মুক্তিযুদ্ধ

‘মেয়ে বিচ্ছু’রা আজিমপুর কলোনিতে যা ঘটিয়েছিল

“ছোটবেলা থেকেই আমি ছিলাম প্রতিবাদী। সে কারণেই ওই বয়সে ছাত্ররাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছিলাম। বাসায় তখন ইত্তেফাক পত্রিকা রাখা হতো। একটা কথা প্রচলিত ছিল– ‘ইত্তেফাক, সরকারের গোমর ফাঁক’। তাই দেশের খবরাখবর জানতে আগ্রহ নিয়ে ইত্তেফাক পড়তাম। শেখ মুজিবকে ভালো লাগত। যাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল তারা সবাই করত বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন। কিন্তু কেন জানি আমার ছাত্রলীগ ভালো লাগত। দাদাভাইয়ের (রোকনুজ্জামান খান) শিশু-কিশোর সংগঠন কচিকাঁচার মেলার সদস্য ছিলাম। সেখানে একবার নিজের শখ নিয়ে লিখতে দেয়। আমি শখ লিখেছিলাম– ছাত্রলীগের কাজ করা।

১৯৬৯ সাল। তখন ক্লাস এইটে পড়ি। আজিমপুর কলোনির ৫/এ নম্বর কোয়ার্টারে থাকতেন আম্মার সই রিজিয়া খালা। তার ভাই বাতেন মামা (আব্দুল বাতেন চৌধুরী) ছিলেন তৎকালীন ছাত্রলীগের নগর শাখার নেতা। আমার আগ্রহ আর প্রতিবাদী স্বভাবের কথা শুনে তিনিই আমাকে ছাত্রলীগে যুক্ত করেন। কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ছিলেন মার্শাল মনি (মনিরুল ইসলাম)। উনি ছাড়াও কাজী আরেফ ও মাজহারুল ইসলাম টুলু মেয়েদের সংগঠনটা দেখতেন। মূলত মনি ভাই-ই ছাত্রলীগের কাজের জন্য শিরীন আপার (শিরীন আখতার, বর্তমানে জাসদের সংসদ সদস্য) সঙ্গে আমাকে যুক্ত করে দেন। তিনি থাকতেন কলোনির ১০ নম্বর বিল্ডিংয়ে। তার সঙ্গে থেকেই ছাত্রলীগের নানা কাজ, আন্দোলন ও মিছিল-মিটিংয়ে সক্রিয় থেকেছি।

২৪ জানুয়ারি ১৯৬৯। ছাত্র আন্দোলন তখন তুঙ্গে। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যেই পুলিশের গুলিতে মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র কিশোর মতিউর (মতিউর রহমান মল্লিক)। তার দুই চাচা থাকতেন আজিমপুর কলোনিতে। চাচাতো ভাই ও বোন ছিল আমাদেরই খেলার সাথী। মতিউরের মৃত্যু আমাদের হৃদয়ে প্রবলভাবে ঝড় তোলে। এরপর ছাত্র আন্দোলন জোরালো হয় সারাদেশে। একসময় পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়াসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়।

একাত্তর-এ ফেরদৌসী হক লিনু (অ্যালবাম থেকে সংগৃহীত)

কিন্তু পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্র তখনো শেষ হয়নি। তারা মনে করল, ছাত্রদের একটু মগজ ধোলাই দিতে হবে। কীভাবে? ১৯৭০ সালে ‘পাকিস্তান: দেশ ও কৃষ্টি’ নামে একটি বই নবম ও দশম শ্রেণির জন্য পূর্ণ ২০০ নম্বরের প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড বাধ্যতামূলক করে দেয় সরকার। বইটি শুধুই পাকিস্তান ও তার সংস্কৃতি নিয়ে লেখা। পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতির কিছুই সেখানে ছিল না।

