অপারেশন জ্যাকপট চাঁদপুর অ্যাটাক
ভারতের হাতিমারা ক্যাম্পে, আমরা তখন পাঁচশোর মতো। এক রাতে হঠাৎ হুইসেল। ফল-ইন করানো হয় সবাইকে। আটজন বাঙালি সাবমেরিনার ফ্রান্স থেকে পালিয়ে চলে আসেন দিল্লিতে। প্রবাসী সরকার তাদের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করে। বাংলাদেশ যেহেতু নদীমাতৃক দেশ, তাই নেভাল ইউনিট প্রয়োজন। এ কারণে নৌ-কমান্ডো বাহিনী গঠন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে উদ্দেশ্যেই ইন্ডিয়ান নেভির তিনজন অফিসারসহ ওইদিন হাতিমারা ক্যাম্পে আসেন বাঙালি সাবমেরিনার রহমত উল্লাহ (বীরপ্রতীক)।
নৌ-কমান্ডো হিসেবে কারা যোগ দিতে প্রস্তুত? উনি (রহমত) প্রশ্ন করতেই অনেকে হাত তুলল। কিন্তু তারা বেছে নিল পোর্ট এরিয়ার ছেলেদের। বিশেষ করে যাদের বাড়ি চট্টগ্রাম, মোংলা, খুলনা, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জের মতো এলাকায়। সাঁতার জানতে হবে, বিদেশিরা ট্রেনিং দেবে তাই ইংরেজি জানা শিক্ষিত বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া হতে হবে এমনটাই ছিল যোগ্যতা।
প্রাথমিকভাবে ৭০-৮০ জনকে বাছাই করা হয়। এরপর সবাইকে জানানো হলো এটা হবে সুইসাইডাল স্কোয়াড। স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে রাজি কারা? অনেকেই তখন হাত নামিয়ে নিল। অতঃপর ফিটনেস দেখে সিলেকশন করা হয় ৩০-৩২ জনকে। আমিসহ চাঁদপুরের ১৪ জনের ভেতর ১৩ জনই টিকে যায়।
ধর্মনগর হয়ে ট্রেনে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ভারতের মুুর্শিদাবাদে। ট্রেনিং ক্যাম্পটি ছিল পলাশীতে, ভাগিরথী নদীর তীরে। ১৪ মে ১৯৭১ আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেনিং শুরু হয়। সুইসাইডাল স্কোয়াড। তাই আগেই বন্ডে স্বাক্ষর দিতে হয়। সেখানে লেখা ছিল এমন ‘আমি স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হইয়া এই ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করছি। যুদ্ধে আমার যদি মৃত্যু হয় কেউ দায়ী থাকবে না।’
ট্রেনিংয়ে শেখানো হয় উল্টো বা চিত হয়ে সাঁতার কাটা, পায়ে ফিনস পরে শুধু চোখ-নাক ভাসিয়ে পানিতে মাছ বা সাপের মতো নিঃশব্দে চলা, অপারেশনে পাহারাদারদের মারতে জুডো-কারাতে ট্রেনিং, দিক চেনার জন্য ম্যাপ রিডিং, মাইন বিস্ফোরণ প্রভৃতি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত মাইনগুলো ল্যান্ডে ব্যবহার করা হতো। যুগোশ্লাভিয়া থেকে সে মাইন দেওয়া হয় ভারতকে। কিন্তু এগুলো তো ব্যবহৃত হবে জলে। তাই ওই মাইনে ওয়াটার-টাইট করে চুম্বক ফিট করা হয়। একেকটা মাইনের ওজন ছিল পাঁচ-ছয় কেজি। অপারেশনে সেগুলোই জাহাজে ফিট করে ওড়াতে হবে। বুকে দুই-তিনটা ইট বেঁধে আমাদের সে কৌশলই শেখানো হয় ভাগিরথী নদীর জলে।
২০ জন করে একেকটি গ্রুপ ছিল। ‘এইচ’ গ্রুপে আমি ওই গ্রুপের কমান্ডও করতাম। ট্রেনিং চলে ৩১ জুলাই ১৯৭১ পর্যন্ত। ভারতীয় নৌবাহিনীর কমান্ডার এমএন সামন্ত, লে. কমান্ডার জিএম মার্টিস, লেফটেন্যান্ট কপিল, কে সিং ও ক্যাপ্টেন সমীর কুমার দাশের তত্ত্বাবধানে ট্রেনিং হয় নৌ-কমান্ডোদের। ট্রেনিং করান কে এম দাস, ভট্টাচার্য, কফিল, সিসিং, নানাবুজ প্রমুখ।
একাত্তরে নৌ ও এয়ার কমান্ডো ট্রেনিংয়ের বিষয়টি খুবই গোপনীয়তা রক্ষা করে করা হয়। ধরেই নেওয়া হয়েছিল অপারেশনে আমরা ম্যাক্সিমাম মারা যাব। মাইন ছাড়া অস্ত্র ছিল শুধু একটি কমান্ডো নাইফ। কিন্তু বুকে ছিল দেশপ্রেম আর মাতৃভূমিকে মুক্ত করার তীব্র বাসনা। তাই মরতে গিয়েও জীবন নিয়ে ফিরে এসেছিলাম। আমরা তো ইতিহাস বলার সুযোগ পাচ্ছি। কিন্তু দেশের জন্য যারা জীবন দিল, রক্ত দিল স্বাধীনতার জন্য তাদের না বলা কথাগুলো লিখবে কে?
