শব্দদূষণ নিয়ে শব্দ নেই
রাজধানীর শব্দদূষণের বর্তমান অবস্থা কেমন? এই নগরে যারা চলাচল করেন তারা হয়তো একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেই এর উত্তরটি বলতে শুরু করবেন। নিজ বাসা যেহেতু ক্যান্টনমেন্ট-সংলগ্ন কাফরুল এলাকায়, তাই চলাচল করতে হয় ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের রাস্তা দিয়েই। দিনের বিশেষ সময়ে সেখানেও জ্যামের সৃষ্টি হয়। কিন্তু সেটি নিয়মতান্ত্রিকভাবেই ঠিক হয়ে যায়। ওভারটেকিং কিংবা অযথা হর্ন বাজানো থেকে সচেতনভাবেই সবাই বিরত থাকে সেখানে। কিন্তু ওই এলাকার বাইরে আসতেই অসহায় অবস্থায় পড়তে হয়। যানজটে শত শত গাড়ি ঠায় দাঁড়িয়ে। ক্যান্টনমেন্টের ভেতর থেকে আসা ওই একই চালক (প্রাইভেট কার, বাস ও সিএনজি) কারণে বা অকারণে ক্রমাগত হর্ন বাজাতে থাকেন। হর্ন বাজানোর লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য কি সেটি হয়তো সে নিজেই জানে না। হর্ন থাকা মানেই যেন সেটি বাজাতে হবে। হোক তা হাসপাতাল বা স্কুলের সামনের রাস্তা। এ নিয়ে কেউ কোনো তোয়াক্কাও করে না।
আবার ইদানীংকালে আরেক বিপত্তি ও যন্ত্রণার নাম হয়ে উঠেছে মোটরসাইকেল। জ্যাম দেখলেই সেটি উঠে আসে পথচারী চলাচলের রাস্তায়। ক্রমাগত হর্ন বাজিয়ে চলতেই যেন তাদের পছন্দ। কেউ প্রতিবাদ করলেও রক্ষা নেই। কাছাকাছি থাকা সব মোটরসাইকেলের চালকরা একত্র হয়ে প্রতিবাদকারীর ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এভাবে এ নগরে যত্রতত্র হর্ন বাজানোটা যেন চালকদের অধিকারে পরিণত হয়েছে। অথচ এটি কিন্তু ওই ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ঘটছে না। কেননা সেখানে আইনের মুখোমুখি হওয়ার ভয় থাকে। তাহলে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে হর্ন বাজানো নিয়ে আইনের কি কোনো প্রয়োগ নেই?
এই নগরে শব্দহীন জায়গা বা রাস্তা কোনটি? সাধারণ নিয়মে হাসপাতাল, মসজিদ বা বিদ্যালয়ের নিকটবর্তী রাস্তা শব্দহীন থাকার কথা। এ নিয়ে সরকারি নিয়মও আছে। কিন্তু সেটি কি বাস্তবে আছে? উত্তরটি এখন আর খুব সহজে দেওয়া একেবারেই সম্ভব নয়। কেননা নগরের কোনো জায়গা বা রাস্তা এখন আর শব্দের অত্যাচারমুক্ত নয়। বরং যত্রতত্র শব্দ সৃষ্টি করা প্রায় নাগরিক অধিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা উত্তরের মেয়র যানজট, জলজট ও মশক নিধনের প্রতিশ্রুতি ও পরিকল্পনার কথা সম্প্রতি গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরেছেন। সেটি অবশ্যই ভালো দিক। কিন্তু তার মুখে উচ্চারিত হয়নি নগরের শব্দদূষণ নিয়ে কোনো শব্দ। ফলে নাগরিকরাও জানে না শব্দদূষণ নিয়ে তাদের পরিকল্পনাগুলোর কথা, যা জানানো প্রয়োজন বলে মনে করেন সচেতন নাগরিকরা।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, শব্দের মাত্রা ৮৬ ডেসিবেল বা তার চেয়ে বেশি হলে তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আবাসিক এলাকায় শব্দের মাত্রা দিনের বেলা ৫৫ ডেসিবেল, রাতে ৪৫ ডেসিবেল হওয়া উচিত। আর বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৬৫ ডেসিবেল, রাতে ৫৫ ডেসিবেল; শিল্পাঞ্চলে দিনে ৭৫ ডেসিবেল, রাতে ৬৫ ডেসিবেলের মধ্যে শব্দমাত্রা থাকা উচিত। আর হাসপাতালে সাইলেন্স জোন বা নীরব এলাকায় দিনে ৫০, রাতে ৪০ ডেসিবেল শব্দমাত্রা থাকা উচিত। কিন্তু ঢাকায় এ মাত্রা নির্ধারিত মানদ-ের চেয়ে গড়ে প্রায় দেড় গুণ বেশি। উত্তরার শাহজালাল এভিনিউয়ে শব্দমাত্রা ৯৩ দশমিক ৫ ডেসিবেল, মিরপুর-১ এ ৯৬ ডেসিবেল, পল্লবীতে সর্বোচ্চ ৯১ দশমিক ৫ ডেসিবেল, ধানমন্ডি বালক বিদ্যালয়ের সামনে ১০৭ দশমিক ১, ধানমন্ডি ৫ নম্বর সড়কে সর্বোচ্চ ৯৫ দশমিক ৫, নিউমার্কেটের সামনে সর্বোচ্চ ১০৪ দশমিক ১, শাহবাগে সর্বোচ্চ ৯৭ দশমিক ৩ এবং সচিবালয়ের সামনে সর্বোচ্চ ৮৮ ডেসিবেল।