এ বই কেন পড়ব? প্রতিবাদ করলাম আমরা। শিক্ষক ও অভিভাবকরাও সমর্থন দিলেন। গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের ছেলেরা পরীক্ষা বাদ দিয়ে প্রতিবাদ করে এবং দাবি তোলে বইটি বাতিলের। দ্রুত আন্দোলন ঢাকার সেন্ট গ্রেগরীজ স্কুল, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, মুসলিম হাই স্কুল, ইস্ট বেঙ্গল ইনস্টিটিউশন, আজিমপুর, অগ্রণী স্কুল, আরমানিটোলা হাই স্কুলসহ ঢাকার ১৫টি স্কুলে ছড়িয়ে পড়ে।

এগিয়ে আসে ছাত্রসংগঠনগুলোও। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ছাত্রদের এই আন্দোলনে যুক্ত হয়। এতে সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও প্রতিবাদ জোরালো হতে থাকে। পরে এটিকে সর্বদলীয় রূপ দিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়, যার আহ্বায়ক ছিলেন মুস্তাক হোসেন এবং সহপাঠী লুৎফা হাসিন রোজী।

রাজনৈতিক দলগুলোও পরে এ আন্দোলনে সমর্থন দেয়। ফলে আন্দোলন বারুদের মতো ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। আমি ও রোজী আজিমপুর, অগ্রণী, পলাশী ও লালবাগ স্কুলের ছাত্রীদের সংগঠিত করার কাজে যুক্ত ছিলাম। মিছিল করে ছাত্রীদের নিয়ে যেতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায়। আহ্বায়ক রোজী তখন এত ছোট ছিল যে রব ভাই তাকে তুলে ধরলে সে বক্তৃতা দিত। এভাবে তুমুল ছাত্র আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার ‘পাকিস্তান: দেশ ও কৃষ্টি’ বইটি বাতিল করতে বাধ্য হয়।

মার্চ ১৯৭১-এ শহীদ মিনারে এক সমাবেশে ফেরদৌসী হক লিনু (ঠিক সামনে লাঠি হাতে বাঁ দিকে তাকিয়ে), (অ্যালবাম থেকে সংগৃহীত)

এর পরই স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হই। একাত্তরের মার্চ মাস। একদিন সুফিয়া কামালের সভাপতিত্বে মা-বোনদের নিয়ে একটি সভা হয় শহীদ মিনারে। ‘মা বোনরা অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ মুক্ত করো’, ‘সন্তানের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না’, ‘শেখ মুজিবের পথ ধরো, বাংলাদেশ মুক্ত করো’– এমন স্লোগান লেখা ফেস্টুন আর লাঠি নিয়ে মা-বোনরা যোগ দেন সমাবেশে। আমরাও লাঠি হাতে যাই সেখানে। ওই সমাবেশের একটি ছবি আছে এখনো। ছবিটির দিকে তাকালে আজও স্মৃতিগুলো মনে পড়ে যায়।”

একাত্তর-পূর্ববর্তী নানা আন্দোলন-সংগ্রামের কথা এভাবেই তুলে ধরেন ফেরদৌসী হক লিনু। একাত্তরে অস্ত্রহাতে মুক্তিযুদ্ধ করেননি তিনি। তবে মুক্তিযুদ্ধে ঢাকার আজিমপুর সরকারি কলোনিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই দুঃসাহসিক কিছু কাজ করেছেন তিনিসহ স্কুল ও কলেজপড়ুয়া কয়েকজন মেয়ে। তাদের সাহসিকতার সেই ঘটনাগুলো জানতেই এক সকালে তার বাড়িতে বসে আলাপ চলে একাত্তর প্রসঙ্গে।

ফেরদৌসী হক লিনুর বাবার নাম কাজী ইউসুফ আলী এবং মা জোহরা কাশেম। ফেরদৌসীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকার আজিমপুর সরকারি কলোনিতে হলেও পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের নয়নপুরে। বাবা চাকরি করতেন পাকিস্তান সরকারের এস্টাবলিশমেন্ট ডিপার্টমেন্টে। ১২ ভাই-বোনের সংসারে লিনু চতুর্থ। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি আজিমপুর স্কুলে। কিন্তু পরে সায়েন্স না পাওয়ায় ভর্তি হন অগ্রণী স্কুলে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ওই স্কুলেরই দশম শ্রেণির ছাত্রী।

