কাগজের মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টানবে কে
রাজধানী ঢাকায় ছোট্ট একটি কম্পোজ ও ফটোকপির দোকান চালান জালাল। মাসে যা আয় করেন তা দিয়েই চলে তার চার সদস্যের পরিবার। দোকানে শিক্ষার্থীদের খাতা-কলম আর কাগজও বিক্রি করেন তিনি। কিন্তু মাস দু-এক ধরে ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই তার জন্য কষ্টকর হয়ে পড়েছে। হঠাৎ করে কাগজের বাজারে অস্থিরতাই এর প্রধান কারণ। কয়েক গুণ বেশি টাকা দিয়েও নিয়মিত মিলছে না প্রিন্ট ও ফটোকপির কাগজ। বেশি টাকায় কাগজ মিললেও কাস্টমার বাড়তি টাকায় প্রিন্ট ও ফটোকপি করতে নারাজ। এ নিয়ে নিয়মিত চলছে বচসা। তার ভাষায়, ‘কাস্টমার সাফ বলে দেয়আপনারা তো ডাকাত। সরকার তো কাগজের দাম বাড়ায়নি। আপনি কেন বেশি নেবেন? আমরা কীভাবে বোঝাব যে সরকার তো কাগজের বাজারটা নিয়ন্ত্রণও করছে না।’
জালাল বলছিলেন, ‘কাগজের দাম বাড়ার কারণে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের খাতার বিক্রিও কমেছে কয়েক গুণ। কাগজের প্যাকেট, কার্টুনসহ কাগজসংশ্লিষ্ট পণ্যের দামও অনেক। এভাবে কাগজের দাম বাড়লে আমাদের মতো ব্যবসায়ীদের পথে বসতে হবে। শিক্ষার্থী আছে এমন পরিবারগুলোকেও গুনতে হবে খরচের বাড়তি টাকা। এর প্রভাব পড়বে সরকারের ওপরও। তাই কাগজের দামের লাগাম টানতে সরকারকেই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।’
কাগজের মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের ওপরও যে এর প্রভাব পড়ছে তা উঠে আসে ঢাকার কাফরুল এলাকার এ ব্যবসায়ীর ভাষ্যে। কয়েক মাস পরেই বইমেলা আর জানুয়ারি মাসে নতুন বই লাগে স্কুল-কলেজে। ঠিক তখনই কাগজের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বাজারে সরবরাহেও টান পড়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানান সংশ্লিষ্টরা। এ সুযোগে হু-হু করে বাড়ছে কাগজের দাম। পাইকারিতে কাগজের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা পণ্যের দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত এক সপ্তাহে পাইকারি বাজারে কাগজের দাম প্রতিদিনই বেড়েছে।
হোয়াইট প্রিন্ট কাগজের দাম সপ্তাহের ব্যবধানে টনপ্রতি ২৫ হাজার টাকা বেড়ে দাম দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকায়। প্রতি টন হোয়াইট নিউজপ্রিন্ট কাগজের দাম বেড়েছে ১৫ হাজার টাকা। এ কাগজের দাম ২০ হাজার থেকে বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে প্রতি টন ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকায়। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে লেজার কাগজের দাম। প্রতি টনের দাম ৩০ হাজার টাকা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। প্রতি টন নিউজপ্রিন্ট কাগজের দাম ৬৪ হাজার থেকে বেড়ে ৮৫ হাজার টাকা হয়েছে। এ কাগজের দাম গত দুই সপ্তাহে বেড়েছে ৩৩ শতাংশ। শুধু যে কাগজের দাম বেড়েছে তা নয়। বেড়েছে মলাটের কাগজ, আর্ট কার্ড ও রঙিন কাগজের দামও। কিন্তু কাগজের এ দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের তদারকি, কোনো উদ্যোগ কিংবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তির বক্তব্যও আমরা পাইনি।
বর্তমান সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যে বই তুলে দেওয়া। কাগজের বাজারে অস্থিরতার কারণে সেটিও অনেকটা শঙ্কার মুখে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে দেরিতে কাজ পাওয়া, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কাগজের দাম বেড়ে যাওয়া, বিদ্যুৎ-বিভ্রাটসহ নানা চ্যালেঞ্জের কথা বলছেন মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা।
তবে বই পাওয়া বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জোর আশ্বাস দিলেও বই ছাপার কাজ যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে নতুন বছরের প্রথম দিন প্রাথমিকের সব পাঠ্যবই পাওয়ার সুযোগ কম বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। কাগজের মূল্যবৃদ্ধি সরাসরি শিক্ষা ও শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট কাজকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। প্রতিটি পরিবারের শিক্ষার খরচও তখন বেড়ে যায়, যা চলছে বর্তমানে।
