আদিবাসীকলাম

সব জাতির অধিকার ও নির্লিপ্ততার গদ্য

বাঙালি ছাড়াও বাংলাদেশে বসবাস করে সাঁওতাল, গারো, কড়া, ওঁরাও, চাকমা, মারমা, হাজং, তঞ্চঙ্গ্যা প্রভৃতি অনেক জাতিসত্তার মানুষ। তাদের অনেকেরই রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত নিজস্ব আচার ও সংস্কৃতি। কালের বিবর্তনে এরা আজ সংখ্যালঘু। সংখ্যাগুরুদের প্রভাব ও নিপীড়নে তাদের অস্তিত্বই সংকটাপন্ন। ফলে লুপ্ত হচ্ছে তারা এবং তাদের ভাষা ও আচার। কিন্তু শত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও জাতিগুলো টিকে থাকার সংগ্রাম করছেন অবিরত। কীভাবে? সেটি জানাতে প্রাসঙ্গিক একটি ঘটনা তুলে ধরছি। বছরখানেক আগের কথা। গবেষণার কাজে পা রাখি দিনাজপুরের বিরল উপজেলায়, সাকইরডাঙ্গা গ্রামে। এ গ্রামেই বাস করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা খ্রীস্টফার মুর্মূ। জোয়াকিম মুর্মূ ও মারিয়া মার্ডির পঞ্চম সন্তান তিনি। তাদের ছিল ১২-১৩ বিঘা জমির গৃহস্থ। ওই গ্রামে তখন ৫০ ভাগই সাঁওতাল। সনাতন-রীতির বাহাপরব আর সোহরাই উৎসব চলত ধুমধামের সঙ্গে। লেখাপড়ার সুযোগ পান খ্রীস্টফার। হেঁটে ও নদী পার হয়ে যেতেন সেন্ট ফিলিপ স্কুলে। অবসর কাটত পাড়ার বাঙালি বন্ধু হাকিম, জব্বার, মন্ডল ও রমজানের সঙ্গে। জাতিভেদ তখনো এতটা পীড়াদায়ক নয়। আদিবাসী-বাঙালিতেও ছিল না কোনো সংঘাত। ফুটবল খেলা আর দল বেঁধে পুনর্ভবা নদীতে মাছ ধরার আনন্দের মধ্যেই কেটে যায় খ্রীস্টফারের শৈশব ও কৈশোর।

একাত্তরের ঘটনা। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের দিনাজপুর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকণ্ঠে, কুঠিবাড়িতে। ২৮ মার্চ, ১৯৭১। বাঙালি অফিসার ও জওয়ানদের বিরুদ্ধে ওখানে অস্ত্র ধরে পাঠান-পাঞ্জাবিরা। শুরু হয় গোলাগুলি। বাঙালি ইপিআর জওয়ানরা হাতিয়ারসহ বেরিয়ে আসে ব্যারাক থেকে। নিজের বাড়ি ফেলে খ্রীস্টফারও পরিবারসহ আশ্রয় নেন বর্ডারের কাছাকাছি, ধর্মজায়েন গ্রামে। অতঃপর মে মাসের প্রথম দিকে চলে যান ভারতে। তার ভাষায়, ‘সেখানে বেকার সময় কাটাচ্ছি। হঠাৎ দেখা জর্জদার (জর্জ আর এন দাশ) সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প করতে চাই। তোমরাও আসো।’ ফুপাতো ভাই পিউস হেমব্রম ও জন মার্ডিসহ পরদিনই চলে গেলাম শিববাড়িতে। তখনো ক্যাম্প হয়নি। কয়েকটি অস্ত্র সংগ্রহ করে জর্জদা ট্রেনিং শুরু করেন। ১৫-২০ দিনে শিখি শুধু লোড, আনলোড আর পজিশন। ধীরে ধীরে লোক বাড়তে থাকে। পরে আমাকে হায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয় ভারতের পতিরাম ক্যাম্পে। সেখানেই ট্রেনিং নিই এক মাস। ওই ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন ক্যাপ্টেন শ্রী হরি।’ ট্রেনিং শেষে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় সাত নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর হামজাপুরে। মুক্তিযোদ্ধা খ্রীস্টফার মুর্মূদের ১২ জনের দলের কমান্ড করতেন ইয়াকুব ও আনোয়ার। তারা অপারেশন করেন হিলি, স্কুলপাড়া, বিরলসহ দিনাজপুরের বিভিন্ন এলাকায়। বাঙালি বন্ধুদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন খ্রীস্টফার মুর্মূ। মৃত্যুকে তুচ্ছজ্ঞান করে স্বাধীনতা এনেছেন এই আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু স্বাধীন দেশে নিজের দুই একর ২৬ শতক জমি আজ স্থানীয় বাঙালিদের দখলে। আদালতের রায় পেলেও বুঝে পাচ্ছেন না সেই জমি। নিয়মিত পাচ্ছেন হুমকিও। আক্ষেপ নিয়ে তিনি শুধু বললেন, ‘আমার দেশের মাটি আমাকেই রক্ষা করতে হবে। তাই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছি। স্বাধীন দেশ পেলাম। কিন্তু স্বাধীন দেশে নিজেই আজ পরবাসী। এই দুঃখ কাকে বলব, দাদা।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা খ্রীস্টফার মুর্মূর কথার উত্তর আমাদের জানা নেই। এমন মানুষদের কান্নার শব্দ কি পৌঁছে রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের কাছে?