১৯৭০-এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে আওয়ামী লীগ। তবু বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করতে থাকে পাকিস্তান সরকার। ওই সময় ছাত্রলীগ ও ডাকসুর সমন্বয়ে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ থেকে প্রতিটি এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য কমিটি করে দেওয়া হয়। আজিমপুর এলাকায় এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন শহীদুল ইসলাম সানু। মূলত স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যুক্ত থেকেই একাত্তরে নানা কাজ করেছেন ফেরদৌসী হক লিনু। সঙ্গে ছিলেন শিরীন আখতার, কে এ এম আজিজুল হক, শফিকুল ইসলাম, নিজামি, এফ এম জিয়াউল হক ফারুক, শামীম বানু, সালাউদ্দিন আহমেদ বাবলু, শফিউদ্দিন, আব্দুল হক, কাইয়ুম, এনায়েত কবির, বেবী, আব্দুল হাই প্রমুখ।

আপনাদের কাজ কী ছিল?

লিনু বলেন: “একটা কিছু ঘটবে এটা নিশ্চিত ছিলাম। তাই নিজেদের তৈরি করাই ছিল বড় কাজ। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে ডামি রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং করানো শুরু হয়। ৭ মার্চের পর আমিসহ শিরীন আপা, শামসুন্নাহার ইকু আপা, ফোরকান আপা, সাকি আপা, রাবেয়া আপা, মমতাজ আপা ছাড়াও বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে আসা ছাত্রীরাও ওই ট্রেনিংয়ে অংশ নেয়। ট্রেনার ছিলেন দুদু ভাই, পেয়ারু ভাই ও খসরু ভাই। তবে আমরা ট্রেনিং করি দুদু ও পেয়ারু ভাইয়ের কাছে। ২৫ মার্চ পর্যন্ত চলে এই ট্রেনিং।

২৫ মার্চ ১৯৭১। আজিমপুর এলাকায় কী ঘটল?

“ওই দিন দুপুরের দিকে ট্রেনিং শেষে শিরীন আপাসহ ইনু ভাই (হাসানুল হক ইনু) হেঁটে আজিমপুর পর্যন্ত আমাদের পৌঁছে দেন। তার মুখেই শুনি, কিছু একটা ঘটতে পারে আজ। থমথমে অবস্থা সব দিকেই। সন্ধ্যা থেকে আজিমপুরের বড় ভাইয়েরা গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে ব্যারিকেড দিতে থাকে। মধ্যরাতে ট্যাংক ও কামান নিয়ে নামে পাকিস্তানি আর্মি। কলোনির এক পাশে ইপিআর ক্যাম্প, অন্য পাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ওদের আক্রমণে সারা রাত গুলির শব্দ পাই। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখেছি আগুনের লেলিহান শিখা। আমাদের বিল্ডিংয়ের ওপরও এসে লাগে অনেক গুলি। ভয়ে সবাই আশ্রয় নিয়েছিলাম খাটের নিচে। গুলি চলে ভোররাত পর্যন্ত। সকাল হতেই কেমন যেন নীরবতা।

২৭ মার্চ কারফিউ ব্রেক হয়। যে যেভাবে পারে ঢাকা থেকে সরে যাচ্ছে। শিরীন আপার বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন কাজী আরেফ ও মার্শাল মনি। কিছু একটা করতে পারলে আমাদেরও নিয়ে যাবেন– এমনটা বলে তারাও তখন চলে যান। আমি আর শিরীন আপা সেই অপেক্ষাতেই থাকি।”

কিন্তু লিনুদের অপেক্ষার পালা শুধু বাড়ে। এপ্রিল মাস থেকেই আজিমপুর কলোনির ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে যেতে থাকে। তারা যুদ্ধে যাওয়ার জন্য নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কথা ছিল সহপাঠী রোজী ও তার ছোট বোন বেবীর সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার। তাদের নিয়ে যাবেন ছাত্রলীগের রফিক ভাই (লিটল কমরেড হিসেবে পরিচিত)। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে শুধু তাদের দুজনকে নিয়েই তিনি চলে যান। লিনুরা তখন মরিয়া হয়ে ওঠেন। অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করে তারাও দেশ স্বাধীন করার জন্য কাজ করবেন। কিন্তু সেটি আর হয় না। নেতাদের কাছ থেকে খবর আসে, দেশে থেকেই কাজ করতে হবে তাদের।

কী কাজ করবেন– এমন কোনো নির্দেশনা ছিল?

