মুক্তিযুদ্ধ

কর্নেল তাহেরের মা

বীর মুক্তিযোদ্ধা ডালিয়া আহমেদ একাত্তরে ছিলেন ভারতেশ্বরী হোমসে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ওই বয়সেই তিনি ভারতের মাহেন্দ্রগঞ্জ থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন

যুদ্ধের সময় এগার নম্বর সেক্টরের সীমান্তবর্তী এলাকায় রেকি করা, গ্রামের মেয়ে সেজে এক ক্যাম্প বা বাঙ্কার থেকে নির্দেশনা নিয়ে আরেক ক্যাম্প বা বাঙ্কারে পৌঁছে দিতেন। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের ম্যাগজিনে গুলি ভরে দেওয়ার কাজও করেছেন। তার বড় ভাই কর্নেল তাহের ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে এগার নম্বর সেক্টরের কমান্ডার। একাত্তরে তার মায়ের যুদ্ধটি কেমন ছিল? এমন প্রশ্ন নিয়েই মুখোমুখি হই এই বীর মুক্তিযোদ্ধার। শুনি তার মায়ের কাহিনি।

গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে স্কুল থেকে বাড়িতে আসতেন ডালিয়ারা। ছুটি শেষে ফিরে যেতে হবে। চোখ তখন টলমল করছে। এখনই জল গড়িয়ে পড়বে। ঠিক তখনই মা বলতেন, ‘নো ক্রাইং। ডাবল মার্চ করে যাও।’ মায়ের কথায় কান্না থেমে যেত। কখনও জড়িয়ে ধরে বিদায় দিতেন না। মা ভালোবাসতেন তার মতো করে। এভাবেই মা আশরাফুন্নেসা ডালিয়াদের শক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ডালিয়া আহমেদ, ছবি: সালেক খোকন

তাদের বাড়ি নেত্রকোণার পূর্বধলার কাজলা গ্রামে। ছুটিতে বাড়িতে আসতেন কর্নেল তাহেরসহ (তখন তিনি মেজর ছিলেন) সব ভাই। পাল্টে যেত তখন বাড়ির পরিবেশ। বালির বস্তা ঝুলিয়ে ট্রেনিং করানো হতো সবাইকে। বস্তার সামনে নিয়ে ছোট বোন ডালিয়াকেও কর্নেল তাহের বলতেন, ‘আপনিও কিন্তু ঘুষি দেবেন। শক্ত করতে হবে তো হাতগুলো।’

বাড়িতে ইন্দারা (কুয়া) ছিল। দড়ি বেঁধে সেখানে নামানো হতো ভাই বেলাল ও ডালিয়াকে। সবচেয়ে সাহসী ছিলেন আরেক ভাই বাহার। ইন্দারায় ঝাঁপ দিয়ে একা একাই উঠে আসতেন। শীতের রাতে উঠানপোড়া পিঠা বানানো হতো। আগুনের চারদিকে বসতেন ভাইবোনরা। কলাপতায় মোড়ানো পিঠা, আগুনে পুড়ছে। হঠাৎ কর্নেল তাহেরের প্রস্তাব, ‘আগুনের ওপর দিয়ে যে লাফ দিয়ে আসতে পারবে, সেই আগে পিঠা পাবে।’ আনন্দ নিয়েই সে চেষ্টাটা চালাতেন সবাই। যুদ্ধের আগে এভাবেই ডালিয়াদের গেরিলা ট্রেনিং দিয়ে রেখেছিলেন ভাই কর্নেল তাহের।

২৫ মার্চ ১৯৭১। সারা দেশে শুরু হয় গণহত্যা। ময়মনসিংহ থেকে অনেক পরিবার পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় ডালিয়াদের বাড়িতে। শত শত মানুষ বাড়িতে। তাদের খাওয়াতে রান্নাবান্না চলছে। মা ডালিয়াদের নানা কাজে ব্যস্ত রাখতেন। যুদ্ধের ভয়বহতা তেমন বুঝতে দিতেন না। হঠাৎ এক সকালে ঘুম থেকে উঠে তারা শোনেন তাদের ভাই আনোয়ার নেই। মায়ের হাতে একটা চিরকুটে লেখা, ‘আম্মা, যুদ্ধে যাচ্ছি, দোয়া করবেন।’

কিছুদিন পর বেলাল আর বাহারও চলে যান। ছেলেরা যুদ্ধে গেলেও মায়ের চেহারায় কোনো উৎকণ্ঠা খুঁজে পেতেন না ডালিয়ারা। বরং তার চোখেমুখে ফুটে উঠত গর্বের চিহ্ন। বাড়িতে রাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনতেন। দেশের খবর শুনতে গোটা গ্রামের মানুষ ভিড় জমাতো। এভাবে দেশের সঙ্গে বদলে যেতে থাকে ডালিয়াদের পরিবারের আবহও।

গেরিলা আক্রমণের ভয়ে কাজলা গ্রামে পাকিস্তানি সেনারা প্রথম আসেনি। কিন্তু মাঝেমধ্যেই গ্রামে গুজব ছড়াত, ‘মিলিটারি আইছে, মিলিটারি আইছে’। সবাই তখন দৌড়ে পালাত। ওই সময়ও ডালিয়া তার মায়ের চোখে ভয় খুঁজে পাননি। মাথা ঠান্ডা রেখে তিনি বলতেন, ‘তুলা রাখ সবাই। যদি ওরা বোমা ফোটায়, গোলাগুলির শব্দে যেন বাচ্চাদের কানের ক্ষতি না হয়।’ মুড়ি, চিড়া আর গুড় একত্রে শত শত প্যাকেট করে আগেই রেখেছিলেন মা আশরাফুন্নেসা।

কর্নেল তাহেরকে খুঁজতে একবার বাড়িতে আসে পাকিস্তানি আর্মিরা। ঘরের দেয়ালে টাঙানো ছিল বাবরি দোলানো কবি নজরুল আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি। ওরা ভাবল নজরুল ‘হিন্দু লোক’। কারণ তার চুলগুলো লম্বা ও কোঁকড়ানো। ছবিটা নামিয়ে পায়ের নিচে ফেলে দুমড়ে মুচড়ে ফেললো। আর ‘মুসলমান দরবেশ’ ভেবে রবীন্দ্রনাথের ছবিটা শ্রদ্ধার সঙ্গে দেয়ালেই টাঙানো থাকলো।

মেজর তাহের কোথায়? প্রশ্ন শুনে মা ভয় পেলেন না। পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বললেন, ‘তোমরাই বলো, আমার ছেলে কোথায়? ওকে তো তোমাদের আর্মিতেই পাঠিয়েছিলাম। তাকে কি মেরে ফেলেছ? কোথায় সে? তার কোনো খবর পাচ্ছি না কেন?’

শুনে সেনারাও ভড়কে যায়। গ্রামের অনেক যুবতীকে তুলে নিতে চেয়েছিল ওরা। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ান তিনি। চেঁচিয়ে বলেন, ‘কারও গায়ে যদি একটা দাগ তোমরা দাও, তোমাদের ছাড়ব না। আমি কিন্তু ওপরে বলব।’

মা আশরাফুন্নেসার কারণেই ওই দিন কাজলা গ্রামটি পাকিস্তানি সেনাদের তাণ্ডব থেকে রক্ষা পেয়েছিল। মায়ের এমন প্রতিবাদী ও সাহসী ভূমিকাই ডালিয়াকে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা জুগিয়েছিল।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ৫ এপ্রিল ২০২২

© 2022, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button