আমার গুলিতেই মোনায়েম খান মারা যায়– এটা ভাবলে এখনও গর্বিত হই। কিন্তু অপারেশনে আমি আর মোজাম্মেল ছাড়াও শাহজাহান, মোখলেস ও আব্দুল জব্বারের অবদানও কম ছিল না।
“ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় হই তিতুমীর কলেজে ভর্তি হয়েই। ছাত্র-সংসদের ভিপি তখন সিরাজুদ্দৌলা। স্বাধীনতা আন্দোলনে তিতুমীর কলেজ ছিল অন্যতম দূর্গ। নাম ছিল তখন জিন্নাহ কলেজ। এ কলেজ সৃষ্টির পেছনেও কারণ ছিল। ওইসময় জগন্নাথ কলেজে তুমুল ছাত্র-আন্দোলন চলত। পাকিস্তান সরকার চিন্তা করল এটাকে ভাগ করলে ছাত্রআন্দোলন স্থিমিত হয়ে যাবে। ওই চিন্তা থেকেই কলেজটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। আমরা ছিলাম ইন্টারমিডিয়েটের প্রথম ব্যাচ। কিন্তু এখানেও ছাত্ররা রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে সরকারের চিন্তা ভেস্তে যায়। সবাই যুক্ত ছিলাম ছাত্রলীগের সঙ্গে।
সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দল নির্বাচিত হলেও ক্ষমতা দেয় না পাকিস্তান সরকার। ফলে সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ছাত্র ধর্মঘটও চলছিল। কিন্তু শহীন স্কুলে ধর্মঘট হচ্ছিল না। আমিসহ চারজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয় সেখানে যাওয়ার। ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে দেশের কথা জানাব, ছাত্রছাত্রীদের ধর্মঘটে আসার আহবান জানাব– এমন পরিকল্পনা নিয়েই সেখানে যাই।
স্কুলটি ছিল পাকিস্তান এয়ারফোর্সের অধীনে। ফলে কর্তৃপক্ষ আমাদের আটকে রাখে। এ খবর চলে যায় তিতুমীর কলেজে। ফলে শত শত ছাত্র ছুটে আসে। ছাত্রদের প্রতিবাদের মুখে আমাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় শাহীন স্কুলের কর্তৃপক্ষ। দিনটির কথা এখনও মনে হয়। তখন সকল আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রদের ভূমিকাই ছিল মূখ্য।
১ মার্চ ১৯৭১। জেনালের ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে। সবার মনে তখন নানা উৎকণ্ঠা। কিছু একটা ঘটবে দেশে? গোটা দেশ অপেক্ষায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের। তিনি সেই নির্দেশ দেন ৭ মার্চ, রেসকোর্স ময়দানে।
বন্ধু মোজাফফর, নাজিমুদ্দিনসহ কালাচাঁদপুর থেকে ৫০-৬০ জনসহ সকালের দিকে হেঁটে চলে যাই সেখানে। সবার হাতে লাঠি। লাখো মানুষ জড়ো হয়েছে রেসকোর্সে। লাঠি দিয়েই যেন পাকিস্তানি সেনাদের পরাভূত করবে। মুখে মুখে তখনই উচ্চারিত হয় স্বাধীনতার কথা।
বঙ্গবন্ধু সরাসরি কিছু বললেন না। কৌশলে বাঙালির কষ্টের কথা তুলে ধরলেন। শেষে শুধু বললেন– ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সামনে কোনো বই নাই, খাতা নাই। সব কথা বঙ্গবন্ধু বললেন মন থেকেই। এ যেন এক ঐশ্বরিক ভাষণ। ওই ভাষণেই পুরো দিকনির্দেশনা পাই।
২৫ মার্চ ১৯৭১। রাতে শুনি গোলাগুলি শব্দ। ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যান্কগুলো বেরুনোরও শব্দ পাই। সারারাত চলে গুলির শব্দ। চারপাশে মানুষের আর্তনাদ। ভয়ে সবাই তটস্থ থাকি। কালাচাঁদপুরে আর্মি আসে ২৭ মার্চে। কিন্তু তার আগেই পরিবারসহ চলে যাই মামার বাড়ি, ছোলমাইদ গ্রামে।
কী হবে সামনে? কেউ জানে না। উৎকন্ঠা আর নানা শঙ্কা নিয়েই কাটে সময়।”
একাত্তরের নানা ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আনোয়ার হোসেন (বীরপ্রতীক)। এক সকালে তার বাড়িতে বসে দীর্ঘ আলাপ চলে একাত্তরের জানা-অজানা প্রসঙ্গে।
