বরিশাল সাতক্ষীরায় প্রতিরোধ আক্রমণ
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের একজন এলিট কমান্ডো ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগ। যিনি ক্যাপ্টেন বেগ নামে অধিক পরিচিত। তার বাবা হোসামউদ্দিন বরিশাল ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের নামকরা অধ্যাপক ছিলেন। পৈতৃক বাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহে হলেও ১৯২০ সাল থেকেই বরিশাল শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। ৭ ভাই ও ৫ বোনের মধ্যে মাহফুজ আলম বেগ পঞ্চম। তার মেজো ভাই মনজুরুল আলম বেগ একুশে পদকপ্রাপ্ত দেশের প্রখ্যাত ফটোগ্রাফার। মার্চের প্রথমদিকেই ক্যাপ্টেন বেগ করাচি থেকে পালিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। মুুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কিছুদিন নরসিংদীতে অবস্থান করে পরে চলে যান নিজ শহর বরিশালে।
অতঃপর কী ঘটল? সেই ইতিহাস শুনি তার জবানিতে। তার ভাষায়, বরিশাল গিয়েই ছাত্রদের ৩০ জনের একটা গ্রুপকে রাইফেল ট্রেনিং দেওয়া শুরু করি। চিফ হুইপ ফিরোজ, আফজাল, অধ্যাপক সালাম তারাও ছিলেন ওখানে। ইছাকাঠি গার্ডেন, কাশিপুরে ট্রেনিং করাই। জায়গাটা ছিল লাকুটিয়া জমিদারবাড়িতে, একটা মাঠে।
তিন-চার দিন পরই বরিশালে পাকিস্তানি আর্মিরা আসে। প্যারাট্রুপাররাও নামে। ভারী মেশিনগানের সামনে আমরা টিকতে পারি না। আমরা তখন চলে যাই আটঘর কুড়িআনায়। প্যাঁচানো খাল আর পেয়ারাবাগান ওখানে। চলাচলের জন্য ‘হাক্কা’ ছিল একমাত্র উপায়। বরিশালের ভাষায় ‘হাক্কা’ হলো একটি বাঁশ। একটি বাঁশ দিয়ে তৈরি পুল দিয়েই চলাচল করতে হতো। বুট পরে তার ওপর দিয়ে যাওয়া খুব কঠিন। এসব কারণে জায়গাটা আমাদের জন্য নিরাপদ ছিল।
তবুও পাকিস্তানি সেনারা গানবোট নিয়ে আক্রমণের চেষ্টা করত। রমা দাস, বীথিকা রানী বিশ্বাস, সমিরন, হরিমন বিশ্বাসসহ আরও অনেক মেয়ে ওখানে ট্রেনিং করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। অধিকাংশই ছিল কলেজছাত্রী। এ ছাড়া সেখানে ছিল পরিমল, ভুলু, তারেক প্রমুখ। আমাদের কাছে দুইটা স্টেনগান, ত্রিশটির মতো রাইফেল। তা দিয়েই যতটা সম্ভব ঠেকিয়েছি। ছোটখাটো যুদ্ধও চলেছে। একসময় অস্ত্রের সংকটে পড়ি। তখন নির্দেশ আসে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ইন্ডিয়া চলে যাওয়ার। ফলে আমরাও ইন্ডিয়ায় চলে যাই।
৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর এম এ জলিল। তিনি বেগকে পেয়ে একটি কোম্পানির দায়িত্ব দেন। ভারতের বসন্তপুরের সীমান্তে একটি রাইস মিলে প্রথম ঘাঁটি গাড়েন মাহফুজ আলম বেগ। সামনে নদী। ওপারে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প। বেগের গ্রুপে প্রথম ২০০ মুক্তিযোদ্ধা থাকলেও পরে তা বেড়ে হয় ৫০০। ৯ নম্বর সেক্টরের অপারেশনাল কমান্ডারও ছিলেন তিনি। পরে তাকে শমসেরনগর সাব-সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সাতক্ষীরা অঞ্চলে গেরিলা, সম্মুখ ও নৌ-কমান্ডো যুদ্ধগুলো পরিচালনা করেন মাহফুজ আলম বেগ। পারুলিয়া ব্রিজ, খাঞ্চিয়া বর্ডার আউট পোস্ট (বিওপি), উকসায় মাইন বিস্ফোরণ, ভাতশালা, কেয়ারগাতি রাজাকার ঘাঁটি বিনাশ, বিউটি অব খুলনা নৌযান পুনরুদ্ধার, হবিনগর কৈখালী পাকিস্তানি গানবোটে অভিযান, কেয়ারগাতিতে গানবোট আক্রমণ, শ্যামনগর যুদ্ধ, মাগুরা শিশির অভিযান, আশাশুনিতে পাকিস্তানি ঘাঁটি ধ্বংস, কালীগঞ্জের যুদ্ধ, গোয়ালডাঙ্গার যুদ্ধ, কালীগঞ্জে রাজাকার ঘাঁটি দখল, বসন্তপুর অপারেশন, চাপড়া রাজাকার ক্যাম্প ও আশাশুনি থানা অপারেশন, সাতক্ষীরা শহরে পাওয়ার হাউজে দুঃসাহসিক অভিযান, কৈখালীতে সংঘর্ষ, শ্যামনগরে অপারেশন ও কালীগঞ্জ থানা পুনরুদ্ধার যুদ্ধ প্রভৃতি অপারেশনসহ বরিশালের দোয়ারিকায় এক কোম্পানি পাকিস্তানি সেনাকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন এই যোদ্ধা।
