গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে হবে
পাকিস্তানি সেনারা একাত্তরে কীভাবে এ দেশে গণহত্যা চালিয়েছিল? সেটি জানাতে একটি হত্যাযজ্ঞের ঘটনা তুলে ধরছি শুরুতেই। একাত্তরের ২৫ মার্চ। রাত তখন আনুমানিক ১০টা ৩০ মিনিট। একটা ওয়্যারলেস মেসেজ আসে তেজগাঁও এলাকায় প্যাট্রোলে থাকা ওয়্যারলেস অপারেটর আমিরুলের কাছ থেকে। মেসেজে বলা হয়, ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৩৭ ট্রাক সশস্ত্র সেনা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে। খবরটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সেন্ট্রিও তখন পাগলা ঘণ্টি পেটায়। আমার ডিউটি ছিল অস্ত্রাগারে। তালা ভেঙে সব অস্ত্র বিতরণ করে দিই। অতঃপর পজিশন নিই একটি বিল্ডিংয়ের ছাদে।
রাত আনুমানিক ১১টা। পাকিস্তানি কনভয়ের ওপর শান্তিনগরে ডন স্কুলের ছাদের ওপর থেকে পুলিশ প্রথম গুলি চালায়। সাড়ে ১১টায় রাজারবাগের দিকে ওরা আক্রমণ করে। আমাদের ১০টি গুলির বিপরীতে ওরা জবাব দিয়েছে কয়েক হাজার গুলিতে। ওরা ট্যাংক, রকেট লঞ্চার ও হেভি মেশিনগান ব্যবহার করে। অল্প সময়ের ভেতর টিনশেডের ব্যারাকগুলোতে আগুন লেগে যায়। জীবন বাঁচাতে ভেতর থেকে বাঙালি পুলিশ সদস্যরা দৌড়ে বের হওয়ার চেষ্টা করে। পাকিস্তানি সেনারা তখন ব্রাশফায়ার করে তাদের নির্মমভাবে হত্যা করে। ফজরের আজান দিয়েছে তখন। আর্মিরা রাজারবাগের ১ ও ২ নম্বর গেট দুটি ট্যাংকের সাহায্যে ভেঙে ভেতরে ঢোকে। আসে ১০টি খালি ট্রাকও। এক থেকে দেড়শ পুলিশের লাশ ছিল পড়ে। ওগুলো ট্রাকে করে ওরা সরিয়ে ফেলে।
ছাদে উঠে ওরা টেনেহিঁচড়ে নামায় আমাদের। বেয়োনেট দিয়েও খুঁচিয়েছে, অস্ত্র কেড়ে নিয়ে হাত ওপর দিকে তুলে মারতে মারতে নিচে নামিয়েছে। রাস্তায় ফেলে ক্রলিং করায়। নির্দয়ভাবে পেটায়ও। দেখলাম একটি ময়লার ড্রেনে পড়ে আছে আমাদের ক্যানটিন বয়। বয়স চৌদ্দর মতো। পাকিস্তানি আর্মিরা তাকে সেখান থেকে উঠিয়া পিচঢালা রাস্তায় এনে আছড়ায়। তার মুখ ফেটে রক্ত বের হতে থাকে। ছেলেটা কাঁপতে কাঁপতে বলছিল ‘পানি পানি।’ এক পাকিস্তানি আর্মি তাকে পাশে নিয়ে প্যান্টের জিপার খুলে তার মুখে প্রস্রাব করে দেয়। একাত্তরে মানবতা এভাবেই প্রতি মুহূর্তে পদদলিত হয়েছিল।
তিন দিন আটকে নির্মমভাবে টর্চার করে। রাইফেলের বাঁটের আঘাত, বুটের নিচে ছিল লোহার পাত, সেটা দিয়ে দেয় লাথি, শরীরের প্রতিটি জায়গা ছিলে যায়, রক্তাক্ত হই। মুখেও আঘাত করেছে। সব দাঁতের গোড়া ভেঙে যায়। ফলে সব দাঁতই পড়ে গেছে। এখন বেঁচে আছি কৃত্রিম দাঁত লাগিয়ে। এক ফোঁটা পানিও খেতে দেয়নি ওরা। শরীরের রক্ত মুখে চলে এলে ‘লবণ কাটা’ লাগত। ভাবিওনি বেঁচে থাকব। বেঁচে আছি এটাই আল্লাহর অশেষ রহমত।
একাত্তরে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতার ইতিহাস এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা কনস্টেবল মো. আবু শামা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এ দেশের মানুষের ওপর এভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের অভিযানে কালরাতের প্রথম প্রহরে তারা শুরু করে গণহত্যা। ওই রাতেই কমপক্ষে ৩৫ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে ২৭ মার্চে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ১০ হাজার। সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকার রিপোর্ট বলে ২৫ থেকে ২৯ মার্চ পাঁচ দিনে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ১ লাখ। সে হিসেবে প্রতিদিন হত্যা করা হয়েছিল ২০ হাজার মানুষকে। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যাটি একাত্তরের ডিসেম্বরেই প্রকাশ করে রাশিয়ার ‘প্রাভদা’ পত্রিকা। এ ছাড়া পত্রিকাটির ১৯৭২ সালের ৫ জানুয়ারি সংখ্যার শিরোনাম ছিল এমন ‘দখলদার বাহিনী বাংলাদেশে ৩০ লক্ষাধিক মানুষ হত্যা করেছে’।
৯ মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান, আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং জাতির অসাধারণ ত্যাগের বিনিময়ে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেনি পাকিস্তান। ফলে ৫১ বছর পরও ১৯৭১ সালে তারা যে সীমাহীন গণহত্যা চালিয়েছে, তার জন্য বিন্দুমাত্র দুঃখ প্রকাশ বা ক্ষমা চায়নি দেশটির কোনো সরকার, বিচার করেনি তৎকালীন একজন জেনারেলেরও। বরং যখনই পেরেছে তখনই তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
একাত্তরের ঘটনা তদন্তে পাকিস্তানের হামুদুর রহমান রিপোর্টের জন্য গণহত্যার প্রমাণ সরবরাহ করেছিল বাংলাদেশ। পাকিস্তানি সেনাদের নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার শাস্তির সুপারিশও ছিল ওই কমিশনে। কিন্তু পাকিস্তান তা আমলে নেয়নি।