একাত্তরে নৌ-ট্রেনিংয়ের কথা এভাবেই তুলে ধরেন নৌ-কমান্ডো মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহজাহান কবির (বীরপ্রতীক)। তার বাবা মো. ইব্রাহীম বিএবিটি (বিটি সাহেব নামে পরিচিত) ছিলেন চাঁদপুরের সফরমালি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। মা আসিয়া বেগম গৃহিণী। বাড়ি চাঁদপুর সদর উপজেলার দাশাদি গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন বি.কম ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। শাহজাহান কবিরদের ট্রেনিং শেষে পরিকল্পনা করা হয় অপারেশন জ্যাকপটের। কেমন ছিল সেই অপারেশন?
এই নৌ-কমান্ডো জানান চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ (দাউদকান্দি ফেরিঘাটসহ) নদীবন্দরে একই ডেটে ও টাইমে অপারেশন চালাতে হবে। তিনশোর মধ্য থেকে সিলেকশন করা হয় ১৬০ জনকে। চট্টগ্রামের জন্য ৬০, মোংলার জন্য ৬০, চাঁদপুরের জন্য ২০ ও নারায়ণগঞ্জের জন্য ২০ জন নৌ-কমান্ডোর গ্রুপ তৈরি করা হয়। ফ্রান্স-ফেরত সাবমেরিনার এডাব্লিউ আবদুল ওহেদ চৌধুরীকে (বীরউত্তম ও বীরবিক্রম) চট্টগ্রাম, আহসান উল্লাহকে (বীরবিক্রম) মোংলায়, বদিউল আলমকে (বীরউত্তম) চাঁদপুরে এবং নারায়ণগঞ্জে অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয় আবেদুর রহমানকে। ছোটভাই শামসুলসহ আমাকে রাখা হয় চাঁদপুরের গ্রুপে।
৯ আগস্ট ১৯৭১। চট্টগ্রাম, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ এ তিনটি গ্রুপকে সামরিক বিমানে আনা হয় আগরতলায়, শালবনের ভেতর নিউ ট্রানজিট ক্যাম্পে। ওখান থেকে বাংলাদেশে ঢুকে অপারেশন সেরে ওখানেই ফিরতে হবে। এক দিন পরই দেওয়া হয় আর্মস-অ্যামুনেশন প্রত্যেকের জন্য একটা লিমপেড মাইন, একটা কমান্ডো নাইফ, একজোড়া ফিন, থ্রি নট থ্রিসহ কিছু অস্ত্র এবং প্রত্যেক গ্রুপের জন্য একটা টু ব্র্যান্ডের রেডিও। বলা হলো ওই রেডিওর মাধ্যমেই সিগন্যাল পাঠানো হবে।
কুমিল্লার ময়নামতি হয়ে আমরা চাঁদপুর আসি ১১ আগস্টে। প্রথমে উঠি নিজ বাড়ি দাশাদিতে, মেঘনা নদীর পাড়ে। কিন্তু যেতে হবে চাঁদপুরের দক্ষিণে, ডাকাতিয়া নদীর কাছাকাছি। ওই দিকটাতেই থাকে অধিকাংশ লঞ্চ ও স্টিমার। করিম খাঁ নামে এক মামার বাড়ি ছিল রঘুনাথপুরে। বাবার পরামর্শে পরদিন ইলিশ ধরার তিনটি নৌকায় ওখানে গিয়ে উঠি। অতঃপর রেডিওতে নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকি।
বলা ছিল ‘প্রত্যেকদিন তোমরা আকাশবাণী বেতারকেন্দ্র ধইরা রাখবা। ওটার মাধ্যমে সিগন্যাল পাবা। কেমন সিগন্যাল? আকাশবাণীতে সকাল ৭টা বা সাড়ে ৭টায় বাজবে একটি গান ‘আমি তোমায় শুনিয়েছিলাম যত গান।’ এ গান হলেই অপারেশনের যাবতীয় প্রস্তুতি নিতে হবে। ২৪ ঘণ্টা পর আরেকটা গান বাজবে ‘আমার পুতুল আজকে যাবে শশুড়বাড়ি।’ এ গানটি হলেই বুঝতে হবে চূড়ান্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং ওইদিন রাত ১২টার পর অবশ্যই অ্যাটাক করতে হবে।