মুক্তিযুদ্ধের সময় আজিমপুর কলোনিতে ঈদ উদযাপন না করার অনুরোধ জানিয়ে মেয়ে বিচ্ছুদের দেওয়া চিঠির একাংশ। (অ্যালবাম থেকে সংগৃহীত)

ফেরদৌসী হক লিনুর উত্তর: “সেটা ছিল না। এর মধ্যে শিরীন আপাদের নিচতলায় আসেন ফৌজিয়া খালাম্মারা। তিনি প্রবলভাবে ছিলেন স্বাধীনতার পক্ষে। আমাদের নানা কাজে যুক্ত থাকেন খালাম্মাও। তখন পাকিস্তানি মনোভাবের অফিসাররা কলোনিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। যেসব বাসা থেকে ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে গেছে তাদের বাড়িতে দু-একজন দালাল গিয়ে হুমকি ও ভয় দেখানো শুরু করে। ঠিক তখনই আমরা কলোনির পাকিস্তানপ্রেমী ও দালালদের শায়েস্তা করার পরিকল্পনা আঁটি।”

কীভাবে?

“নিজেরা মিলেই চিঠি লিখলাম। লাল চিঠি। লেখা থাকত– ‘তোমরা যে দালালি করছ, এ খবর চলে গেছে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। তোমাদের শায়েস্তা করা হবে।’ শিরীন আপা, আমি আর ফৌজিয়া খালাম্মা চিঠিগুলো লিখি। শিরীন আপার ছোট বোন বেবী ও ভাই নিলুর বয়স কম ছিল। ওরাসহ বাড়ি বাড়ি গিয়ে লেটারবক্সে চিঠি ফেলে আসতাম। পরদিন সকালবেলা নানা অজুহাতে ওই সব বাসায় ঘুরতে যাই। তখন দেখতাম চিঠি পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে তাদের রান্না হয়নি, নাওয়া-খাওয়াও বন্ধ। এটা আমাদের খুব আনন্দ দিত। বিচ্ছুদের মতো এভাবেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধটা শুরু হয়।

এর মধ্যে সানু ভাই ট্রেনিং থেকে ফিরে আসেন। উনি ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে কাজ করতেন। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল সজীব ভাইদেরও। সানু ভাই চিঠির কথা শুনে বললেন, ‘এভাবে তো হবে না, লিফলেট করতে হবে’।”

লিফলেট কেন?

“বাড়ি বাড়ি মুক্তিযুদ্ধের খবর পৌঁছাতে হবে, মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধজয়ের খবর, পাকিস্তানিদের গণহত্যার খবর মানুষকে জানাতে হবে। আজিমপুর কলোনির বেশির ভাগই তখন সচিবালয়ে চাকরি করেন। তাই কলোনির বাড়ি বাড়ি লিফলেট পৌঁছাতে পারলে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগের খবরগুলো দ্রুত সচিবালয় হয়ে পাকিস্তান সরকারের কানে পৌঁছাবে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় আজিমপুর কলোনিতে ঈদ উদযাপন না করার অনুরোধ জানিয়ে মেয়ে বিচ্ছুদের দেওয়া চিঠির আরেক অংশ। (অ্যালবাম থেকে সংগৃহীত)

তিনি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের তৃতীয় শ্রেণির এক কর্মচারীকে দিয়ে গোপনে সাইক্লোস্টাইল করে লিফলেট বানিয়ে আনেন। কলোনির কাছের বিল্ডিংগুলোতে বেবী ও নিলু আর দূরের বাড়িগুলোতে আমি, লিটু (শিরীন আপার ভাই) আর শিরীন আপা সন্ধ্যায় হাঁটার নাম করে দরজার নিচ দিয়ে লিফলেট ফেলে আসতাম। এই কাজে ভয় ছিল। কিন্তু ভয়কে জয় করেই কাজ করেছি আমরা।

