ইলেকশন কমিশন ও ডিএফপি অফিসে অপারেশন
১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ চলছে পুরোদমে। আমরা হাইড-আউট ক্যাম্প করি ঢাকার কাছে, ডেমরায়। গ্রামের নাম আমুলিয়া মেহেন্দিপুর। জামদানি শাড়ি বানাত গোটা গ্রামের মানুষ। যথেষ্ট সাহায্য করেছিল তারা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত ওই গ্রামের মানুষেরা আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল। তাদের ঋণ শোধ হওয়ার নয়।
ক্যাম্পে ছিলাম ৪০ জন। কমান্ডে সাদেক হোসেন খোকা (ঢাকার প্রয়াত মেয়র)। ওখান থেকে বেরিয়ে ঢাকার ভেতরে গেরিলা অপারেশন করে আবার ফিরে যেতাম। ঢাকার কিছু গ্রুপ খবরাখবর দিত। আবার নিজেরাও বেরোতাম রেকি করতে। বন্ধু জগলু আর মামাতো ভাই শহিদ নানা মেসেজ দিয়ে সাহায্য করেছে। ‘খোকা’ গ্রুপের গেরিলা হিসেবেই পরিচিত ছিলাম। ঢাকায় গেরিলা অপারেশন করেছি ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে।
প্রাদেশিক ইলেকশন কমিশন অফিস তখন ছিল মোমিনবাগে, রাজারবাগের উল্টো পাশে। দুটো ভাড়াবাড়িতে চলত তাদের কাজ। দেশে তখন পুরোদমে যুদ্ধ চলছে। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচিত এমপিএ আর এমএনএরা স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষ নিয়ে চলে গেছেন মুক্তাঞ্চলে ও ভারতে। সে সময় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ফন্দি আঁটে। নির্বাচিত সব এমএনএ ও এমপিএর পদ শূন্য ঘোষণা করে আসনগুলোতে উপনির্বাচনের গোপন প্রস্তুতি নিতে থাকে তারা। এ খবর পেয়েই সিদ্ধান্ত নিই প্রাদেশিক ইলেকশন কমিশন অফিস উড়িয়ে দেওয়ার। এতে বিশ^ গণমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়বে ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের খবর। চাপের মুখে পড়বে পাকিস্তান সরকার। খোকা ভাইয়ের নেতৃত্বে ওই অপারেশনে অংশ নিই আমি, লস্কর, সুফি আর হেদায়েত। জায়গাটা রেকি করে আসি এক দিন আগেই।
১ নভেম্বর, ১৯৭১। রোজার মাস ছিল। ঢাকায় যখন ঢুকি রাত তখন ৮টার মতো। তারাবির নামাজ চলছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা। ওই সময়ই বিল্ডিংয়ে ঢুকে ১২ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ ফিট করি আমরা। বেরিয়ে এসেই বিস্ফোরণ ঘটাই। বিস্ফোরণে গোটা ঢাকা শহর কেঁপে ওঠে। বিল্ডিংয়ের এক পাশ ধসে পড়ে। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ইলেকশন কমিশন অফিসের কাগজপত্র। ওখানে থাকা এক দারোয়ানও মারা যায়।
স্মুথলি আমরা অপারেশনটা করি। কিন্তু কাজটা শেষ করতে বেজে যায় রাত ১২টা। পাকিস্তানি আর্মি তখন ঢাকার রাস্তায় টহলে নেমেছে। ক্যাম্পে ফেরার কোনো উপায় নেই। গলিপথ দিয়ে আমরা মালিবাগের এক মেসে গিয়ে আশ্রয় নিই। মেসটির ওপরে টিন। চারপাশে বেড়া। কর্মজীবী কিছু লোক থাকত সেখানে। ঢুকেই বলি, ‘একটু আগে বিস্ফোরণের যে আওয়াজ হয়েছে, সেটা আমরাই করেছি। আমরা মুক্তিযোদ্ধা।’ কথা শুনে আর অস্ত্র দেখে থরথর করে কাঁপছিল তারা। প্রথম কোনো মুক্তিযোদ্ধা দেখছে। তবু রাতে আমাদের থাকার কথা শুনে ভয় পেল না; বরং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের সাহায্য করল।
মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়াও তখন ছিল আরেক যুদ্ধ। পাকিস্তানি সেনারা টের পেলে সবাইকে হত্যা করত। মেসের পাশেই ছিল পিডিবির একটি অফিস। সেই অফিসের পাহারায় ছিল পাকিস্তানি সেনারা। ফলে ওই মেসে থাকাটা ছিল প্রচন্ড ঝুঁকির।
ওই রাতে মেসের লোকেরা তাদের জন্য রান্না করা খাবার আমাদের খাওয়ায়। তাদের বিছানাতেই থাকতে দেয়। আমাদের বাঁচাতে রাতভর পালা করে বাইরে দাঁড়িয়ে পাহারাও দিয়েছিল তারা। খুব ভোরে সেখান থেকে ফিরে যাই ক্যাম্পে। মেসের মানুষগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। ওই রাতে তাদের সাহায্য না পেলে হয়তো ধরা পড়তে হতো। মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অবদানের ইতিহাসও তুলে আনা প্রয়োজন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় গেরিলা অপারেশনের কথা এভাবেই তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হক নান্টু।
চার ভাই ও পাঁচ বোনের সংসারে নান্টু সবার ছোট। বাবা আব্দুল হামিদ ও মা নছিমুল নেসা। মুক্তিযুদ্ধের সময় নান্টু ছিলেন ঢাকা শাহীন স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। একাত্তরে ভারতের মেলাঘর থেকে ২১ দিন ট্রেনিং নেন তিনি। তার মুখেই শুনি ঢাকার আরেকটি অপারেশনের কথা।
তার ভাষায়, ডিএফপি অফিস তখন ছিল শান্তিনগরে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর সৃষ্টির জন্য আমরা সেখানে হিট করার প্রস্তুতি নিই। আমার মেজো ভাই সাইদুল হক বাবু ছিলেন ডিএফপির ফিল্ম প্রডিউসার। এ কারণে রেকি করার দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। সব খবর নিয়ে এসে আমি খোকা ভাইকে দিই। ওই দিন ছিল আখেরি জুমা। দুপুরে বায়তুল মোকাররমের নিউজ কাভার করে ফিরেছে সবাই। বেলা ৩টার পর আমরা ডিএফপিতে ঢুকি। অফিসে কেউ নেই। তিনতলায় সিঁড়িঘরে থাকা দারোয়ানকে বের করে দিই প্রথম।
টেবিলের ওপর ১২ কেজি এক্সপ্লোসিভ আমরা ফিট করি। বিস্ফোরণে যাতে স্টিলের টুকরোগুলো স্পিন্টার হিসেবে কাজ করে, সে কারণে স্টিলের আলমারিটাকেও এক্সপ্লোসিভের ওপর চাপ দিয়ে ফেলে রাখি। ঘটলও তাই। বিস্ফোরণে পুরো বিল্ডিং উড়ে যায়। দ্রুত একটা মাইক্রোবাসে করে আমরা সরে পড়ি। ওই অপারেশনের খবর ফলাও করে প্রচারিত হয়েছিল ভয়েস অব আমেরিকা, আকাশবাণী, বিবিসি ও স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে। আমাদের মনোবল ও সাহস আরও বেড়ে যায়।
গেরিলা নান্টু কেমন বাংলাদেশ চান? দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি বলেন, ভালো বাংলাদেশ চাই। পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো বাংলাদেশ চাই। ভালো দেশের নাগরিক হিসেবে বাঁচতে চাই। যে সরকার দেশকে সঠিক পথে নিয়ে যেতে পারবে, সেই সরকারের শাসন চাই। দুর্নীতি উন্নয়নকেই বিতর্কিত করবে। তাই এটা দেখা উচিত কঠোরভাবে। প্রকৃত লোকদের কাজে লাগাতে হবে।
ইচ্ছা আর চেষ্টা থাকলে দেশটাকে আরও এগিয়ে নেওয়া সম্ভব এমনটাই বিশ্বাস করতেন গেরিলা বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হক নান্টু। আশায় বুক বেঁধে তিনি শুধু বললেন, ‘যদি দেশের সঠিক ইতিহাস ও বীরত্বের কাহিনী জানো, তবেই বীরের মতো তোমরা এগোতে পারবে। মনে রেখো, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসই তোমাদের পথ দেখাবে।’
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১ ডিসেম্বর ২০২২
© 2022, https:.