পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহে এয়ারফোর্সের বৈমানিকদের ভূমিকা কী ছিল আর কারা কীভাবে সেসব পরিকল্পনা করেছিলেন? লেখক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক সালেক খোকনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেসব জানিয়েছেন বিমান বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ইকবাল রশীদ
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ইকবাল রশীদ একাত্তরে ছিলেন পাকিস্তান এয়ারফোর্সের পাইলট অফিসার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধ করেন ৬ নম্বর সেক্টরে। চিলাহাটি সাবসেক্টরের কমান্ডার ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ইকবাল রশীদ বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে প্রথমে নিযুক্ত হন এপিএম (অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রভোস্ট মার্শাল) হিসেবে। ওটা ছিল এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি। তিনি উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহর কমান্ডে থাকতেন। ইংল্যান্ডের রানি বঙ্গবন্ধু সরকারকে দুটো হেলিকপ্টার উপহার দেন। ওই দুটোর ওপর ট্রেনিং
নিতে ইকবাল রশীদসহ এ বি এম বাশার, উইং কমান্ডার মঞ্জুর, এয়ার কমোডর শমশের চলে যান ইংল্যান্ডে, ১৯৭৩ সালে। ফিরে এসে তিনি এপিএম পদে আর থাকেননি, ফ্লাইং করা শুরু করেন। মূলত তিনি ছিলেন হেলিকপ্টার পাইলট। আর্মি ও ভিআইপি সাপোর্টের জন্য ফ্লাই করতেন।
জাতির পিতাকে হত্যা এবং খন্দকার মোশতাকের সরকারকে মেনে নিতে পারেননি ইকবাল রশীদসহ এয়ারফোর্সের অনেকেই। যার ডাকে তারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তাকেই স্বাধীন দেশে হত্যা করা হলো! মনে মনে প্রতিশোধের আগুন তাদের ভেতর দানা বাঁধতে থাকে। কিন্তু এরপরই তারা দেখেন বেইমান নেতাদের কীর্তি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগের মেজরিটি নেতাই মোশতাককে স্বীকৃতি দেন।
ওই সময়ে বিমানবাহিনীতে কী পরিস্থিতি বিরাজ করছিল?
ইকবাল রশীদ বলেন: এসব নিয়ে মনটা খুবই খারাপ থাকত। এদিকে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করায় পাকিস্তানফেরত অনেক অফিসারই খুব খুশি। মস্কোতে এয়ারফোর্সের একটা গ্রুপ ছিল ট্রেনিংয়ে। শুনেছি বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর শুনে তারা সেখানে সেলিব্রেটও করেছেন। আমি নিজের মতো করে থাকি। নিজেদের মধ্যে গোপনে নানা আলোচনাও করতাম। আর ভেতরে-ভেতরে প্রতিশোধের প্ল্যাটফর্ম খুঁজতে থাকি। সেই প্রতিশোধের প্রস্তাব আসে সেপ্টেম্বর মাসেই।
প্রস্তাবটি কার কাছ থেকে পেয়েছিলেন?
ইকবাল রশীদের ভাষায়: স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত আলী খান ছিলেন মিগ টোয়েন্টি ওয়ানে, আমার সিনিয়র। বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীরউত্তম খেতাবও পেয়েছেন। তিনি একদিন অফিসে এসে বলেন, ‘উই হ্যাভ টু ডু সামথিং।’
আমি বলি, ‘ডু হোয়াট?’
উনি উত্তরে বলেন, ‘এরা দেশটাকে পুরা ইসলামিক স্টেটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সব জায়গা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আস্তে আস্তে সরিয়ে দিচ্ছে। এটা তো চলতে পারে না।’
তিনি প্রস্তাব রেখে বলেন, ‘তুমি হেলিকপ্টার সাপোর্ট দিতে পারবে?’
