হুমায়ুনের ‘হনুমান কোম্পানি’
তার নাম ছিল কাজী আশরাফ হুমায়ুন। কিন্তু একটি ঘটনা বদলে দেয় সে নাম।
কীভাবে? এই বীর মুক্তিযোদ্ধার ভাষায়, ১৯৭০-এর নির্বাচনের পর সারাদেশে চলছে অসহযোগ আন্দোলন। মিছিল-মিটিং হলেই পুলিশ তখন গুলি চালাত। চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমরা একদিন মিটিং করি, কালিহাতির চারান এলাকায়। খুব লোকও হয়েছিল। সবকিছু উপেক্ষা করে মিছিলও বের করি।
পরে একদিন কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে যাই ঢাকায়, দেখা করি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। মিটিং-মিছিলের খবর শুনে উনি খুব খুশি হলেন। বসা থেকে উঠে সামনে দাঁড়ালেন। অতঃপর তার মুষ্টিবদ্ধ হাত বুকে হালকা স্পর্শ করিয়ে বললেন, ‘সাবাস বাঙাল।’ বলেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
ওই স্পর্শ ও স্মৃতি এখনও মনে হলে বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে। ওইদিনের পর নামের শেষে ‘বাঙ্গাল’ শব্দটা লাগাই। প্রথম সান্নিধ্যেই বদলে যায় পুরো নাম। এখনও ‘বাঙ্গাল’ বললে সবাই একনামে চেনে। ‘বাঙ্গাল’ শব্দটা শুনলে গর্বিত হই, তখন মনে পড়ে বঙ্গবন্ধুর কথা।
হুমায়ুন বাঙ্গালের বাড়ি টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলার বেতডোবা গ্রামে। একাত্তরে এগার নম্বর সেক্টরের কাদেরিয়া বাহিনীতে এই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন ‘হনুমান কোম্পানির’ কমান্ডার।
কোম্পানির নাম কেন এমন? মুচকি হেসে তিনি বলেন, একাত্তরে গোপালপুর ও তার আশপাশের এলাকায় প্রায়ই সশস্ত্র অপারেশন করতাম। আমাদের ভয়ে পাকিস্তানি আর্মিরা সবসময় তটস্থ থাকত। ওই সময় আর্মিরা মাইক মারে গোটা গোপালপুরে। জীবিত কিংবা মৃত আমাকে ধরিয়ে দিতে পারলে মিলবে দশ হাজার টাকা পুরস্কার!
পাকিস্তানি সেনারা আমার হুমায়ুন নাম উচ্চারণ করতে পারত না। বলত, হনুমান। আক্ষেপ করে বলত, ‘হনুমান কেসা চিজ!’
এরপর থেকে মানুষের মুখে মুখে আমার নাম হয়ে যায় ‘হনুমান’। এভাবে কোম্পানিরও নাম হয় ‘হনুমান কোম্পানি’।
একাত্তরে শত কষ্ট সহ্য করে জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তার ভাষায়, আমার গ্রুপে তখন ১৭০ জনের মতো যোদ্ধা। সরিষাবাড়ি, জামালপুর, মধুপুর ও গোপালপুর চতুর্দিক থেকে আর্মিরা ঘেরাও করে। তখন আশ্রয় নিই যমুনা নদীর বুকে, সুসুয়ার চরে। বড় গর্ত করে থাকি সেখানে। তিনদিন কোনো খাওয়া নেই।
চতুর্থ দিন একটা নৌকা ভিড়ালাম। নৌকার মাস্তুলে পাই মুঠার গুড়। নদীর পানি আর ওই গুড় খেয়ে ছিলাম কয়েকদিন। খায়েরপাড়া অপারেশনে সহযোদ্ধা সালাম চোখের সামনেই গুলি খেয়ে মারা যায়। ওর কথা মনে হলে এখনও বুকের ভেতরটা খামচে ধরে। একাত্তরে সহযোদ্ধা হারানোর কষ্টটা সহ্য করতে পারতাম না।
এই যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মের উদ্দেশে শুধু বললেন, “তোমরা নিজেদের কাজে সৎ থেকো। দেশের স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস জেনে নিও। মনে রেখো, এই দেশ তোমার মা। তাকে মায়ের মতোই ভালোবেসো। তাহলেই তুমি সামনে এগিয়ে যেতে পারবে।”
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজে টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ১৪ মে ২০২২
© 2022, https:.