একবার পরিকল্পনা করি আজিমপুরের রাস্তায় পোস্টারিং করার। কারণ ওখানকার সড়কে পাকিস্তানি আর্মিদের চলাচল ছিল বেশি। ফৌজিয়া খালার পরামর্শে রংতুলি দিয়ে পাকিস্তানি সেনা আর মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি এঁকে পোস্টারে লেখা হয়– ‘পাক আর্মি সারেন্ডার করো’। লিটু ও সানু ভাই মিলে পাইওনিয়ার প্রেস থেকে গোপনে পোস্টার ছাপিয়ে আনে। অতঃপর আমি আর শিরীন আপা ফজরের আজানের পরপরই আটা দিয়ে আঠা তৈরি করে পোস্টার নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। কলোনির গেটের বাইরের রাস্তায় পোস্টার লাগিয়ে দৌড়ে গেটের ভেতর ঢুকে যেতাম। মসজিদে যাওয়ার মানুষ যেন না দেখে, এ কারণে বিল্ডিংগুলোর সিঁড়িঘরে লুকিয়ে যেতাম।

পোস্টারিং হওয়ার কিছুদিন পরই আজিমপুর কলোনির রাস্তার পাশের বাড়িগুলোতে পাকিস্তানি আর্মিরা তল্লাশি চালায়। ওরাও বুঝে যায়, কলোনির ভেতর থেকেই কেউ এটা করছে। কিন্তু কেউ চিন্তাও করেনি, এগুলো কলোনির মেয়েদেরই কাজ। স্বাধীনতালাভের পর ওই পোস্টারের একটি কপি বাংলা একাডেমির আর্কাইভে জমা ছিল। কিন্তু পঁচাত্তরের পর সেটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।”

আজিমপুর কলোনিতে ফতেহ লোহানীর ওপর গ্রেনেড ছুড়ে দিয়েছিলেন এক মুক্তিযোদ্ধা। ফেরদৌসী হক লিনুদের সামনেই ঘটে ঘটনাটি। তার ওপর কেন আক্রমণ হয়?

লিনু বলেন: “পাকিস্তান রেডিও থেকে তখন নাটক প্রচার করা হতো। নাটকগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নানা মিথ্যা ও নোংরা প্রচারণা চলত। একটি নাটকে মূল ভূমিকায় ছিল ‘দুলাভাই’ নামের একটি চরিত্র। দুলাভাই মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক নানা কথা বলত। ওই চরিত্রটিতে অভিনয় করতেন ফতেহ লোহানী। তিনি থাকতেন আজিমপুর কলোনির ১৬/এফ নম্বর কোয়ার্টারে। এ কারণেই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের টার্গেট হন। ঢাকার গেরিলা টুলু ভাই আজিমপুর কলোনির ১০/এইচ নম্বর বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন। এটা আমাদের জানা ছিল না। অক্টোবরের প্রথম দিকে এক সকালে টুলু ভাই প্রকাশ্যে গ্রেনেড ছুড়ে রক্তাক্ত করেন ফতেহ লোহানীকে। ফলে প্যান্ট ছিঁড়ে তার ডান ঊরু রক্তাক্ত হলেও তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এর কয়েক দিন পরই প্রাণভয়ে পরিবার নিয়ে পাকিস্তান চলে যান ফতেহ লোহানী।”

একাত্তরে ঈদ উদযাপন না করার নির্দেশ দিয়ে রোজার সময়ে আজিমপুরের মেয়ে বিচ্ছুর দল কলোনির বাড়ি বাড়ি চিঠি বিলি করেছিল। সেই পরিকল্পনার আদ্যোপান্ত শুনি বিচ্ছু ফেরদৌসী হক লিনুর মুখে।

“বান্ধবী মলি থাকত ধানমন্ডি ৫ নম্বরে। তার বাংলা ও ইংরেজি হাতের লেখা খুব ভালো ছিল। ওকে ডেকে এনে শিরীন আপার বাসায় বসিয়ে চিঠি লেখাই। চিঠির মূল বিষয় ছিল এমন– ‘দেশের মানুষকে পাকিস্তানিরা হত্যা করছে। তাই জাঁকজমকভাবে ঈদ উদযাপন করা যাবে না, নতুন কাপড় পরা থেকে বিরত থাকতে হবে, পরলে তার কাপড় নষ্ট করে দেওয়া হবে। পশ্চিম পাকিস্তানি পোশাক বর্জন করতে হবে, মুক্তিবাহিনীকে সব রকম সহযোগিতা করতে হবে। তা না হলে ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে।’ শেষে লেখা হলো ‘জয় বাংলা, জয় শেখ মুজিব’। বিনীত– স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সংগ্রামী বোনেরা।