মাত্রাতিরিক্ত শব্দ মানবদেহে কী সমস্যা তৈরি করে? চিকিৎসকরা বলছেন, ক্রমগত একজন মানুষ উচ্চশব্দের মধ্যে থাকতে থাকতে তার শ্রবণশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এটি মানুষের ঘুমের সমস্যা তৈরি করাসহ উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ক্ষুধামান্দ্য ও উদ্বেগজনিত সমস্যার সৃষ্টি করে। শুধু তা-ই নয়, দিনের পর দিন শব্দদূষণের শিকার হলে শিশুদের মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতাও প্রবলভাবে লোপ পায়। স্কুল, কলেজ বা হাসপাতালের পাশে যে শব্দ হয়, সেখানে মানুষ মনোযোগ দিতে পারে না। এতে কাজের পারফরম্যান্স নষ্ট হয়। শব্দ মানুষের ব্রেনে সরাসরি আঘাত করে। ফলে, মানুষের মেজাজ বিগড়ে যায়, সব সময় সে অস্থিরতায় ভোগে। আবার সোশ্যাল ভায়োলেন্সেরও একটা বড় কারণ এই শব্দদূষণ।
কত ভাগ মানুষ শব্দদূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেটি নিয়ে তেমন গবেষণা নেই। তবে ২০১৬ সালের এক বেসরকারি গবেষণায় দেখা গেছে, সরাসরি এক-তৃতীয়াংশ মানুষ শব্দদূষণ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত। তবে এটির পরিমাণ বর্তমানে আরও বেড়েছে বলেই মনে করেন অনেকেই। তাই এ নিয়ে আরও গবেষণার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। শব্দদূষণ নিয়ে প্রচলিত আইন
থাকলেও সেটির প্রয়োগ নেই একেবারেই। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ক্ষমতাবলে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়েছে। বিধিমালায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে সেখানে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। সেটি অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদন্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদন্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে।
আইনে বলা হয়েছে, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়ের সামনে এবং আবাসিক এলাকায় হর্ন বাজানো, মাইকিং করা ও সেই সঙ্গে সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে জোরে শব্দ সৃষ্টি করা দন্ডনীয়। কিন্তু বাস্তবে সেই আইন প্রয়োগের খবর বছরে একটিও উঠে আসে না গণমাধ্যমে। ফলে আইনি বাধার মুখে না পড়ায় নাগরিকদের আইন না মানার প্রবণতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার ঢাকার শব্দদূষণের প্রধান কারণ যথেচ্ছাচারে যানবাহনে হর্ন বাজানো। ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনের ৮৮ ধারা অনুযায়ী, উচ্চমাত্রায় হর্ন বাজালে অনধিক তিন মাসের কারাদন্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা করতে পারবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ। অযথা হর্ন বাজানো বন্ধে পুলিশের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করা নেই, যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া প্রয়োজন।
শব্দদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব বায়ুদূষণের মতো খালি চোখে দেখা যায় না। কিন্তু এর ক্ষতিকর প্রভাব অনেক। আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা ছাড়াও শব্দদূষণ প্রতিরোধে বিশেষভাবে প্রয়োজন ব্যাপক পরিমাণ নাগরিক সচেতনতা সৃষ্টি করা, যা খুব সহজেই তৈরি করতে পারেন নগরের মেয়ররা। আশা করব নাগরিকদের অন্যান্য সমস্যা সমাধানের মতো শব্দদূষণ নিয়েও তারা উদ্যোগী হবেন। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে মেয়রদের শব্দ করার সময় এখনই।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২২ মে ২০২২
© 2022, https:.