সবকিছু বুঝে গেলাম। বুকের ভেতর তখন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধের আগুন। আমি শুধু ৪৮ ঘণ্টা সময় চেয়ে নিলাম। জানতে চাইলাম, ‘এটার লিড করবে কে? তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমান।’ এটুকুই কথা হলো।
এরপর আমি গেলাম বাশার সাহেবের (মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার) কাছে। তিনি তখন এয়ারফোর্সের ডিপুটি চিফ। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন বলেই আমরা খুব ক্লোজ ছিলাম।
বললাম, ‘স্যার, কিছু তো করা উচিত।’
‘কী করবে?’
‘আপনি হুকুম দিলে, আমরা তো রেডি।’
‘নেতৃত্ব দেবে কে?’
বলি, ‘জিয়াউর রহমান। জিয়া তার আত্মীয় হতেন।’
শুনে তিনি শুধু বললেন, ‘ঠিক আছে। আই অ্যাম উইথ ইউ। গো অ্যাহেড।’
তার সিগন্যাল পেয়ে আমিও লিয়াকতের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম।
তখন প্রতিটি প্রফেশনে একজন করে লোক সিলেকশন করতে থাকি। লোকটা মুক্তিযুদ্ধের বা আমাদের পক্ষে কাজ করবে কি না, এটা নিবিড়ভাবে আগেই যাচাই করি। শেষে হেলিকপ্টারের জন্য চারজন পাইলট ঠিক করি। এরা হলেন এয়ার কমোডর দিদার, ফ্লাইট লে. কাইয়ুম, পাইলট অফিসার রশিদ আর পাইলট অফিসার লিয়াকত। ফাইটারের পুরো দায়িত্বে ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত আলী খান। এ ছাড়া তিনি ওই পরিকল্পনায় আমাদের এয়ারের গ্রুপটির কমান্ডারও ছিলেন।
ইকবাল রশীদের কাছে জানতে চাই, আপনাদের পরিকল্পনা কী ছিল?
আর্মির বড় শক্তি তো ট্যাংক। একমাত্র মিগ টোয়েন্টি ওয়ান আর হেলিকপ্টার ট্যাংককে মারতে পারে। আকাশ থেকে আমরা প্রেসিডেন্ট ভবনের আশপাশে থাকা ট্যাংকগুলোকে ধ্বংস করব। তখন আর্মিরা গিয়ে প্রেসিডেন্ট হাউজ টেকওভার করবে। খন্দকার মোশতাক ও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা শেষ হয়ে যাবে। আমি মনে করেছি, তখন চেইন অব কমান্ড রিস্টোর হবে। আর বঙ্গবন্ধুর সরকার ক্ষমতা ফিরে পাবে এবং যোগ্য নেতৃত্বের হাতেই দেশ থাকবে।
ইকবালদের সব প্ল্যান ঠিক। কিন্তু এরপর আর সাড়া নেই। আজ হবে, কাল হবেএমন কথা হচ্ছে। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা চলে। তারা তখনো অপেক্ষায় থাকেন।
ইকবাল বলেন বাকি ইতিহাস। তার ভাষায়: একদিন লিয়াকত এসে বলেন, জিয়া পিছিয়ে গেছেন। কোনো সিনিয়র না বললে ৪৬ ইনফেন্ট্রি ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়েত জামিলও মুভ করবেন না। তখন ব্রিগেডিয়ার খালেদকে (খালেদ মোশাররফ) বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলেন, ‘আই উইল ডু ইট।’ তিনি যদিও খুব ভালো একজন কমান্ডার ছিলেন। কিন্তু তার কিছু কিছু কাজ অনেকেই লাইক করতেন না। ফলে আমরা তার সঙ্গে কমফোর্টেবল ছিলাম না। এদিকে জানাজানি হয়ে গেছে যে একটা মুভ হচ্ছে ক্যান্টনমেন্টে। দেরি দেখে আমরাও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকেই মেনে নিই।