রণাঙ্গনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হন এই বীর। স্মৃতি হাতড়ে তুলে আনেন একাত্তরের দুঃসাহসিক সেই দিনগুলোর কথা। তার ভাষায়, এমন রাত ছিল না যে অপারেশন করিনি। পাকিস্তানি আর্মিরাই নাকি বলত, ‘বেগ ইজ ফর আস, নাইট ইজ ফর বেগ’। যত অপারেশন হয়েছে, সেগুলো আমি, মেজর জলিল আর ইন্ডিয়ান আর্মির চার্লি সেক্টরের অফিসাররা প্ল্যান করতাম।
ছোটদের নিয়ে একটা গ্রুপও করেছিলাম। তাদের বয়স ১১-১৪ বছরের মতো। সাতক্ষীরা, খুলনা ও বরিশালের কিশোররা ছিল সংখ্যায় চল্লিশের মতো। গ্রুপটির নাম দিই ‘হার্ড কর্পস অব সার্জেন্টস’। আসলে ওরা বিচ্ছুবাহিনী। ওদের এসএমজি, রাইফেল ও গ্রেনেডের ওপর ট্রেনিং দেওয়া হয়। নৌকা চালানোর ওপর ছিল বিশেষ ট্রেনিং। তাদের মূল কাজ ছিল অ্যামুনেশন ক্যারি (গোলাবারুদ বহন), ইন্টেলিজেন্সের (গোয়েন্দা) কাজ করা। ওরা গল্প বলে আর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কথা বলে পাকিস্তানি সেনাদের বিশ্বস্ততা অর্জন করত। পরে ক্যাম্পে ঢুকে ওদের ঠ্যাং টিপে ফিরে এসে বয়ান করত ক্যাম্পের কোথায় কী আছে। তাদের কাজে ঝুঁকি ছিল অনেক। যেখানে প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারাও যেতে চাইত না, সেখানে ওরা বলত, ‘স্যার, আমি যাব।’
জলিল সাহেব একবার প্ল্যান করলেন পাকিস্তানি গানবোটকে কাউন্টার (জবাব) দিতে হবে। গানবোটে ৪০ মিলিমিটারি গান থাকে। ইপিআরের (তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) স্টিল বডি লঞ্চ ছিল তখন। ব্রিগেডিয়ার সালেক ছিলেন ইন্ডিয়ান আর্মির (ভারতীয় সেনাবাহিনী) চার্লি সেক্টরের কমান্ডার। তাকে রিকোয়েস্ট করে আনা হয় ভারী মেশিনগান। সেগুলো লঞ্চে স্থাপন করে গানবোট বানানো হয়। ‘বঙ্গ বজ্র’ নামের দুটি লঞ্চকেই গানবোট হিসেবে ব্যবহার করতাম আমরা। প্রথম নেভি (নৌবাহিনী) বলতে গেলে ৯ নম্বর সেক্টরেই শুরু হয়। নেভির লেফটেন্যান্ট গাজী, লেফটেন্যান্ট আলম ছিলেন। তাদের দিয়েই নৌ অপারেশনগুলো প্ল্যান করা হতো।
বরিশালের দোয়ারিকায় পাকিস্তানি সেনাদের একটা ক্যাম্প ছিল। পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন কাহারের নেতৃত্বে সেখানে ছিল বেলুচ রেজিমেন্টের একটা কোম্পানি। আমাদের পুরো ব্যাটালিয়ন ঘিরে ফেলে ওদের। পাকিস্তানি আর্মি ছাড়া ওরা সারেন্ডার করবে না। পরে তারা অস্ত্র ফেলে আমার নিয়ন্ত্রণে থাকে। দোয়ারিকা থেকে তাদের নিয়ে আসা হয় ওয়াবদায়। পাকিস্তানি আর্মি মাথা নিচু করে ওয়াবদার দিকে মার্চ করছে আর অস্ত্র উঁচিয়ে তাদের নিয়ে যাচ্ছেন ছেঁড়া শার্ট আর ছেঁড়া লুঙ্গি পরা মুক্তিযোদ্ধারা। এই দৃশ্যটা কখনো ভুলতে পারব না। পরে তাদের ইন্ডিয়ান আর্মির কাছে হ্যান্ডওভার করি।
নয় মাসে দেশ স্বাধীন হওয়ার অন্তর্নিহিত কারণ তুলে ধরেন এই সূর্যসন্তান। তার ভাষায়, সেøাগান দিয়েই তো আমরা দেশ জয় করেছি। পাকিস্তানিরা আসছে অন্যের দেশে। জোর কইরা একটা যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে মাতবরি করতে আসছে। আর আমাদের দেশেই আমরা। নদী-নালা, খাল-বিল, পাহাড় সব চেনা। এখানে আমরাই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। পৃথিবীর ইতিহাসে শুনছেন ৯০ হাজার ওয়েল ইকুয়েপড (সুসজ্জিত) সেনা সারেন্ডার (আত্মসমর্পণ) করেছে। একমাত্র যদি তারা কাপুরুষ না হয়। এমন নয় যে তাদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে গিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যই হয়েছে এটা। যারা ছিল আইডোলজিক্যাল (আদর্শিক) যোদ্ধা। আমি নামক কোনো শব্দ ছিল না মুক্তিযুদ্ধে। ছিল আমরা। এই দেশ আমার মায়ের দেশ। মাকে মুক্ত করাই তখন ছিল সবচেয়ে বড় কাজ। প্রতিটি মুুক্তিযোদ্ধার বুকে তখন একটাই আগুন ছিল মাতৃভূমিকে মুক্ত করা।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১৬ ডিসেম্বর ২০২২
© 2022, https:.