আব্দুল কাদির ও জহুরা খাতুনের দ্বিতীয় ও প্রথম পুত্র সন্তান আনোয়ার। বাবা ঠিকাদারি করতেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডে। আদি থেকেই তাদের বাস গুলশান থানাধীন কালাচাঁদপুরে।
লেখাপড়ায় হাতেখড়ি কালাচাঁদপুর প্রাইমারি স্কুলে। স্কুলটি পরে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত হয়। এরপর অষ্টম শ্রেণিতে তিনি ভর্তি হন তেজগাঁও পলিটেকনিক হাই স্কুলে। এসএসসি পাশ করেন ১৯৭০ সালে, ফার্স্ট ডিভিশন পান বিজ্ঞান বিভাগ থেকে। অতঃপর ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন তিতুমীর কলেজে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের ছাত্র।
আলাপচারিতায় ফিরে আসি একাত্তরে। ছোলমাইদ গ্রাম থেকে আনোয়াররা যুদ্ধে যাওয়ার নানা পরিকল্পনা করেন। তিনি বলেন, “বসুন্ধরা আবাসিক এলাকাটা তখন ছিল বড় বিল। বিলের মাঝে মাঝে শুকনা এলাকা ছিল। আমরা বলতাম, ডেংগা। সেখানে বসে যুদ্ধে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। মামাতো ভাই মো. গিয়াসউদ্দিন, মামা সম্পর্কের রহিমুদ্দিন, ওয়াকিল উদ্দিনসহ কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিই যুদ্ধে যাওয়ার।”
বর্ডার পার হয়ে তারা চলে যান কলকাতায়, কংগ্রেস ভবনে। সেখানে তখন অনেক লোক। ছাত্র হওয়ায় আনোয়ারদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় আগরতলায়, কলেজ টিলাতে। ওটা ছিল একটা হোস্টেল। খাবার দেওয়া হয় কাসার থালায় ভাত আর মাঝখানে সামান্য ডাল। তিতুমীর কলেজ ছাত্র সংসদের তৎকালীন ক্রীড়া সম্পাদক চন্দ্র কুমার সাহাও সেখানকার ব্যবস্থাপনায় যুক্ত ছিলেন। আনোয়ারের পরিচয় পেতেই ওইদিনই তাদের পাঠিয়ে দেন হায়ার ট্রেনিংয়ে, মতিনগর ট্রেনিং ক্যাম্পে।
বাকি ইতিহাস শুনি এই বীরপ্রতীকের মুখেই। তার ভাষায়, “মতিনগরটা ছিল একেবারে বর্ডারে। ওখানে আর্মির বাঙালি সদস্যরা বর্ডারে গিয়ে যুদ্ধ করত। আবার ফিরে এসে আমাদের ট্রেনিংও দিতো। ওখানে আমরা ছিলাম প্রথম ব্যাচ, ট্রেনিং করি তিন নম্বর প্ল্যাটুনে। শেখানো হয় চাইনিজ স্টেন, ইন্ডিয়ান স্টেন, গ্রেনেড থ্রো, পি-ফোর বোমা, ডিনামাইড, এক্সপ্লোসিভ ও নানা ধরনের অস্ত্র চালানো। ক্যাম্প ইনচার্জ ছিলেন লেফট্যানেন্ট দিদারুল আলম। ১৫ দিন ট্রেনিং হয় সেখানে। এরপরই ওই ক্যাম্পে পাকিস্তানি সেনারা আর্টিলারি শেলিং শুরু করে।
আমাদের দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হয় মেলাঘরে, ওখান থেকে একটু ভেতরে। তিন নম্বর প্ল্যাটুনসহ আরও কয়েকটা প্ল্যাটুন মিলে কোম্পানি গঠন করা হয় একটি। কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন ঢাকা কলেজের তৎকালীন ভিপি এম এ আজিজ (বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দিনের ভাই)। ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন সালাউদ্দিন। আমাদের প্ল্যাটুনের কমান্ড করতেন মায়া চৌধুরী (বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া)। মেলাঘরে ট্রেনিং চলে এক মাস।”
আনোয়ারদের ট্রেনিং শেষ হয় মে মাসের শেষের দিকে। এর পর গ্রুপ করে ভেতরে পাঠানো হয়। যেমন মায়া চৌধুরীর এক গ্রুপ, গাজী গোলাম দস্তগীরের এক গ্রুপ, আজিজ ভাইয়ের এক গ্রুপ, সালাউদ্দিনের এক গ্রুপ, জসিমের এক গ্রুপ এভাবেই আসে গ্রুপগুলো।
আপনাদের গ্রুপ ছিল কোনটি?