নিজেদের মধ্যে সিটিং রেগুলার হতো। তবে টোটাল টিমের সিটিং কখনো হয়নি। হেলিকপ্টারে যারা আছে, তারা এক টিম, তারা জানে না ফাইটারের কোন টিম। ফাইটারও জানে না কমিউনিকেশন টিমকে। কমিউনিকেশনও জানে না গ্রাউন্ডে কারা। অল আর আইসোলেটেড। এটা ছিল একটা সুন্দর পরিকল্পনা।
২ নভেম্বর ১৯৭৫। রাত তখন ১০টা বা ১১টা। বাসায় এসে লিয়াকত বলে যায়, ‘তোমরা প্রস্তুতি নাও।’ আমরা ভোরে অ্যাকশনে যাব। আমাদের সঙ্গে অন্য কোনো গ্রুপের কানেকশন ছিল না। কমান্ডার হিসেবে লিয়াকতই লিয়াজোঁ রাখত মেজর হাফিজ ও আর্মির গ্রুপটির সঙ্গে।
৩ নভেম্বর সকাল আনুমানিক ৬টা ৩০ মিনিট। দুটো এমআই-এইট হেলিকপ্টার ফুললি আর্মড, উইথ রকেটস অ্যান্ড গানস রেডি টু গো অন অ্যাকশন। আমার সাথে ওঠেন স্কোয়াড্রন লিডার বদরুল আলম। কিন্তু সে থাকবে এটা পরিকল্পনায় আগে ছিল না। পুরো কমিউনিকেশন বন্ধ করে দিয়েছিল ফ্লাইট লে. মিজান। আমরা ফ্লাই করে বঙ্গভবনের দিকে যেতে থাকি। এরপর ফ্লাইট লে. জামাল ও ফ্লাইট লে. সালাউদ্দিন ওড়ায় দুটো মিগ। বঙ্গভবনের ভেতর তখন মেজর ডালিম, নূরসহ বঙ্গবন্ধুর খুনিরা। প্রেসিডেন্ট হাউজ ও রেসকোর্সের ওপরে গিয়ে চারবার ট্যাংকগুলোকে গান সাইডে আনি রকেট মারার জন্য। চারবারই আমরা কল করলাম। চারবারই আমাদের কমান্ডার লিয়াকত বললেন, ‘নো। খালেদ মোশাররফ ডাজন্ট ওয়ান্ট এনি ব্লাডশেড।’
তখনই অবাক হলাম। তাহলে আমরা কি এখানে খেলতে এসেছি! তিনি বলেন, ‘মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং চলছে। তারা সারেন্ডার করবে। তারপর আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’
আমরা তখন হতাশ হয়ে নেমে এলাম। এসে জানতে চাই, তারা কি সারেন্ডার করেছে? জানানো হয়, না, তারা কথা বলছে। জেনারেল ওসমানীর মধ্যস্থতায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের মধ্যে নেগোসিয়েশন চলছে, ফোর্থ বেঙ্গল হেডকোয়ার্টার্সে। আমরা জানি না ওখানে কী হচ্ছিল।
আপনারা তো নির্দেশ না পাওয়ায় অ্যাকশনে যেতে পারেননি?
হ্যাঁ, এ কারণেই বলছি, এয়ারফোর্স ব্যর্থ হয়নি। আমরা আমাদের দায়িত্ব শতভাগ পালন করেছি। অ্যাকশনে গেলে ওরা সবাই শেষ হয়েই যেত। সে প্রস্তুতি নিয়েই আমরা ফ্লাই করেছিলাম। হত্যাকারীদের সঙ্গে দরকষাকষি করছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, নেগোশিয়েট করছিলেন কীভাবে তাদের দেশের বাইরে পাঠাবেন। সব শুনে আমরা শুধু অবাক হয়েছি। কিন্তু সেটা আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। বিমানবাহিনীর আমরা আমাদের কাজটা সঠিকভাবেই করেছি।
এরপর কী ঘটল?
