বধ্যভূমি ও গণহত্যার স্থান: উপেক্ষিত গৌরীপুর নৌকাঘাট
নদীপারের গ্রাম গৌরীপুর। পূর্ব দিক থেকে পুরোনো ব্রহ্মপুত্র আর উত্তর দিক থেকে মেঘনা এসে মিশেছে। নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা সদরের উত্তর-পূর্বে এই গ্রামটি। ১৯৭১ সালে শান্ত এই নদ-নদীসংলগ্ন গ্রামেই গর্জে উঠেছিল পাকিস্তানি সেনাদের হাতিয়ার। সহজ-সরল মানুষের রক্তে ভেসে গিয়েছিল নদীর বুক। গণহত্যার এমন তথ্য সংগ্রহে এক সকালে পা রাখি গৌরীপুর গ্রামে। ওই গ্রামেই রয়েছে কোহিনূর জুট মিল। সেটিকে পেছনে ফেলে উত্তর-পূর্ব কোণে এগোলেই নৌকাঘাট। একাত্তরে যেখানে ঘটেছিল গণহত্যা।
ঘাটে ছোট-বড় অনেক নৌকা ভেড়ানো। কোনোটি ছুটে যাবে ভৈরব ঘাটে; কোনোটি আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার ঘাটে। মাঝিরা ডেকে নিচ্ছেন যাত্রীদের। উঁচু বাঁধের মতো রাস্তা। ঘাটে নামতে পাকা সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে। সেটি দিয়েই ঘাটপাড়ে যেতে হয় সবাইকে। প্রতিদিন এ পথেই কয়েক হাজার মানুষের যাতায়াত। কিন্তু কোনো স্মৃতিস্তম্ভ বা নামফলক এখানে নেই। ফলে একাত্তরের শহীদদের রক্তভেজা মাটিতে পা দিয়েও মানুষ জানছে না সেই ভয়াল স্মৃতির কথা!
১৯৭১ সালে কী ঘটেছিল এখানে? মুখোমুখি হই বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুসের। তার ভাষায়, ধন মিয়া কন্ট্রাক্টরের একটি দোকান ছিল গ্রামে। ওখানে বসা ছিল কাবুলিওয়ালা এবং রাইফেলধারী এক পাঞ্জাবি লোক। পাশেই ছিল একটি খলিফার (দর্জি) ঘর। সে সময় কাবুলিওয়ালারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সুদের ওপর মানুষকে টাকা ধার দিত। ওরা আসছে সুদের টাকা নিতে। দূর থেকে আমি ওদের দেখি। ওই সময় নারায়ণপুর থেকে মুক্তিবাহিনীর একটি দল আসে গ্রামে। লায়েস নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা একাই এগিয়ে যায় কাবুলিওয়ালার দিকে। পাঞ্জাবি দেখেই ক্ষিপ্ত হয়ে সে স্টেনগান দিয়ে গুলি করে। গুলি লাগে কাবুলিওয়ালার গায়ে, নিমেষেই মাটিতে পড়ে যায় সে। পাঞ্জাবি লোকটা তখনই রাইফেল তাক করে লায়েসের দিকে। খুব কাছ থেকে গুলি করে, লায়েসের মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। লায়েসের স্টেনগানটা ওই পাঞ্জাবি তখনই তুলে নিয়ে বাজারে এলোপাতাড়ি গুলি করতে করতে নদীর তীর দিয়ে দৌড়ে পালায়। আমি প্রথমে লায়েসের কাছে যাই। ওর ভাইসহ গ্রুপের সবাই তখন চলে এসেছে। ওদের হাত থেকে একটি এসএলআর নিয়ে ওই পাঞ্জাবির পেছনে ছুটি। ও গুলি ছোড়ে। আমিও গুলি করি। ব্রহ্মপুত্র নদের টেক পর্যন্ত গিয়েছিলাম। তখন নদের ওপার থেকে কোষা নৌকায় এক রাজাকার এসে ওই পাঞ্জাবিকে তুলে নেয়।