উত্তরে গেরিলা আনোয়ার বলেন, “তেজগাঁও এলাকাসহ বৃহত্তর তেজগাঁও ও ক্যান্টনমেন্টের আশপাশের এলাকা মিলিয়ে গেরিলাদের একটি বিশেষ গ্রুপ করা হয়। বলা হয় এটা ক্যান্টনমেন্ট বিশেষ গ্রুপ। কমান্ডার ছিলেন এম এ লতিফ। ডেপুটি কমান্ডার করা হয় রহিমুদ্দিনকে। গোয়েন্দাগিরি আর অর্থের দায়িত্বে ছিলাম আমি। ফেরদৌসকে দেওয়া হয় সাংগঠনিক দায়িত্ব। মোজাম্মেল ও মামাতো ভাই গিয়াসসহ প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় ২০ জনের গেরিলা দল ছিল এটি। অস্ত্র ছিল ইন্ডিয়ান স্টেনগান, এসএলআর, হ্যান্ড গ্রেনেড, পিকে ফোর বোম, অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন, ডেটনেটরসহ এক্সপ্লোসিভ প্রভৃতি। মোজাম্মেল হক (বীরপ্রতীক) আমার মামাতো ভাই গিয়াসউদ্দিনের চাচাতো ভাই।
আসার আগে এ টি এম হায়দার সাহেব একটা ব্রিফ করে বলেন, তোমরা ক্যান্টনমেন্টের পাশের গ্রুপ। তাই বিশেষভাবে গভর্নর মোনায়েম খানের মতো কট্টর পাকিস্তানিদের অপারেশন করবে। গুলশানে চার্জ করবে গ্রেনেড। একটা মাইন আছে এম সিক্সটিন। প্রচণ্ড শব্দ হয়। ওটা হিট করবে যাতে এলাকায় একটা প্যানিক তৈরি হয়। সবাই যেন বুঝে যায় মুক্তিযোদ্ধারা সব জায়গায় আছে।”
আনোয়ারদের গেরিলা গ্রুপটি জুন মাসের প্রথম দিকে ভেতরে ঢোকে।
গেরিলারা অস্ত্র রাখতেন কোথায়?
আনোয়ারের উত্তর, “নির্দেশ ছিল এক জায়গায় অস্ত্র না রাখার। সামাদ ব্যাপারীর বাড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় আমরা থাকতাম। রাতের বেলায় বের হতাম অপারেশনে। ছোলমাইদেও ছিল একটা অস্থায়ী ক্যাম্প, কমান্ডার রহিমুদ্দিনের খালার বাড়িতে। ওখানে থাকত স্টেনগানসহ কিছু অস্ত্র। গেরিলাদের অস্ত্র ডিস্টিবিউশন করা হতো সেখান থেকেই। পরে ইছাপুরায় একটা ক্যাম্প করি। রাতে ভেতরে ঢুকতাম। প্রথমদিকে আমরা গ্রেনেড চার্জ করি গুলশানের বিভিন্ন জায়গায়। এর পরই মোনায়েম খানকে অপারেশন করি।”
ভিডিও-১৩ অক্টোবর ১৯৭১: কীভাবে গর্ভনর মোনায়েম খানকে অপারেশন করেন গেরিলারা?