১৩ আগস্ট সকালে বাজল প্রথম গানটি। আমি, নুরুল্লাহ পাটওয়ারী, বদিউল আলম সঙ্গে সঙ্গে পাটের ব্যাপারী সেজে রেকি করতে বেরোই। ২৪ ঘন্টা পর অর্থাৎ ১৪ আগস্ট চূড়ান্ত নির্দেশনার গানটি বাজার কথা ছিল। কিন্তু ওইদিন সেটি না বেজে বাজল ১৫ আগস্ট সকালে। ফলে রাত ১২টার পরই আমরা অ্যাটাকের প্রস্তুতি নিই। লঞ্চ টার্মিনাল ও স্টিমার ঘাটসহ ছয়টা টার্গেট প্লেস ঠিক করে ফেলি।
তিনটা মাইন লাগালে একটা জাহাজ হানড্রেট পারসেন্ট ডুবে যায়। সেটি করতে লাগবে তিনজন নৌ-কমান্ডো। তাই তিনজন করে ছয়টা গ্রুগে টার্গেট ভাগ করে নিই। বাকি দুজন থাকবে রেসকিউ টিমে। আমার সঙ্গে থাকে খুলনার আফসার আর সাতক্ষীরার গফুর মাস্টার। টার্গেট প্লেস ছিল লন্ডনঘাট জেটি। ওখানে পাকিস্তানি সেনারা আর্মস-অ্যামুনেশন আর মালামাল নামাত। তাই জেটিটি ডোবাতে হবে।
রাত সাড়ে ১১টার দিকে ডাকাতিয়া নদী দিয়ে নামি। পায়ে ফিনস, পরনে শুধু জাঙ্গিয়া। বুকে গামছা দিয়ে মাইন পেঁচিয়ে চিত সাঁতারে এগোই। কিছুক্ষণ পরপরই দেখে নিই দিকটা। এভাবে লন্ডনঘাটে এসেই জেটিতে মাইন সেট করে দিই। ৪৫ মিনিট পরই বিস্ফোরণ ঘটবে। তাই ওই সময়ের মধ্যেই সরে পড়তে হবে।
পুরো বর্ষা ছিল তখন। মুখার্জি ঘাটে পাহারায় ছিল পাকিস্তানি সেনারা। নদী দিয়ে কী যায়? এটা বলেই ওরা পানিতে দুটো ফায়ার করে। তখন ডুব দিয়ে দূরে গিয়ে উঠি আমরা। এর কিছুক্ষণ পরেই লন্ডনঘাটসহ জাহাজে লাগানো অন্যান্য গ্রুপের মাইনগুলো বিস্ফোরিত হতে থাকে।
ওই সময়েই খুলনা থেকে পাকিস্তানি বাহিনী নিয়ে গাজী ইস্টিমার চাঁদপুর ঢুকছিল। বিস্ফোরণের আগুন দেখেই ওরা ঘাবড়ে যায়। ভয়ে জেটি থেকে দূরেই নোঙর করে। এরপর চারপাশে সার্চলাইট ফেলে পাগলের মতো এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। তখন কচুরিপানায় নিজেদের লুকিয়ে রাখি।
বহরিয়া গ্রামের মাঝামাঝি স্থানে মাছ ধরার অনেক নৌকা থাকে। কথা ছিল দুটি নৌকা নিয়ে সেখানেই থাকবে রেসকিউ টিমের দুজন। কিন্তু বিস্ফোরণের পর পাকিস্তানি সেনারা দিশেহারা হয়ে গানবোট নিয়ে চারপাশে টহল দিতে থাকে। ওদের ভয়ে রেসকিউ টিমের দুজন নৌকা ছেড়ে গ্রামের ভেতর আত্মগোপন করে। ফলে ফিরে এসে নৌকা না পেয়ে বিপদে পড়ি আমরা। ধরা পড়ার চান্স ছিল। কিন্তু মৃত্যু ভয় ছিল না। তখন যে যার মতো সরে পড়ি। একটা নৌকা নিয়ে আমি চলে যাই নিজ বাড়ি দাশাদিতে। অপারেশন জ্যাকপট সফল হয়।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২ ডিসেম্বর ২০২২
© 2022, https:.