানের জীবনপ্রবাহ।
প্রজন্মই দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে– এমনটাই বিশ্বাস বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন খানের। চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে তাদের উদ্দেশেই তিনি বলেন শেষ কথাগুলো– “দেশটা এখন ডিজিটাল কনসেপ্টের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে। আধুনিক এই প্রযুক্তির যুগে খারাপ দিকগুলো তোমরা বর্জন করে ভালো দিকটা গ্রহণ করো। আমরা দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছি। সেই স্বাধীন দেশটাকে এগিয়ে নেওয়ার কাজটি তোমাদেরকেই করতে হবে। দেশ ও দেশের মানুষের পাশে তোমরা সবসময় থেকো।”
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ৪ এপ্রিল ২০২২
© 2022, https:.