মোনায়েম খান ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর, কট্টর পাকিস্তানি এক দালাল। পাকিস্তানি সামরিক শাসক আইয়ুব খানের ঘনিষ্ঠ সহায়তাকারীও ছিল মোনায়েম খান। নানা কাজের জন্য তিনি তখন বাঙালিদের কাছে কুখ্যাত হিসেবে পরিচিতি পান। আনোয়ারদের গ্রুপটি তাকে অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই অপারেশনের সফলতায় সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও বীরত্বের বর্হিপ্রকাশ ঘটে। এ খবর ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। কঠোর নিরাপত্তা ভেদ করে কীভাবে মোনায়েম খানকে মেরেছিলেন আনোয়ার ও মোজাম্মেল হকের মতো গেরিলারা? আনোয়ারের মুখেই শুনি ওই অপারেশনের আদ্যোপান্ত।
তিনি অকপটে বলেন, “আমি ও মোজাম্মেল হক (বীরপ্রতীক) অপারেশনের প্ল্যান করি আমাদের কমান্ডার ও ডিপুটি কমান্ডারের সঙ্গে। মোজাম্মেলের চাচা আবদুল জব্বারের আসা-যাওয়া ছিল মোনায়েম খানের বাড়িতে।”
কীভাবে?
“তার কিছু গরু ছিল। তিনি গরুর দুধও বিক্রি করতেন। মোনায়েম খানের বাসায়ও ছিল অনেক গরু। সেখানকার দুধও বিক্রির জন্য আসতো তার কাছে। সে হিসেবে ওই বাসার কাজের লোকদের সাথে পরিচয় ছিল তার। ওই বাড়িতে কাজ করতেন দুজন– শাহজাহান ও মোখলেস। এরা মোনায়েম খানের বাড়ি ও গরুগুলো দেখাশোনা করতেন।
জব্বারের মাধ্যমে আমরা তাদের সঙ্গে বসতে চাই। একদিন ছোলমাইদে তারা দুজন আসেন। সেখানে কারী নামে এক মামা থাকতেন। তার বাসায় বসেই কথা হয়। মোটিভেশন দেই তাদের। বোঝাই, যুদ্ধ চলছে। পাকিস্তানিরা শত শত লোককে মারছে। কট্টর পাকিস্তানি দালাল মোনায়েম খান। তাকে মারতে আমাদের সাথে থাকো, তাহলে তোমরা মুক্তিযুদ্ধের একটা অংশ হবে। তোমাদের নাম ইতিহাসে থাকবে। তারাও কিছুটা কনভিন্স হয়।
কয়েকদিন পরেই জানায়, ঠিক আছে, আপনারা আসেন।
শুধু দেশ প্রেমের খাতিরেই শাহজাহান ও মোখলেস ওই অপারেশনে আমাদের সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন। স্বাধীনতা তখন ছিল একটা স্পিরিট।
মোনায়েম খানের বাড়ির পুরা নকশা তৈরি করা হয় তাদের দেওয়া নানা তথ্যের ভিত্তিতে। বাড়ির চতুর্দিকে দেয়াল, ওপরে কাঁটাতারের বেড়াও ছিল। পাকিস্তানি সেনা ও পুলিশ সার্বক্ষণিক প্রহরায়। একটা দেয়ালের মাঝখানটা ভাঙ্গা। পিলার কোনোভাবে ভেঙ্গে গিয়েছিল। ওটা দিয়ে অনায়াসে একজন ঢুকতে পারবে। আগে রেইকি করতে গিয়ে ওটা আমাদের নজরে আসে। ফলে সে সুযোগটিই নিই আমরা। অপারেশনের তারিখ ও সময় ঠিক করে জানিয়ে দিই সবাইকে।
বনানী কবরস্থানে তখনও খুব বেশি কবর হয় নাই। ওখানে খুব জঙলা ছিল। আমরা একত্রিত হবো সেখানেই। আরেক সহযোদ্ধা নুরুল আমিন, সেও থাকবে। মোজাম্মেল তার মতো করে পৌঁছে যাবে সেখানে। মোনায়েম খানের বাড়িটি ছিল কবরস্থান সংলগ্ন।
ছোলমাইদে আমাদের অস্থায়ী ক্যাম্প থেকে আমি স্টেনগান আনি ফোল্ড করে, চটের ব্যাগে। গ্রেনেড ও পি-ফোর বোমও নিই। পি-ফোরকে ফসফরাস বোমা বলে। ওটার পিন খুলে থ্রো করলেই আগুন জ্বলে উঠবে।