কিন্তু ওই চিঠিতে ছবি আঁকতে হবে। সানু ভাইকে বলতেই তিনি চারুকলার অধ্যাপক শামসুল ইসলামকে দিয়ে ডাস্টবিনে খাবার খাচ্ছে মানুষ, দেশের অবস্থা মুমূর্ষু এবং অস্ত্রহাতে মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি আঁকিয়ে সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ওই চিঠি তৈরি করে দেন। পুরো রোজার মাস আজিমপুর কলোনির বাড়িগুলোতে গোপনে আমরা ওই চিঠি বিলি করেছি। সানু ভাইদের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায়ও ওই চিঠি বিলি করা হয়েছিল।”

চিঠিতে কি কাজ হয়েছিল?

“অবশ্যই। শুধু চিঠি বিলি করেই আমরা থেমে থাকিনি। কেউ যদি ঈদে নতুন কাপড় পরে তাহলে তার কাপড় নষ্ট করতে হবে। সানু ভাই অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়ের ল্যাব থেকে সালফিউরিক এসিড চুরি করে এনে দেন। সিরিঞ্জ কেনা হয় ফার্মেসি থেকে। সিরিঞ্জে এসিড নিয়ে কাপড় নষ্ট করার অস্ত্র তৈরি করেছিলাম আমরা। সাতাশে রমজানের সময় নতুন কাপড় পরে ঈদে আনন্দ প্রকাশের কথা বলেছিল কলোনির কয়েকজন। এসিড দিয়ে গোপনে ওদের কাপড়গুলো ছিদ্র করে দিই। এ খবরটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে কলোনিতে। ফলে ভয়ে ঈদের দিন নতুন কাপড় পরে কেউ আর বের হয়নি।”

ফেরদৌসী হক লিনুর মতো ‘মেয়ে বিচ্ছু’রা একাত্তরে যা করেছেন তা ছিল অন্য রকম এক মুক্তিযুদ্ধ। ঢাকার ভেতর মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানকে জানান দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মানুষকে সাহসী করে তোলার কাজটি তারা করেছিলেন গেরিলাদলের মতোই। তাদের কাজে জীবনের ঝুঁকি ছিল অনেক বেশি। তবু বুকের ভেতর স্বাধীনতার স্বপ্নকে লালন করে একাত্তরে এমন যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন আজিমপুরের মেয়ে বিচ্ছুরা। তাই একাত্তরে তাদের অবদান অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।

লিনু মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানের কথা এখনো সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়নি। তার ভাষায়: “একাত্তরে নারীর ভূমিকাটা আমি দেখি সন্তানসম্ভাবনা মায়ের মতো। বাংলাদেশকে তারা গর্ভে ধারণ করেছিলেন। কোথায় তাদের ভূমিকা ছিল না বলেন। শারীরিক নির্যাতন, স্বামী ও ছেলেমেয়েকে হাসিমুখে যুদ্ধে পাঠিয়ে দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধা ও মানুষকে আশ্রয় দেওয়া, রান্না করে খাওয়ানো, চিকিৎসা করা– প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা ছিল। অস্ত্রহাতেও যুদ্ধ করেছেন অনেক নারী। একাত্তরে পুরো দেশটাকেই মায়েরা ধারণ করেছিলেন। সন্তানের মুখ দেখলে যেমন মা সব ভুলে যায়, ঠিক তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়ে আনন্দে নারীরাও একাত্তরের সব কষ্ট ভুলে গেছেন।”

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ফেরদৌসী হক লিনু (অ্যালবাম থেকে সংগৃহীত