ইকবাল রশীদ বলে যান, আমরা তখন এয়ারপোর্টেই। লিয়াকত এসে বলে, তাওয়াবকে (মুহাম্মদ গোলাম তাওয়াব) পাওয়া যাচ্ছে না, লেটস অ্যারেস্ট হিম। তিনি তখন এয়ার চিফ। সুলতান মাহমুদ সাহেব খবর দিলেন তোয়াব সাহেব ডিজিএফআইয়ের চিফ কে এম আমিনুল ইসলামের বাসায় সুরক্ষিত অবস্থায় আছেন। তখন তাকে ধরতে আমি ও লিয়াকত যাই বেঙ্গল রেজিমেন্টের বেশ কিছু সোলজারসহ।
তাওয়াব সাহেবকে আমি গান পয়েন্টে নিয়ে গাড়িতে তুলি। ভেবেছিলাম, ফোর বেঙ্গলে নিয়ে তাকে আচ্ছামতো ধোলাই করা হবে। কিন্তু সেটা ঘটল না। ফোর বেঙ্গলের সিইওর রুমে ঢোকার আগেই একটা সিঁড়ি ছিল। ডান দিকের কোনায় দাঁড়ানো রংপুর থেকে আসা ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কর্নেল কে এন হুদা, লে. কর্নেল এ টি এম হায়দার ও জাফর ইমাম। হুদা সাহেব ডেকে বলেন, ‘ইকবাল, এভরি থিং ইজ ওভার। নার্থিং ইজ হ্যাপেইনড।’ এরপর যা ঘটল, সেটা খুব ইন্টারেস্টিং এবং তা আমার পুরো লাইফ চেঞ্জ করে দেয়।
তাওয়াব সাহেব আমার গান পয়েন্টে। তিনি সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন। পেছনে আমি। ওপরে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এসেই ওনাকে একটা স্যালুট দিলেন। এরপর বললেন, ‘স্যার, দ্য কোরাম ইজ কমপ্লিট নাউ।’
এ কথার মানে কী?
আমি আজও বুঝিনি। তাওয়াব তখন প্রথমে পেছনে আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালেন। এরপর মুচকি হাসি হেসে সামনে তাকিয়ে খালেদ মোশাররফকে বললেন, ‘হোয়াট এ ওয়ান্ডারফুল জব ইউ হ্যাভ ডান খালেদ।’
আমি তখন আমার ভবিষ্যৎ পরিণতি উপলব্ধি করার চেষ্টা করলাম। দেখেন, প্রথম ছিল ওসমানী আর খালেদ মোশাররফ। এরপর তাওয়াব এসে খালেদকে বলে, ‘তুমি সব করছ, তোমার জেনারেল হওয়া উচিত, খুনোখুনি করে কী করবা, ছেড়ে দাও ওদের।’ বিকেলে এফ টোয়েন্টি সেভেন জাহাজ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী মেজর ডালিম, ফারুকসহ সবাইকে বার্মা (মিয়ানমার) পাঠিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি চলে। পুরো নেগোসিয়েশন ও প্ল্যানিংয়ে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, তাওয়াব আর ওসমানী। ওই দিন বেলা ১১টার দিকে খবর পেলাম জেলে চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান খুন হয়েছেন। তারপরও কীভাবে এই খুনিদের এ দেশে রেখেছিল। হাউ ক্যান খালেদ ডু দ্যাট। কেন তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন? এসব প্রশ্নের উত্তর আজ প্রজন্মকে জানতে হবে।
আপনারা তখন কী করলেন?