কেউ যেন আমাকে লোকেট করতে না পারে সে কারণে সহযোদ্ধা ও মামাতো ভাই গিয়াস ও রফিকুলকে চটের ব্যাগটা দিয়ে বলি, এটা পরে আমার কাছে পৌঁছে দিতে। তারিখটা ১৩ অক্টোবর ১৯৭১। সন্ধ্যার পর রওনা হই। অপারেশনটা হয় আনুমানিক রাত সাড়ে আটটার দিকে। গুলশান দুই নম্বরে তখন বড় কাঁচাবাজার ছিল। মিলিশিয়ারা পাহারা দিতো গুলশান এলাকাটা। আমি বাজারে যেতেই গিয়াসরা চটের ব্যাগটা পৌঁছে দেয়। ব্যাগের ভেতর পুঁইশাক ও কিছু সবজি কিনে রাখি। পরনে কালো শার্ট আর একটা লুঙ্গি, হাতে ব্যাগ। বোঝার উপায় নেই মুক্তিযোদ্ধা। অতঃপর ব্যাগ নিয়ে একটা রিকশায় বনানী ব্রিজ পার হয়ে পৌঁছি বনানী কবরস্থানের ওখানে। মোজাম্মেল ও নুরুল আমিন আমার অপেক্ষায় ছিল।
স্টেনগানটা নিই আমি, আর মোজাম্মেলকে দিই হ্যান্ড গ্রেনেডটা। ফায়ার করার পরেও যদি কোনো সমস্যা হয় তাহলে সে গ্রেনেড থ্রো করবে। এমনটাই পরিকল্পনা করি। নুরুল আমিন সেখান থেকেই তখন সরে যায়। ভেতরে ঢুকি আমি আর মোজাম্মেল।
কবরস্থানের দেয়ালঘেষা মোনায়েম খানের বাড়ির দেয়ালের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে ভেতরে ঢুকে আমরা কলাগাছের বাগানে অপেক্ষায় থাকি।
শাহজাহান এসে বলে, ‘আপনারা এখানেই বসেন। সাহেব এখনও উপর থেকে নামেন নাই’।
জাস্ট ১০ মিনিট পরেই সে ফিরে এসে বলে, ‘সাহেব নামছে’।
মোনায়েম খানের পজিশনটা আমরা জানতে চাইলাম। সে বলে, ‘পশ্চিম দিকে মুখ করা তিনজন লোকের মধ্যে মাঝখানেই সাহেব বসা’।
আমরা আর দেরি করি না। ভয় বলতে কিছুই ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে মরলে নাম ইতিহাসে থাকবে। এই কথা দারুণভাবে ভেতরে গাথা ছিল।
স্টেনগান নিয়ে নিচতলায় ড্রইং রুমের দরজা ঢেলে ঢুকে যাই। মাত্র ১৫ ফিট সামনে তারা। মাঝের ব্যক্তিকে টার্গেট করেই গুলি করি। সঙ্গে সঙ্গে মোনায়েম খান সামনের দিকে উপুড় হয়ে পড়ে যায়, একটা চিৎকারও দেয়। এইটুকু এখনও স্মৃতিতে আছে। পেছনে ব্যাক করতেই মোজাম্মেল সঙ্গে সঙ্গে গ্রেনেড চার্জ করে। কিন্তু গ্রেনেডটা কোনো কারণে বার্স্ট হয় না। ফলে বাকিরা অক্ষত থাকে। পরে শুনেছি মোনায়েম খানের সাথে (দুই পাশে) ছিল প্রাদেশিক শিক্ষা মন্ত্রী আমজাদ হোসেন আর মেয়ের জামাই জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল। কিন্তু তারা আমাদের টার্গেটে ছিল না। ফলে শুধু মোনায়েম খানকেই আমরা হিট করেছি।
বাড়ির পাশেই আর্মিদের ঘাঁটি ছিল। ফায়ারের আওয়াজ পেয়েই ওরা এলোপাথারি গুলি করতে থাকে। কবরস্থান থেকে দ্রুত বের হয়ে শাহাজাহানসহ আমি একদিকে, মোখলেস একদিকে আর মোজাম্মেল আরেকদিক দিয়ে সরে পড়ে। প্রথম ছোটবোনের বাড়িতে, পরে চলে যাই ছোলমাইদে কারী সাহেবের বাড়িতে। অপারেশন শেষে ওখানেই একত্রিত হওয়ার কথা ছিল।”
মোনায়েম খান মারা গেছে এটা আনোয়াররা জানেন পরদিন, রেডিওর সংবাদে। আশপাশের লোকেরাও আলাপ করছিল– ‘মোনায়েম খানরে মুক্তিযোদ্ধারা মাইরা ফেলছে।’ আনোয়াররা তখন তৃপ্তির হাসি হাসেন। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে খবরটি।
কেমন লেগেছিল তখন?