এ দেশে এখনো বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের ভূমির ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত হয়নি। বিশেষ করে সমতলের আদিবাসীদের অধিকাংশ জমি ছিল কালেক্টিভ। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পর সেগুলো জমিনদারি খাস হয়ে যায়। এখনো অনেক এলাকায় তারা থাকছে, চাষ করছে এমন জমিকে সরকার খাস হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ ছাড়া ব্যক্তিমালিকানার জমিগুলোও তারা দখলে রাখতে পারছে না। এ নিয়ে স্থানীয় বাঙালিদের সঙ্গে সংঘাত এবং হত্যার মতো সহিংসতাও ঘটছে হরহামেশাই। ছয় বছর আগে গাইবান্ধায় তিন সাঁওতাল হত্যার বিচার এখনো হয়নি। জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচার এবং জমি ফেরত, বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুরের ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়ে এখনো আন্দোলন করছে সেখানকার সাঁওতালরা। এ ছাড়া বাগদাফার্মে বাপ-দাদার জমিতে ইপিজেড করার বিরুদ্ধেও আন্দোলন করছে তারা। পূর্বপুরুষদের ভূমি রক্ষায় আন্দোলন করছে মধুপুরের মান্দি বা গারোরাও। দিনাজপুরে কড়াদের জমি নিয়েও স্থানীয় বাঙালিদের সঙ্গে চলছে বিরোধ। এ নিয়ে মারামারির ঘটনাও ঘটেছে সেখানে। এভাবে সমতলের বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষদের প্রতি বৈষম্য ও ভূমিকেন্দ্রিক অত্যাচারের ঘটনা চলছেই। সময় গড়িয়েছে। কিন্তু এ দেশে বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষদের জীবন আজও রয়েছে অসময়ের আবর্তে।

কিন্তু পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত জাতিসত্তার মানুষদের জীবনও কি একই আবর্তে প্রবহমান? সেটি জানতে খানিকটা পেছনে তাকাতে হবে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বরের কথা। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ‘জনসংহতি সমিতি’র শান্তিচুক্তি হয়। ফলে পাহাড়ে কয়েক দশকের সংঘাতের অবসান ঘটে। এ চুক্তির জন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ইউনেসকো শান্তি পুরস্কার’ লাভ করেন। কিন্তু সে শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান এখনো প্রায় ক্ষমতাশূন্য। ভূমিবিরোধের নিষ্পত্তি হয়নি আজও পর্যন্ত; বরং নতুন করে ভূমিবিরোধ তৈরি হচ্ছে। তুলে নেওয়া হয়নি সেনাবাহিনীর ক্যাম্পগুলোও। আবার নতুন করে সমস্যাও তৈরি হয়েছে পার্বত্য এলাকায়। সেখানে সেটেলার বাঙালিদের পুনর্বাসনের সময় প্রতিটি পরিবারকে কিছু জমির মালিকানা-সংক্রান্ত কবুলিয়তনামা দেওয়া হয়েছিল। এর অধিকাংশই তারা নিয়মবহির্ভূতভাবে বিক্রি করে দিয়েছে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠানের কাছে। বর্তমানে এই প্রভাবশালী চক্রের মাধ্যমে পাহাড়ে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন প্রকল্প। কয়েক বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক সংসদীয় কমিটির অনুসন্ধানেও বেরিয়ে এসেছে এমন তথ্য। তাই শুধু সেটেলার বাঙালিরাই নয়, পাহাড়ে এখন আদিবাসীদের বিরুদ্ধে শক্তি হিসেবে কাজ করছে ওই প্রভাবশালী ব্যবসায়ী চক্রও। এ ধরনের ভূমি দখলের কারণে সাজেক, রামগড়, মহালছড়ি, বরইতলীতে সংঘাত হয়েছে এবং এখনো তা থেমে নেই। এভাবেই আদিবাসীরা পাহাড়ে হারাচ্ছে ভূমির অধিকার। আবার নানা দলে ভাগ হয়ে চাঁদাবাজির ঘটনাও অশান্ত করছে পাহাড়কে। বাড়ছে রক্তপাত। পাহাড়ে বাড়ছে কান্না। এ ছাড়া পাহাড়ি-পাহাড়ি দ্বন্দ্ব, পাহাড়ি-বাঙালিদের রাজনৈতিক ইন্ধনে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে পার্বত্য অঞ্চলে। বাড়ছে হত্যা, অপহরণ ও ধর্ষণের মতো ঘটনাও। এভাবে বিভিন্ন জাতির মানুষরা আজ অবহেলা, বঞ্চনা আর অত্যাচারের মুখে হারিয়ে ফেলছে নিজেদের বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও। একটি স্বাধীন দেশে যা মোটেই কাম্য নয়।

বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষকে বিচ্ছিন্ন রেখে উন্নত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। তাই উচিত হবে তাদের ভূমির অধিকারের স্বীকৃতি প্রদানসহ শিক্ষা ও জীবনযাপনের অধিকারগুলো নিশ্চিত করা। সরকার আন্তরিক হলেই সেটি সম্ভব বলে মনে করেন আদিবাসী নেতারা। অসময়ের আবর্ত ভেঙে বেরিয়ে আসুক সব জাতির মানুষরা। স্বাধীন দেশে নিশ্চিত হোক সব মানুষের অধিকার।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১১ আগস্ট ২০২২

© 2022, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button