রক্তের মানচিত্রে নারীর ইতিহাস
একাত্তরে নারীদের সাহসের ইতিহাস কি আমরা সঠিকভাবে তুলে আনতে পেরেছি? বীর নারী, নারী মুক্তিযোদ্ধা ও একাত্তরের জনযুদ্ধে সম্পৃক্ত নারীদের সাহসের ইতিহাস কি রচিত হয়েছে? এমন প্রশ্নের উত্তর খোঁজা ও তাদের চোখে একাত্তরকে দেখার চেষ্টায় মুখোমুখি হই কয়েকজন নারীর।
ফেরদৌসী হক লিনু। একাত্তরে আজিমপুর কলোনিতে ‘মেয়েবিচ্ছু’ হিসেবে কাজ করেছেন যা ছিল অন্য রকম এক মুক্তিযুদ্ধ। ঢাকার ভেতর মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান জানান দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মানুষকে সাহসী করে তোলার কাজটি তারা করেছিলেন গেরিলা দলের মতোই। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বুকের ভেতর স্বাধীনতার স্বপ্নকে লালন করে এমন যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন আজিমপুরের মেয়েবিচ্ছুরা। মুক্তিযোদ্ধার কাগুজে সনদ নেই তার। অকপটে বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধটা ছিল পুরোপুরি একটা গণযুদ্ধ। খুব বড় কাজ করেছি এটা আমি কখনো ভাবি না। মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে নিবন্ধিত হয়ে সুবিধা নিতে হবে এটা কখনো চিন্তাও করিনি। দেশটা স্বাধীন হয়েছে এটাই বড় পাওয়া।’
একাত্তরে নারীর ভূমিকাকে লিনু তুলনা করেন সন্তানসম্ভবা মায়ের মতো। তার ভাষায়, ‘বাংলাদেশকে তারা গর্ভে ধারণ করেছিলেন। কোথায় তাদের ভূমিকা ছিল না বলেন। শারীরিক নির্যাতন, স্বামী ও ছেলেমেয়েকে হাসিমুখে যুদ্ধে পাঠিয়ে দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধা ও মানুষকে আশ্রয় দেওয়া, রান্না করে খাওয়ানো, চিকিৎসা করা প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা ছিল। অস্ত্র হাতেও যুদ্ধ করেছেন অনেক নারী। গেরিলা যুদ্ধ তো একা কেউ করতে পারে না। একাত্তরে পুরো দেশটাকেই মায়েরা ধারণ করেছিলেন। কিন্তু তাদের সে ইতিহাস কতটুকু আমরা তুলে ধরতে পেরেছি? এ নিয়ে আক্ষেপ বা দাবি নেই। সন্তানের মুখ দেখলে যেমন মা সব ভুলে যায়, ঠিক তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়ে আনন্দে নারীরাও একাত্তরের সব কষ্ট ভুলে গেছেন।’
খারাপ লাগার অনুভূতিও তিনি তুলে ধরেন এভাবে ‘অনেককেই বলতে শুনি, নারীদের ইজ্জতের বিনিময়ে। খুব মন খারাপ হয় তখন। নারীরা তো অত্যাচারিত হয়েছেন। ইজ্জত গেছে তাদের যারা অত্যাচার করেছে। স্বাধীনতালাভের পর তো নির্যাতিত নারীকে তার মা-বাবা, স্বামী ও সন্তানরা জায়গা দেয়নি। অনেকে নিজের পরিচয়ও লুকিয়ে রেখেছিলেন। এখন তাদের স্বীকৃতি দিয়ে সরকার সম্মানিত করছে। এটা দেখে ভালো লাগে। কিন্তু নারীদের বীরত্বের ইতিহাস তুলে ধরাসহ তাদের প্রতি আমাদের আরও অনেক দায়িত্ব পালন করতে হবে। সেটি পুরোপুরি হয়নি এখনো।’
অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ডালিয়া আহমেদ। সীমান্তবর্তী জায়গায় রেইকি করা, এক ক্যাম্প ও বাঙ্কার থেকে বিভিন্ন নির্দেশনা আরেক ক্যাম্প বা বাঙ্কারে পৌঁছে দেওয়াই ছিল কাজ। নারীদের অবদান প্রসঙ্গে অকপটে তিনি বলেন ‘একাত্তরে নারীরা যে কত রকমভাবে সাহায্য করেছে চিন্তা করা যাবে না। আমার আম্মা আশরাফুন্নেসা রাতভর রান্না করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়ে, শুকনো খাবার দিয়ে তাদের পালানোর পথ দেখিয়ে দিতেন। গোলাগুলি শুরু হলে মাথা ঠান্ডা রেখে তিনি বলতেন তুলা রাখ সবাই। যদি ওরা বোমা ফোটায়, গোলাগুলির শব্দে যেন বাচ্চাদের কানের ক্ষতি না হয়। মুড়ি, চিঁড়া আর গুড় আগেই প্যাকেট করে রেখে দিতে বলতেন। এরকম সাহায্য তো ঘরে ঘরে মা-বোনেরা করেছেন। দেশ থেকে সবাই তো যুদ্ধে চলে গেছে। কিন্তু মায়েরা, বোনেরা