আবদুল কুদ্দুস বলেন, এর ঘণ্টা দুয়েক পরই দুই লঞ্চবোঝাই আর্মি এসে আমাদের বাড়িসহ গোটা গ্রাম পুড়িয়া দেয়। তখন আমরা ছিলাম জুট মিলের ভেতরে। ১৬০টি বাড়ি পুড়িয়েছে ওরা। বাড়িগুলো সব ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের। মানুষ যখন পালাচ্ছে, তখন ওর মধ্য থেকে ১৭ জনকে ধরে আনে নৌকাঘাটে। এ ছাড়া কয়েকজনের ওরা মেরেছে আগুনে ফেলে। বুড়ো লোক ছিল ওরা। নিজ চোখে দেখেছি সেই সব মরদেহ।
ওই দিন জসিম উদ্দিনের ভাই মোসলেম উদ্দিনকেও বেয়নেট দিয়ে নৌকাঘাটে খুঁচিয়ে মারে পাকিস্তানি সেনারা। জায়গাটিকে দেখিয়ে জসিম বলেন, ‘আমার ভাই খুব কষ্টে মারা গেছে। কোহিনূর জুট মিলে চাকরি করত। পাকিস্তানিরা আইসা গোলাগুলি শুরু করল। সবাই তো ছুটছে। ওরে বাজারে পায় ওরা। ধইরা নিয়া আসে এই ঘাটে। এখানে মারছে তারে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারছে আর্মিরা। ও মাথা তুলতে গেলে পায়ের বুট দিয়া ওরা পাড়া দিছে। তার নাকের মাংসও তুলে ফেলছিল। ওর মরদেহ আমরা পাইছি।’
নৌকাঘাটে গণহত্যা নিয়ে কথা বলেন ওই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা গিয়াস উদ্দিন আহমেদও। তিনি বলেন, ‘ওই দিন বিকেলের ঠিক আগে পাকিস্তানি সেনারা বাড়িগুলোতে আগুন দেয়। এখানে একটি কেরোসিনের দোকান ছিল। কেরোসিনের ড্রামগুলো নিয়ে ওরা বাড়ি বাড়ি আগুন লাগায়। বয়স দেখছে না, ঘরে যারে পাইছে তারেই মারছে। আবদুর রহমান ব্যাপারী ও আবদুল সোবহানকে মারছে আগুনে পুড়িয়ে। আশি বছরের বুড়ারেও রেহাই দেয় নাই। বাড়িতে আগুন দিয়ে ওরা নৌকাঘাটে লোক মেরে চলে যায়। আমরা ছিলাম কোহিনূর জুট মিলের ভেতরে। পরে এসে দেখি ১৭টি মরদেহ পড়ে আছে। রাস্তার ওপর থেকে নদী পর্যন্ত মরদেহগুলো পড়ে ছিল। এখানে হত্যা করা হয় এই গ্রামের আবদুল কুদ্দুস, হাদিস মিয়া, দারোগ আলী মিয়া, সামু, জিন্নত আলী, মোসলেম ও রফিক মিয়াকে। বাকিরা ছিল বিদেশি (অন্য গ্রামের)। তারা জুট মিলে কাজ করতে এসেছিল।’
গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘মরদেহগুলোকে তুলে পরে দাফন করা হয় পাশের গোরস্তানে। এ ছাড়া দুই নদীর মিলনস্থল হওয়াতে ১৯৭১ সালে এই ঘাটেই ভেসে আসত শত শত মরদেহ। কোনো কোনোটি পচে গিয়ে দুর্গন্ধ ছড়াত। গ্রামের মানুষ বাঁশ দিয়ে গুঁতিয়ে সেগুলো স্রোতের দিকে ভাসিয়ে দিত। যেগুলো দাফনের অবস্থায় পাওয়া যেত, গ্রামবাসী তা তুলে মাটিচাপা দিত। অথচ এই নৌকাঘাটটিই সংরক্ষণ করল না সরকার। রাজাকারদের তো বিচার হয়েছে, এখনো হচ্ছে। কিন্তু এখানে যে পাকিস্তানি সেনারা সাধারণ মানুষকে গুলি করে মারছে, তাদের বিচার করবে কে বলেন?’