কিন্তু কেন কাগজের এই লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি? গণমাধ্যমের সংবাদ বলছে, কাগজের কাঁচামালের সংকট রয়েছে। বিদ্যুতের সংকটের কথাও তুলে ধরছেন ব্যবসায়ীরা। ব্রাইটনেস কাগজের জন্য লাগে ভার্জিন পাল্প। চাহিদা থাকলেও যেটা পর্যাপ্ত পরিমাণ আমদানি হয়নি। ডলার সংকটের কারণে এখন আমদানিও করা যাচ্ছে না। পাল্পের দাম দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় কাগজকল মালিকরা তা আমদানিও করছেন না। ফলে কাগজের চাহিদার এই সময়ে সংকট তৈরি হচ্ছে।
এ অবস্থা চলতে থাকলে কাগজের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হবে প্রকাশনা শিল্প। এমনটাই মনে করছেন প্রকাশকরা। করোনা পরিস্থিতির পর সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৩ সালেই স্বাভাবিক সময়ে বইমেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। মেলা উপলক্ষে দেশীয় প্রকাশনীগুলোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে এখন থেকেই। কিন্তু কাগজের দামসহ সব খরচ বেড়ে যাওয়ায় বইয়ের দামও অনেকটাই বাড়বে। এতে পাঠকরা বই কিনতে এসে বড় একটা ধাক্কা খাবেন এবং বই বিক্রি স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। ফলে দেশে বই বিক্রির সবচেয়ে বড় মৌসুমে বাড়তি দামে বইয়ের বেচাকেনা নিয়ে এখনই চিন্তার ভাঁজ অনেকের কপালেই।
অনেক প্রকাশক বাছাই করে নতুন বই বা কেউ কেউ নতুন বই করবেন না বলেও পরিকল্পনা করছেন। এতে প্রকাশনা শিল্প যেমন হুমকির মুখে পড়বে, তেমনি দেশের শিল্প-সাহিত্যের অগ্রগতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যা মোটেই কাম্য নয়। তবে বিক্ষিপ্তভাবে প্রকাশকরা গণমাধ্যমের কাছে কাগজের মূল্যবৃদ্ধিতে তাদের ক্ষতির কথা তুলে ধরলেও সম্মিলিতভাবে এখনো সরকারের কাছে তারা এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন এমন কোনো খবর আমরা পাইনি। যেটি হওয়ার উচিত ছিল বলে মনে করেন অনেকেই। এ বিষয়ে প্রকাশকদের ঐক্যবদ্ধতার ঘাটতি রয়েছে এবং সে সুযোগে একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সময় কাগজের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন বলে মত দেন কেউ কেউ। প্রকাশনা শিল্পে সৃজনশীল বই প্রকাশের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে কাগজের দামসহ বই-সংক্রান্ত সব বিষয়ের প্রতি নজর দিতে সরকারিভাবে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করাও উচিত বলে মনে করেন লেখক ও প্রকাশকরা। এতে শিল্প-সাহিত্যের অগ্রগতিতে বাধাগ্রস্ত হওয়ার সুযোগও কমে আসবে বলে মনে করেন তারা।
একসময় কাগজের মূল্যবৃদ্ধিকে জাতীয় সংকট হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ৮ জানুয়ারি বরিশালে ঘূর্ণিঝড় এলাকা পরিদর্শন করেন তিনি। সেখানে অবস্থানকালে তার সঙ্গে দেখা করতে যান বরিশাল থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকার প্রকাশকরা। তারা কেন্দ্রীয় সরকারের নিউজপ্রিন্ট কাগজ বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানান। প্রকাশকদের সব কথা শুনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ইহা জাতীয় জীবনের একটি আশু সংকট। দুই বৎসরে দুই ধাপে কাগজের টনপ্রতি মূল্যবৃদ্ধির কারণে এর তীব্র প্রভাব পড়িবে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিতে, যা এই অঞ্চলের মানুষের ওপর নতুন আরেকটি বোঝার শামিল। জাতীয় সংবাদপত্র শিল্প যাহাতে এই সংকট থেকে উত্তরণ পায় তাহার ব্যবস্থা লওয়া হইবে।’
তাই বঙ্গবন্ধুকন্যার আমলে কাগজের সংকট ও লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিকে সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দ্রুত প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবেএমনটাই আমাদের আশা।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১৬ নভেম্বর ২০২২
© 2022, https:.