লোহাগড়া ভাটিয়াপাড়া অভিযান
বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম আজাদ (বীর প্রতীক)। ডাক নাম দারা। গোলাম হাসিব ও রাবেয়া বেগমের দ্বিতীয় সন্তান গোলাম আজাদ। বাড়ি নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার ইতনা গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন খুলনা এম এম (মজিদ মেমোরিয়াল) সিটি কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। যুদ্ধ শুরু হলে তিনি হায়ার ট্রেনিং নেন প্রথমে ৮ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টার কল্যাণীতে, পরে বিহারের চাকুলিয়ায়। ট্রেনিং শেষে যান প্রথমে কল্যাণীতে; পরে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় পেট্রাপোলে।
প্রথম অপারেশন বিফলে যায় আজাদদের। তাদের কাছে ছিল একটা এসএমসি, এসএলআর ও ছয়টা থ্রি নট থ্রি রাইফেল। এ দিয়ে আর্মির সঙ্গে যুদ্ধ করা সম্ভব ছিল না। তাই তারা ফিরে যান পেট্রাপোলে।
বাকি ইতিহাস শুনি মুক্তিযোদ্ধা গোলাম আজাদের মুখেই। তিনি বলেন, আমাদের পাঠানো হয় বয়রা সাব-সেক্টরে; কমান্ডার ছিলেন মেজর খন্দকার নাজমুল হুদা। তখন সেখানে জি-ফোর কোম্পানি গঠন করা হয়, এম এইচ সিদ্দিকী (কমল সিদ্দিকী) স্যারের নেতৃত্বে। তিনটি প্লাটুন গঠন করে একটা প্লাটুনে তিনটি করে সেকশন করে দেন তিনি। প্রতি সেকশনে ১৩ জন ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা আর একজন কমান্ডার।
তিনটি প্লাটুনের একটি ছিল হেডকোয়ার্টার প্লাটুন। সেখানে সবাই ছিলেন ইপিআরের লোক। তাদের কাছে থাকত থ্রি-ইঞ্চ মর্টার। তারা কাভারিং সাপোর্ট দিত। সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠন করা হয় প্লাটুন নম্বর-০১। এই প্লাটুনের দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। প্লাটুন নম্বর-০২-এ ছিলেন এয়ার ফোর্স, ইপিআর, পুলিশের লোকসহ বিভিন্ন বাহিনী থেকে আসা বাঙালি সদস্যরা। প্রতি সেকশনে অস্ত্র ছিল এসএমজি, এলএমজি, এসএলআর ও স্টেনগান আর অগণিত মাইন।
বীরপ্রতীক গোলাম আজাদদের পুরো কোম্পানি মার্চ করে চলে আসে মাগুড়ায়, বুনোগাতি বাজারে। তারা যখন সেখানে যায়, তখন কয়েকটা দোকান পুড়ছিল। লোকজন জানায়, পাশেই এক স্কুলে রাজাকারদের ক্যাম্প। দিনের বেলায় পাকিস্তানি সেনারা বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ওই ক্যাম্পে আসে। আশপাশের গ্রামগুলোতে অত্যাচার চালায় রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধারা ওই ক্যাম্প দখলের পরিকল্পনা করে। সেটা করা গেলে আর্মি খুব সহজে সেখানে নতুন ক্যাম্প করতে পারবে না।
অপারেশন কীভাবে করলেন? গোলাম আজাদের উত্তর, আক্রমণের প্ল্যানটি করেন কমল সিদ্দিকী স্যার। দুটি প্লাটুন সামনের দিক থেকে আক্রমণ করবে। তাদের ঠেকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে শত্রুরা। পেছনটায় কোনো বাধা থাকবে না; বিনা বাধায় আমি আমার প্লাটুন নিয়ে ক্যাম্পে ঢুকে যাব।
কিন্তু ইনফরমেশন ভুল ছিল। খুব ভোরে গোলাগুলি শুরু হলে পেছনে যেতেই দেখি ওদের একটা আন্ডারগ্রাউন্ড বাঙ্কার। বাঙ্কারের পাশ দিয়ে চলে গেছে নবগঙ্গা নদী। আমরা খুব কাছাকাছি পজিশন নিয়ে থাকি।
সামনের দিকে গোলাগুলি শুরু হলে ওরা হতভম্ব হয়ে পেছনের বাঙ্কার থেকে এলোপাতাড়ি ফায়ার করতে থাকে। গুলিগুলো মাথার অনেক ওপর দিয়ে বাঁশঝাড়ে গিয়ে লাগে। বুঝে যাই ওরা না দেখেই গুলি করছে। এ সুযোগটাই নিই আমি। কয়েক সেকেন্ডের ভেতর একটা গ্রেনেডের পিন খুলে ওদের বাঙ্কারে থ্রো করি। ধুম করে বিকট শব্দ হয়। বাঙ্কারে গোঙানির শব্দ শুনতে পাই। একজন দৌড়ে নদীর দিকে সরে যাচ্ছিল। এসএলআর দিয়ে তিনটি গুলি করি তাকে। সে নদী পার হয়ে ওপারে গিয়েই মারা যায়। তখনই ওদের ক্যাম্পে উঠে পড়ি। ভেতরে থাকা রাজাকারদের সারেন্ডার করিয়ে এক ঘরে আটকে রাখি। সব অস্ত্র জড়ো করে রাখি আরেক রুমে।