এই অবরুদ্ধ বাংলায় চরম নিরাশ্রয় অবস্থায় ছিল। হানাদারদের কাছ থেকে নিজেদের ও শিশুদের বাঁচানোটাই ছিল তখন আরেকটা যুদ্ধ। সে ইতিহাসের কথা কিন্তু তেমন তুলে ধরা হয়নি। নারী মুক্তিযোদ্ধার আলাদা করে কোনো লিস্ট করা হয়নি। বীরঙ্গনাদের অবদান অনেক পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাও বড় করে দেখতে চান না। স্বাধীনতা লাভের পর পরিবারও তাদের বিতাড়িত করেছে। একাত্তরের নারীদের নিয়ে গবেষণাও কম হয়েছে। এই কাজগুলোও তোমাদের করতে হবে। তা না হলে পূর্ণাঙ্গ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হবে না।’
সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা লাইলি বেগম আলাপচারিতায় তুলে ধরেন তার ওপর নির্মম নির্যাতনের করুণ কাহিনী। তার ভাষায়, ‘আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি, পিপিএম হাই স্কুলে। একটু দুষ্টু ছিলাম। কেউ অন্যায় করছে দেখলেই এগিয়ে যেতাম। বাবা আব্দুল লতিফ ছিলেন ফেঞ্চুগঞ্জে ফরিদপুর গ্রামের আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি বাড়িতে না থাকায় রাজাকাররা আমার চাচারে ধইরা নিতে চায়। সাহস করে সামনে গেলে আমারেও তুইলা নেয়। নিয়ে যায় কাইয়ার গুদামে।
ওটা ছিল পাঞ্জাবিদের টর্চার সেল। খুবই অন্ধকার জায়গা। ওই পরিবেশ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। মানুষের গোঙানির শব্দ পেতাম। আরও নারী ছিল। মাঝেমধ্যে তাদের কান্না আর চিৎকার সহ্য করতে পারতাম না। সেখানে আমার ওপরও চলে শারীরিক নির্যাতন আর অত্যাচার। সে নির্যাতন কোনোও নারীই মুখে বলে বুঝাতে পারবে না। এক মাস, চলে পালাক্রমে নির্যাতন। দুই তিনদিন পর মন চাইলে এক বেলায় দিত রুটির সঙ্গে একটু ডাল। একদিন শারীরিক নির্যাতনে অজ্ঞান হয়ে যাই। ওরা তখন আমারে এনে ফেলে দেয় মাইজগাঁও স্টেশনের পাশে। অতঃপর হাসপাতালে চলে দুই মাস চিকিৎসা। কাইয়ার গুদামের বড় বড় বাঙ্কার ছিল। সেখানে রাখা হতো শত শত নারীকে। স্বাধীনের পর আড়াই থেকে তিনশর মতো নারীকে বের করা হয়েছিল। আমার মাথায় কাটার দাগ এখনো আছে। বাইশটা শিলি পড়ছিল। দেখেন মুখে ক্ষত। বেয়োনেট দিয়ে পাঞ্জাবিরা গুঁতা দিছে। ডান হাতটা ভাঙ্গা। পায়ের ক্ষতি করছে। রানের ভেতরও বেয়োনেটের খোঁচার দাগ আছে অগণিত।’
এই বীর যোদ্ধা আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, ‘সরকার ভাতা দিচ্ছে বলে ভালো আছি। কিন্তু ওই কাইয়ার গুদামের পাশ দিয়ে গেলেই বুকের ভেতরটা ধক্ করে ওঠে। দেরিতে হলেও সরকার আমাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সম্মানিত করেছে। এটার কারণে বাইচা আছি। কিন্তু এখনো নির্যাতিত নারী হিসেবে আমরা অবহেলিত। পুরুষ মুক্তিযোদ্ধারা গর্বের সঙ্গে সব বিষয়ে আমাদের পাশে দাঁড়ান না। প্রধানমন্ত্রী গরিব মানুষকে ঘর করে দিচ্ছেন। কিন্তু আবেদন করেও একটা ঘর ভাগ্যে জোটেনি। সরকারের খাস জমিতেই ঘর তুলে আছি। তুলে দিলেই রাস্তায় নামতে হবে।’
মুক্তিযুদ্ধ ছিল পুরোপুরি একটি জনযুদ্ধ। এটি বাঙালির ইতিহাসে এক মহান অর্জন, গৌরবময় বিজয়গাথা। যে বিজয় বাঙালি জাতিকে উপহার দিয়েছে একটি মানচিত্র। আমাদের মানচিত্র ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের মানচিত্র। যার একটি বড় অংশই ছিল নারী। যারা যুদ্ধ করেছেন একাত্তরের প্রতি ক্ষণেই। মুক্তিযুদ্ধ ছিল নারী-পুরুষের সম্মিলিত লড়াই। তাই রক্তের মানচিত্রে নারীদের আত্মত্যাগ, বীরত্ব ও সাহসের ইতিহাসও তুলে ধরতে হবে প্রজন্মের মধ্যে। যার দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়, আপনার, আমার, সবারই।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৩০ মে ২০২২
© 2022, https:.