তিনি বলেন, “মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সাহসী– ওই অপারেশনের মাধ্যমে এটাই প্রতীয়মান হয়। আমার গুলিতেই মোনায়েম খান মারা যায়– এটা ভাবলে এখনও গর্বিত হই। কিন্তু অপারেশনে আমি আর মোজাম্মেল ছাড়াও শাহজাহান, মোখলেস ও আব্দুল জব্বারের অবদানও কম ছিল না। তারা সহযোগিতা না করলে হয়তো অপারেশনটিই করা যেত না। শাহজাহান এখন বেঁচে নেই। সে মুক্তিযোদ্ধা হতে পারলেও মোখলেসের নাম আসেনি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়। মোখলেস এখন অসুস্থ, থাকেন কুমিল্লাতে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছেন। কিন্তু তাদের মূল্যায়ন আমরা করতে পারিনি ভাই।”
যে দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সে দেশ কি পেয়েছেন?
“স্বপ্ন আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। সার্বভৌম একটা দেশ পেয়েছি। সারা বিশ্বে বাংলাদেশের নাম প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এক কোটি লোক এখন বিদেশে থাকেন। অর্থনৈতিকভাবেও দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এটা দেখলে ভালো লাগে।”
খারাপ লাগে কখন?
অকপটে এই বীর বলেন, “দেশের অর্থনীতি মাত্র কয়েকটা গ্রুপের কাছে আটকে আছে। ফলে তারা ইচ্ছা করলেই জিনিসপত্রের দাম বাড়াতে পারে। যেকোনো সরকার আসুক, তাদের কাছে জিম্মি হয়েই থাকতে হয়। এটা দেখলে কষ্ট হয়। আগে পার্কে বসলে ঝালমুড়ি বিক্রি করতে আসত একটা শ্রেণি। আজকে সেটা পাবেন না। আজকে ঝালমুড়িও বিক্রি করে বড় বড় কোম্পানি। ফলে ছোট ছোট পুঁজির মানুষ বসে যাচ্ছে। কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছেই পুঁজি গচ্ছিত হয়ে যাচ্ছে। এটা ভাঙা উচিত। তা না হলে দেশে ক্রাইসিস তৈরি হবে। আর ব্যবসায়ী নয়, রাজনীতিবিদকেই নেতা বানাতে হবে।”
প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের ইতিহাস জানানো খুবই জরুরি বলে মনে করেন এই সূর্যসন্তান। বলেন, “যে জাতি তার গুণীজনকে সম্মান করে না, সে জাতিও সম্মানিত হয় না। প্রত্যেক জাতির একটা ইতিহাস থাকে। বাংলাদেশ কোথা থেকে, কীভাবে এলো, কোন আদর্শে এই দেশ সৃষ্টি হলো– এটা জানাতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে কারা জীবন দিয়েছে, কেন জীবন দিয়েছে সেটা না জানলে তো আদর্শ মানুষও তৈরি হবে না।”
চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আনোয়ার হোসেন (বীরপ্রতীক) প্রজন্মের উদ্দেশেই বললেন শেষ কথাগুলো, ঠিক এভাবে, “তোমরা দুর্নীতি মুক্ত ও আদর্শবান মানুষ হইও। মুক্তিযোদ্ধারা কেন একাত্তরে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে– সেটি জেনে নিও। নিজের স্বার্থে টাকা উপার্জনের প্রতিযোগিতায় নেমো না। একটা সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে তোলার দায়িত্ব তোমাদেরকেই নিতে হবে। তোমরাই গড়বে অন্যরকম বাংলাদেশ।”
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ১৬ অক্টোবর ২০২২
© 2022, https:.