কলাম

দেশের ছয়টি ফেইসবুক গ্রুপের অনন্য অর্জন

ফেইসবুক শিল্প-সাহিত্যকে শেষ করে দিচ্ছে বলে ঢালাওভাবে অভিযোগ করা হতো কয়েক বছর আগেও। প্রতিষ্ঠিত লেখক ও কবিদের অনেকেই বলতেন, অনলাইনে যে সাহিত্যচর্চার চেষ্টা হচ্ছে তা মূলত সাহিত্যের বারোটা বাজাচ্ছে, এগুলো কোনো সাহিত্য নয়। লেখালেখির জন্য উপযুক্ত জায়গা অনলাইন নয় এবং সাহিত্যের মান বাঁচাতে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা উচিত বলেও মত দিতেন অনেকে।

কয়েক বছর আগের ধারণাটি যে ভুল ছিল এখন তা অনেকের কাছেই স্পষ্ট। সময় শিল্প-সাহিত্য ও ভাষাকে যেমন বদলে দেবে, তেমনি বদলে দেবে এর প্ল্যাটফর্মও। তাই লেখা কোথায় প্রকাশ পেল, কোথায় পাঠক বেশি পড়ল, সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রকৃত অর্থেই লেখার গুণ বিচার প্রয়োজন।

পুরনো সময়টা এখন নেই। অনলাইনে ফেইসবুকে রয়েছে সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার ছোট-বড় অসংখ্য গ্রুপ। ফলে এখানে যুক্তদের এখন আর খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। বরং যারা সেখানে যুক্ত থেকে বাংলা ভাষায় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সৃজনশীলতার চর্চা করছেন তাদের হাত ধরেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে আমাদের শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি। অতি সম্প্রতি ফেইসবুকের একটি ঘোষণা অনলাইন প্ল্যাটফর্মের নানা কার্যক্রমকে আরও আশাবাদী করে তুলেছে।

ফেইসবুকের সেই ঘোষণাটি কী? ফেইসবুকের মাদার কোম্পানি মেটার কমিউনিটি এক্সেলারেটর প্রোগ্রামের জন্য এ বছর ফেইসবুক কমিউনিটি গ্রুপ গড়ে তোলার মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব রেখেছে সারা বিশ্ব থেকে এমন প্রায় ৫ হাজারটি উদ্ভাবনী গ্রুপ আবেদন করে। সেখান থেকে প্রোগ্রামটির জন্য ১৩৫টি ফেইসবুক গ্রুপকে মনোনীত করা হয়েছে। যার মধ্যে এশীয়-প্রশান্ত মহাদেশীয় কমিউনিটি অঞ্চলে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের ৬টি গ্রুপ, ফিলিপাইনের ৭টি ও ইন্দোনেশিয়ার ৩টি গ্রুপসহ মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের একটি করে গ্রুপও রয়েছে। বাংলাদেশের ৬টি উদ্ভাবনী গ্রুপ হলো ‘কাস্টওয়ে অন দ্য মুন’, ‘পেন্সিল’, ‘ফুড ব্যাংক’, ‘ওমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ট্রাস্ট’, ‘স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ার’ ও ‘অপরাজিতা’।

কাস্টওয়ে অন দ্য মুন গ্রুপটি মূলত কাজ করে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মানুষের মেধা নিয়ে, ফুড ব্যাংক খাবারের রিভিউ নিয়ে। ওমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ট্রাস্ট ও অপরাজিতা দুটিই নারীকেন্দ্রিক গ্রুপ। অসংখ্য নারীকে ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার অনুপ্রেরণা দিচ্ছে তারা। স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ার গ্রুপটি প্রকৌশলবিষয়ক প্রতিভা তুলে ধরতে কাজ করছে। এ ছাড়া শিল্প-সাহিত্য নিয়ে কাজ করছে পেন্সিল গ্রুপটি।

ফেইসবুকের ঘোষণায় স্বীকৃতি এই ৬টি গ্রুপের মধ্যে শিল্প-সাহিত্য নিয়ে কাজ করা পেন্সিল গ্রুপটির কার্যক্রম কিছুটা তুলে ধরছি।

সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইনে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চায় আলোচিত গ্রুপ পেন্সিল। মূলত বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে বসবাসকারী বাংলা ভাষাভাষীদের অনন্য প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে এটি। মননে ও মানসিকতায় মেলবন্ধন খুঁজে পাওয়া কিছু মানুষের স্বপ্ন নিয়ে গড়ে ওঠে পেন্সিল। আলো ছড়ানো, পরিচ্ছন্ন মতবিনিময়ের জন্য লেখিয়ে এবং পাঠকদের নিয়েই শুরু হয় এটি। নানা বয়সের, নানা মতাদর্শের, নানা রঙের মানুষের সমাবেশ এখানে। বলা যায় স্বপ্ন, আবেগ এবং প্রত্যাশার সমন্বয়ের নাম পেন্সিল, যা লাখো মানুষকে আলোকিত করছে। এদের চাওয়া-পাওয়াও খুব সামান্য। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি জীবনের সময়গুলোকে সৃজনশীলতায় পূর্ণ করে একটি নান্দনিক সমাজ গড়ে তোলা। পেন্সিল নিয়ে এভাবেই বক্তব্য তুলে ধরেন পেন্সিল গ্রুপের অন্যতম অ্যাডমিন লেখক মাহরীন ফেরদৌস।