ইকবাল রশীদ বলেন: আরেকটি ছোট পরিকল্পনা করি। যখন দেখলাম তাওয়াব খেলতেছে, তখন আমরা দুজন পাইলট ঠিক করে রাখলাম। ওরা বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের টেকঅফ করে নিয়ে যাবে সৈয়দপুরে। এটাই ছিল প্ল্যান। মেজর হারুনুর রশীদ রানওয়েসহ সবকিছু রেডি করে রাখেন। পরিকল্পনা মোতাবেক আমরাও প্রস্তুত। কিন্তু কীভাবে যেন তাওয়াব এটা টের পেয়ে যায়। ডালিম, ফারুকসহ হত্যাকারীদের নিয়ে ফ্লাই করার ঠিক আগমুহূর্তে সে এসে বলে, ক্রু চেঞ্জ। আমরা খুব অবাক হই। ক্রু কাকে বসানো হলো জানেন? ফারুকের ব্রাদার ইন ল আশফাককে। এভাবেই ৩ নভেম্বর সন্ধ্যার দিকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা নিরাপদে ঢাকা থেকে বার্মা হয়ে থাইল্যান্ড চলে যায়। চোখের সামনে আমাদের মুখে জুতা মেরে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা চলে গেল বিদেশে। এর দায় কাকে দেবেন, বলেন?
৩ নভেম্বর আপনাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার কারণ কী বলে মনে করেন? ইকাবল রশীদের অকপট উত্তর: অ্যাবসোলুটলি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। তিনি তাওয়াব ও ওসমানীর দ্বারা ম্যানিপুলেটেড হন। সময়ক্ষেপণ করেছেন অনেক। তিনি কি মার্শাল ল ডিক্লেয়ার করতে চেয়েছেন! কিন্তু সেটা তো আমাদের প্ল্যানে ছিল না। শাফায়েত জামিলের কাছে আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জানতে চেয়েছি খালেদ মোশাররফ আসলে কী চেয়েছিলেন? তিনিও জানেন না। তার সাথেও নাকি কোনো কথা বলেননি। তাহলে কেন তিনি এই রেসপনসিবিলিটি নিলেন? কেন তিন দিন রেডিও বন্ধ রাখা হয়েছিল? কেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে প্রেসিডেন্ট করেছিলেন? খালেদ মোশাররফ কেন কিছুই ডিক্লেয়ার করলেন না; বরং নিজের জীবনটাও নষ্ট করলেন। হুদা ও হায়দারের মতো অফিসার তার সঙ্গে থাকার কারণেই কিলড হলেন। তিনি ইয়ং ট্রুপসের ওপরও ফেইথ রাখতে পারেননি। এ কারণে আর্মি থেকে শাফায়েত জামিল, মেজর হাফিজ, ক্যাপ্টেন তাজ, ক্যাপ্টেন হাফিজ, দোস মোহাম্মদসহ আরও অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন।
এরপর তো ৭ নভেম্বর এলো, কী ঘটেছিল ক্যান্টনমেন্টে?
ইকবাল রশীদ বলেন: ওই দিন ক্যান্টনমেন্টে ফায়ারিং শুরু করে কর্নেল তাহেরের গ্রুপ। আমার বাসায়ও অ্যাটাক হয়। তার আগেই পরিবার নিয়ে সরে পড়ি এক বন্ধুর বাড়িতে। ওই দিনই গুলি করে মেরে ফেলা হয় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, লে. কর্নেল এ টি এম হায়দার ও কর্নেল কে এন হুদাকে। তাওয়াব সাহেব তখন তুঙ্গে। তিনি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।
এরপর আমাদের অ্যারেস্ট করা হয় ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শালের জন্য। প্রথমে স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত আলী খানকে ডেথ সেনটেন্স দেওয়া হয়। পরে সেটা কমিয়ে যাবজ্জীবন করে। আমাকে ও বদরুল আলমকে যাবজ্জীবন, বাকিদের পাঁচ বছর, দুই বছর, এক বছর করে জেল দেওয়া হয়। এরপর পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকা জেলে, সেল নম্বর ০১-এ। পরে জিয়াউর রহমান তাওয়াবকে দেশ থেকে বের করে দিলে এয়ার চিফ হন মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার সাহেব। তিনি একাত্তরে ৬ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। ফলে এসেই তিনি আমাদের জেল থেকে বের করে আনেন।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৩ নভেম্বর ২০২২
© 2022, https:.