পাকিস্তানি সেনাদের বর্বর হত্যাযজ্ঞে নিহতদের স্মরণে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তাব গৃহীত হয় ২০১৭ সালে, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে। এরপর থেকে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জোর দাবি ওঠে। ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি। পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে দেখা করতে গেলে পাকিস্তানকে তিনি বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে বলেন। কিন্তু পাকিস্তান সে আহ্বানে সাড়া দেয়নি। এর আগে ২০০৯ সালে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনিও পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আলী বাসারকে একই আহ্বান জানিয়েছিলেন।
এই অক্টোবর মাসে ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যার স্বীকৃতি’ শীর্ষক ৮ পৃষ্ঠার একটি প্রস্তাব তোলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে। ডেমোক্র্যাট আইনপ্রণেতা রোহিত খান্না এবং রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা স্টিভ শ্যাবট এ প্রস্তাবটি তোলেন। এতে একাত্তরের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার আহ্বানও জানানো হয়েছে। প্রস্তাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার নিন্দা জানানোর পাশাপাশি বেঁচে থাকা অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান ছাড়াও ১৯৭১ সালে নিহত ও অত্যাচারের শিকার ব্যক্তিদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করা হয়েছে। পাশাপাশি পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী বাঙালি ও হিন্দুদের ওপর যে সহিংসতা চালিয়েছে তাকে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের প্রতিও আহ্বান জানানো হয়েছে ওই প্রস্তাবে।
এ প্রসঙ্গে স্টিভ শ্যাবট বলেন, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে গণহত্যা হয়েছিল তা আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। যারা এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার তাদের স্মৃতি মুছে ফেলা সম্ভব নয়। এই হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলে তা বিশ্ব ইতিহাসের দলিল হয়ে থাকবে এবং আমেরিকানদের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশের জনগণ এ থেকে শিক্ষা লাভ করতে পারবে।’ নিজের টুইট বার্তায় স্টিভ শ্যাবট আরও বলেন, ‘১৯৭১ সালের গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেয়া হলে বিশ্বের যাবতীয় নিপীড়ক শক্তিকে আরও একবার এ বার্তা পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে যে, এ ধরনের অপরাধ কখনো সহ্য করা বা ভুলে যাওয়ার মতো ব্যাপার নয়।’
একাত্তরে পাকিস্তানি সামরিক সরকার যখন পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশে) গণহত্যা চালায় তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল তাদের পক্ষে। তবু এত বছর পর তারা যদি এমন প্রস্তাব অনুমোদন করে। তবে সেটি তাদের নৈতিক পরাজয় মেনে নেয়ার পাশাপাশি গণহত্যার দাবির আদায়ের পথে বাংলাদেশ একধাপ এগিয়ে যাবে বলে মনে করেন গবেষকরা।
উল্লেখ্য, এর আগেই একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষের ওপর চালানো পাকিস্তানিদের বর্বরতাকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘জেনোসাইড ওয়াচ’। সেসব অপরাধ ও গণহত্যার ঘটনাকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকার করে নিতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রস্তাব পাসের আহ্বানও জানিয়েছে জেনোসাইড ওয়াচ। এ বছরের প্রথম দিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ‘লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন’ একাত্তরে বাংলাদেশিদের ওপর পাকিস্তানিদের নির্মম হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যা গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে সহায়ক হবে বলে আমরা মনে করি।
একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার বিষয়ে উল্লিখিত উদ্যোগ ও স্বীকৃতি আনার বিষয়ে বিশেষভাবে কাজ করছেন বিদেশে বসবাসরত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কিছু মানুষ। কিন্তু এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবেও বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন। পাশাপাশি একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার অপরাধ প্রমাণের তথ্য-উপাত্ত ও প্রামাণ্য সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ এবং তা উপস্থাপনের মাধ্যমে বিশ্বজনমত গড়ার কার্যকরী কর্মসূচিও নিতে হবে সরকারকেই। আর সেটি শুরু করতে হবে এখনই।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক বাংলায়, প্রকাশকাল: ২৯ অক্টোবর ২০২২
© 2022, https:.