কথা হয় রায়পুরা থানা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কামান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মো. নজরুল ইসলামের সঙ্গে। হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘একাত্তরে গৌরীপুর নৌকাঘাটে শুধু ১৭ জনকেই হত্যা করা হয়নি। নদীর মোহনা হওয়াতে প্রায় প্রতিদিনই মরদেহ ভেসে আসত। তাই ঘাটটিকে বধ্যভূমি হিসেবে সংরক্ষণ ও সেখানে স্মৃতিসৌধ স্থাপনের আবেদন করেছিলাম ৭ বছর আগে। কিন্তু এখনো কোনো অগ্রগতি নেই। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায়। অথচ গোটা রায়পুরা উপজেলায় আপনি মুক্তিযুদ্ধের কোনো স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পাবেন না! এই দুঃখের কথা কাকে বলব আমরা?
ইতিহাসের সন্ধানে আরেকবার যাই সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে। সেখানে কাইয়ার গুদাম ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের টর্চার সেল। একাত্তরের আগে সেটি ছিল পাটের গুদাম। সামনে কুশিয়ারা নদী। ফলে নদীপথে অন্যান্য থানার সঙ্গে যোগাযোগ করা সহজ ছিল। তাই পাকিস্তানি সেনারা এটিকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। মুক্তিকামী মানুষকে ধরে এনে টর্চার করা হতো এখানে। এরপর গুলি করে ফেলে দেয়া হতো কুশিয়ারা নদীতে।
১১ ডিসেম্বর ১৯৭১। ফেঞ্চুগঞ্জ মুক্ত হলে কাইয়ার গুদামে প্রবেশ করেন মুক্তিযোদ্ধা আজমল হোসেন রউফসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধারা। সেখানে কী দেখেছিলেন তারা। আজমল বলেন, কাইয়ার গুদামে ঢুকেই ভয় পেয়ে গেছি। রক্তমাখা হাতের ছাপ। মানুষকে ওয়ালে ঝুলিয়ে টর্চার করেছে ওরা। দেয়ালে রশি বাঁধা। প্রথম দেখি ঘুটঘুটে অন্ধকার একটি ঘর। মেঝেতে পা পড়তেই আটকে যায়। আঠার মতো কী যেন! মোমবাতি জ্বালিয়ে দেখি মানুষের রক্ত জমাট হয়ে গেছে। কুলাউড়া ও সিলেট থেকেও অনেক লোক ধরে এনে এখানে হত্যা করা হয়েছিল। মানুষের হাড়গোড়ও পেয়েছি কাইয়ার গুদামে।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, কাইয়ার গুদামটি অনেক বড়। কালচে ছাপ পড়া উঁচু তার দেয়াল। পেছনের দুটি দরজা কাঠ মেরে বন্ধ করা। সামনে টিন দিয়ে ঘেরা দুটি ঘর। নতুন দরজা খুলে একটি রুম ব্যবহার করা হচ্ছে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় হিসেবে। বাকি রুম ও গোটা গুদাম তালাবদ্ধ। স্থানীয়দের দাবিতে গুদামের ঠিক সামনেই বহমান নদীর তীরে কয়েক বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ। কিন্তু কাইয়ার গুদামটি বধ্যভূমি হিসেবে সংরক্ষণের কার্যকরী সরকারি উদ্যোগ নেয়া হয়নি এখনো। ফলে এখান থেকে গণহত্যার ইতিহাস মুছে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এদেশীয় দোসররা গোটা বাংলাদেশকেই পরিণত করেছিল বধ্যভূমিতে। তারা হত্যা করে লাখ লাখ নিরীহ-নিরপরাধ মানুষকে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এর পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস ও তথ্য এখনো সংগ্রহ করা হয়নি। করা হয়নি শহীদদের সঠিক কোনো তালিকাও।
একাত্তরে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘটে যাওয়া গণহত্যার ইতিহাস এবং গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান তুলে আনা বিশেষভাবে প্রয়োজন। সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাজ শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন বা যাচাই-বাছাই করা নয়। সারা দেশের বধ্যভূমি ও গণহত্যার স্থানগুলো সংরক্ষণ এবং তার ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার দায়িত্বও নিতে হবে তাদের।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক বাংলায়, প্রকাশকাল: ১৫ ডিসেম্বর ২০২২
© 2022, https:.