স্বরচিত গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, জোকস, ট্রাভেলগ, নিজের তোলা ছবি, নিজের গাওয়া গান, নিজের করা আবৃত্তি, ক্রিয়েটিভ ওয়ার্ক এবং নিজের রান্না, আইনি বৃত্তান্ত, স্বাস্থ্য টিপস, ইন্টেরিয়র প্রভৃতি বিষয়ে গ্রুপের নিয়ম মেনে পোস্ট করা যায় পেন্সিলের ফেইসবুক গ্রুপে। বাংলা ভাষাভাষী লেখক, গায়ক, চিত্রশিল্পী, আলোকচিত্রশিল্পীসহ ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির সৃজনশীল কিছু মানুষ নিয়ে পেন্সিলের যাত্রা ২০১৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। বর্তমানে এ ফেইসবুক গ্রুপে যুক্তদের সংখ্যা তিন লাখ বিরানব্বই হাজার জন। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে বসবাসরত বাঙালিরা যুক্ত রয়েছেন এখানে।

শুধু অনলাইনেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেননি তারা। অফলাইন কার্যক্রম এগিয়ে নিতে গড়ে তুলেছেন পেন্সিল ফাউন্ডেশন। শুরু থেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে বই ও ম্যাগাজিন প্রকাশ করলেও এর প্রকাশনা বিভাগ ‘পেন্সিল পাবলিকেশনস’ নামে নিবন্ধিত হয়ে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অংশ নেয় ২০১৯ সালে। পেন্সিলে মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে মন খুলে লিখতে পারে। অনেকেই ওই লেখা নিয়ে আলোচনা করেন। লেখা ও আলোচনায় অংশ নিতে পারেন সারা পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষীরা। ফলে ব্যাপক পরিসরে অনলাইনে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার একটি ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। শুধু সাহিত্য নয় শিল্পচর্চার অংশ হিসেবে তারা শুরু থেকেই সদস্যদের তোলা ছবি নিয়ে নিয়মিতভাবে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে আসছে, যা ফটোগ্রাফিচর্চায় অনেককেই উৎসাহিত করেছে।

পেন্সিল মানবিক কাজেও পিছিয়ে নেই। বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, করোনা মহামারীতে সাধারণ সদস্যদের থেকে ফান্ড সংগ্রহ করে ৫০০টি পরিবারকে সহায়তা প্রদান, বৃক্ষরোপণের কর্মসূচির আয়োজন করা এবং দেশীয় ও পরিযায়ী পাখির নিরাপদ অবস্থানের জন্য জনসাধারণকে সচেতন করতে রাজশাহীর পদ্মার পাড়ে সাইনবোর্ড স্থাপন প্রভৃতি কাজ করেছে পেন্সিল ফাউন্ডেশন। এভাবে নানা কাজের মাধ্যমে লাখো মানুষের চিন্তা, চেতনা ও ভালোবাসার রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে পেন্সিল গ্রুপটি।

পেন্সিলের মতো বাংলাদেশের উদ্ভাবনী ৬টি গ্রুপের জন্য কী করবে ফেইসবুক?

এ নিয়ে কথা হয় পেন্সিল গ্রুপটির অন্যতম ক্রিয়েটর লেখক এস এম নিয়াজ মাওলার সঙ্গে। তার ভাষায়, “গ্রুপগুলোকে মেটা’র তরফ থেকে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার ডলার অনুদান প্রদান করাসহ আগামী ৪ নভেম্বর সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিতব্য মেটার ‘কমিউনিটি পার্টনারশিপ ডিলস রিজিওনাল পার্টনার ইভেন্ট’-এ অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবেন গ্রুপ অ্যাডমিনরা। অনুদানের অর্থে গ্রুপগুলো তাদের কমিউনিটির মাধ্যমে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে সে উদ্দেশ্যে কাজ করতে পারবেন। কমিউনিটি লিডারদের ট্রেনিংও দেওয়া হবে।”

সিঙ্গাপুরে ফেইসবুকের অনুষ্ঠানে নিয়াজসহ অংশ নেবেন বাংলাদেশের ৬টি গ্রুপের অ্যাডমিন। এ নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে নিয়াজ অকপটে বলেন, ‘আমরা খুবই খুশি। মনোনীত হওয়ার প্রক্রিয়া খুব সহজ ছিল না। অনেকগুলো কঠিন ধাপ অতিক্রম করতে হয়েছে। এই অর্জন দীর্ঘদিনের কাজের ফসল। অনলাইনে যারা লেখালেখি করছেন তাদেরও এক ধরনের স্বীকৃতি। এ সফলতা পেন্সিলের সঙ্গে যুক্ত সব সদস্যের। ফেইসবুকের এ প্রোগ্রাম বাংলাদেশে অনলাইন কমিউনিটিকে আরও ভালোভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।’

প্রথমবারের মতো পেন্সিধলসহ বাংলাদেশের ৬টি ফেইসবুক গ্রুপের এমন অর্জন খুব ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। বাংলাদেশে ফেইসবুক কমিউনিটি গ্রুপ গড়ে তোলার মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব রাখছে এমন গ্রুপ রয়েছে অনেক। ফেইসবুকের এমন উদ্যোগের ফলে কমিউনিটির উন্নয়নে কাজ করা গ্রুপগুলো আরও উৎসাহিত হবে এবং নিজেদের লক্ষ্য পূরণে তারাও সক্রিয় থাকবেন এমনটিই আশা।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৭ অক্টোবর ২০২২

© 2022, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button