স্বপ্নের বাংলাদেশ নিয়ে নিজের অনুভূতির কথা তুলে ধরেন ফেরদৌসী হক লিনু: “আমাদের স্বপ্ন ছিল সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ। যে দেশে সবাই খেয়ে-পরে থাকবে, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা থাকবে। শিক্ষাব্যবস্থা হবে একমুখী। এখন চলছে ত্রিমুখী শিক্ষাব্যবস্থা। অনেক মুক্তিযোদ্ধার কৃতিত্বের কথা তার সন্তানরা জানে না। রাজাকারদের পরিবারের সঙ্গে অনেক মুক্তিযোদ্ধার আত্মীয়তার সম্পর্ক হয়েছে। এগুলো আমরা চাইনি।”

দুঃখ নিয়ে তিনি বলেন, “এই প্রজন্মের অনেকেই স্বাধীনতা দিবস ও একুশে ফেব্রুয়ারিকে মনে করে একটা উদযাপনের দিন। লাল-সবুজ আর সাদা-কালো কাপড় পরে উদযাপন করে তারা। কিন্তু এই দিবসের মর্মবাণী তারা কতটুকু জানে। এটা তো আমাদের ব্যর্থতা। কোথায় গেল আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি। আগে গ্রামে গ্রামে নাচগানের অনুষ্ঠান হতো। এখন সেটা কমে গেছে, অনেক জায়গায় ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে হতেও দেওয়া হয় না। সব ধর্মের সমান অধিকার আমাদের স্বপ্ন ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দুরাও যুদ্ধ করেছে, তাদের ওপর অত্যাচারও হয়েছে সবচেয়ে বেশি। অথচ স্বাধীন দেশে নানা অজুহাতে এখনো তাদের জমি দখল হওয়ার, তাদের ওপর হামলা হওয়ার খবর পত্রিকায় আসে। এই বাংলাদেশ তো আমরা প্রত্যাশা করিনি।”

কী করা উচিত বলে মনে করেন?

লিনুর অকপট উত্তর, “সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে। সরকারকেও উদ্যোগী হতে হবে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা অনেক কিছু দিচ্ছেন। দিনরাত কাজ করছেন। কিন্তু মূলের সংস্কার প্রয়োজন। স্ট্রাকচার শক্ত না হলে এর ওপর যত ভরই দেন, একসময় তা ভেঙে পড়বে। তাই প্রজন্মকে ইতিহাস জানাতে হবে, সংস্কৃতিটাও ছড়িয়ে দিতে হবে। মানুষের মানসিকতার উন্নতিটা বেশি দরকার। অনেক দিক থেকে অনেক কিছু হচ্ছে, উন্নতি হয়েছে, কিন্তু মূল জায়গাটা থেকে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্বায়নের মতো করে। কিন্তু আমরা চাই, দেশের মতো দেশ এগিয়ে যাক।”

ফেরদৌসী হক লিনুর বিশ্বাস, একটা সমাজে সবাই ভালো থাকে না। অল্প কিছু লোক ভালো থাকে। তারাই সমাজ-সংসার এগিয়ে নিয়ে যায়। সেই আশা এখনো আছে। বাংলা সফটওয়্যার অভ্র-এর প্রবর্তকের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “লোভ-লালসার উর্ধ্বে থেকে সে বাংলা ভাষাকে সারা বিশ্বে তুলে ধরেছে। এটা তো অনেক বড় কাজ। এমন অনেক ছেলে বাংলাদেশে এখনো আছে। অনেকেই নিজেদের মেধা দিয়ে সারা বিশ্বে লাল-সবুজের সম্মান বাড়িয়েছে। এরাই সমাজ-সংসার টিকিয়ে রাখবে। আমি খুব আশাবাদী।”

প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি বললেন শেষ কথাগুলো- “তোমরা তোমাদের শিকড়কে জেনেই সামনে এগিয়ে যেয়ো। শিকড় জানলেই তোমাদের মনের বিস্তার ঘটবে। শুধু বিশ্বায়নের স্রোতে ভেসে যাওয়া নয়, তোমরা বাংলাদেশের মতোই বাংলাদেশটাকে গড়ে তোলো।”

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজে টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ১৮ মে ২০২২

© 2022, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button