সামনের গ্রুপ দুটি ক্যাম্পের দিকে তখনো গুলি করছিল। খানিক পরে এক ইপিআর ক্যাম্পে ঢুকেই দেখে আমার কা-। সবাইকে সারেন্ডার করিয়ে বসে আছি। তিনি খুব অবাক হন। আনন্দে চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘গুলি বন্ধ করো। দারা সবাইকে সারেন্ডার করিয়েছে।’ অপারেশনে আমার সাহস দেখে কমল সিদ্দিকী স্যার খুব বাহবা দিয়েছিলেন। দিনটির কথা মনে হলে এখনো অন্য রকম লাগে।
এরপর হেডকোয়ার্টার প্লাটুন বাদে পুরো কোম্পানি কমল সিদ্দিকীর নেতৃত্বে চলে আসে লোহাগড়ায়, ইতনা গ্রামে। গোলাম আজাদরা লোহাগড়া থানা দখলে নেন। কীভাবে? তিনি বলেন, ডিসেম্বরের ৮ তারিখ, ভোরবেলা। থানার দক্ষিণ পাশে পজিশন নিয়ে থাকি। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারাও যোগ দেয়। চারপাশ থেকে থানা ঘিরে রাখি আমরা। হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হয়। বাম পাশে ছিল সহযোদ্ধা মোস্তফা কামাল, বাড়ি যশোরে। একটা গুলি এসে ওর কানের দিক দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে যায়। ‘মা গো’ বলেই সে ছিটকে পড়ে। শরীরটা কয়েকটা ঝাঁকি দিয়েই নিথর হয়ে যায়। গুলিটা ওর গায়ে না লাগলে আমার গায়ে লাগত।
সহযোদ্ধারা এগিয়ে এলে আমি থানার দিকে এগোই। চারপাশে ট্রেঞ্চ করা। একদিকে চোখা করে বাঁশ গেড়ে দেওয়া হয়েছে। তার পাশেই কাঁটাতারের বেড়া। কারও ঢোকার সাধ্য নেই। কিন্তু আমার মনে তখন সহযোদ্ধা হত্যার প্রতিশোধের আগুন। ওদের সব বাধা কীভাবে পেরিয়েছি জানি না। ঢুকে পড়ি থানার ভেতরে। অন্য পাশ দিয়ে ঢোকে মোক্তার। টার্গেট ছিল পুলিশের খালেক। বাঙালিদের ওপর বেশি অত্যাচার করছে সে। ওকে পেয়েই মেরে দিই। থানা দখলে চলে আসে।
কমল সিদ্দিকীর নির্দেশে এরপর গোলাম আজাদরা মুভ করেন নড়াইলের দিকে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা চতুর্দিক থেকে ঘিরে রাখে পাকিস্তানি সেনাদের। ওরা ছিল পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাংলোয়। আর মিলিশিয়ারা ছিল সার্কিট হাউজে। ওরা সারেন্ডার করলে ১০ ডিসেম্বর কমল সিদ্দিকী এবং অন্যরা বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ ওড়ায়। নড়াইল মুক্ত হয়।
১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও ভাটিয়াপাড়ায় তখনো চলছে যুদ্ধ। বয়রা সাব-সেক্টরের কমান্ডার মেজর খন্দকার নাজমুল হুদা ও জি-ফোর কোম্পানির কমান্ডার এম এইচ সিদ্দিকী (কমল সিদ্দিকী)সহ গোলাম আজাদরা মুভ করে ভাটিয়াপাড়ায়।
তিনি বলেন, পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল ওটা। আমরা ওদের পূর্বদিকে অবস্থান নিই। হুদা স্যার ওয়াকিটকিতে নির্দেশে দিলে পেছন থেকে আর্টিলারি সাপোর্ট দেয় আরেক গ্রুপ। পজিশনে সবাই। তুমুল ফায়ারিং চলছে। হঠাৎ বাঁ দিক থেকে একটা গুলি এসে কমল সিদ্দিকী স্যারের ডান চোখ বিদ্ধ করে। উনি ছিটকে পড়েন। প্রথম বুঝতে পারিনি। হুদা স্যার চিৎকার দিলে আমরা ছুটে যাই কমল সিদ্দিকীর কাছে। পরে তাকে লঞ্চে নড়াইল পর্যন্ত দিয়ে আসি। আমাদের কমান্ডারকে গুলি করেছে। আমরা ঠিক থাকতে পারি না।
তুমুল গোলাগুলি চলে ওদের সঙ্গে। এক দিন পরেই ওরা সারেন্ডার করার মতো পজিশনে চলে যায়। কিন্তু সারেন্ডার করে না। ভয় পাচ্ছে যদি গুলি করে মেরে ফেলি। ফলে অস্ত্র ছাড়তে চায় না। ওই সময় চলে আসেন ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর এম আবুল মঞ্জুর। তার হুংকারেই পাকিস্তানি সেনারা অস্ত্র ফেলে সারেন্ডার করে। কিন্তু একজন পাকিস্তানি সোলজার সারেন্ডার মেনে নিতে পারেনি। নিজের অস্ত্র বুকে ঠেকিয়ে গুলি করে। সে বেঁচেছিল কি না, আমার জানা নেই। ১৯ ডিসেম্বর ভাটিয়াপাড়া মুক্ত করি আমরা।
শত বাধা পেরিয়ে প্রজন্ম এগিয়ে নিয়ে যাবে দেশটাকে। এমন স্বপ্নে বিভোর হন বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম আজাদ (বীরপ্রতীক)। চোখে-মুখে আলো ছড়িয়ে তাদের উদ্দেশে তিনি বললেন, তোমরা দেশকে ভালোবেসো। নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলো। নিজের কর্ম সততার সঙ্গে করাই বড় দেশপ্রেম। দেশও তখন এগিয়ে যাবে। আমার বিশ^াস, তোমরা অবশ্যই জয়ী হবে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১০ ডিসেম্বর ২০২২
© 2022, https:.