মুক্তিযুদ্ধ

নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর অ্যাটাক

বীর মুক্তিযোদ্ধা নৌ-কমান্ডো মো. মতিউর রহমান (বীরপ্রতীক)। তার বাবা আব্দুল আলী ছিলেন কাপড়ের ব্যবসায়ী আর মা জোলখা বেগম গৃহিণী। ৫ ভাই ২ বোনের সংসারে মতিউর তৃতীয়। বাড়ি মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার সাতঘড়িয়া গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণগাঁও হাইস্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্র।

ট্র্রেনিংয়ে যাওয়া নিয়েই একাত্তরের প্রসঙ্গে আলাপচারিতা শুরু হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, মে মাসের শেষের দিকে এক দুপুরে খেলার কথা বলে বের হই। পাশের গ্রামের শহিদুল ইসলাম ছিল পথ প্রদর্শক। ভারতে যাওয়ার পথ চিনত সে। ফরিদপুর দিয়ে যশোর হয়ে ভারতের চব্বিশ পরগনায় যাব। কিন্তু বাগদা বর্ডার পার হওয়ার আগেই সঙ্গের দুই বন্ধু মত পাল্টাল। তারা বাড়িতে ফেরত গেল। আরেক জন ভারতে গিয়ে আর ট্রেনিংয়ে যেতে চাইল না। তখন আমি একা। কিন্তু সিদ্ধান্তে অটল। লোকমুখে ঠিকানা জেনে বাসে উঠে বসি। পকেটে টাকা নেই। ভাড়া দিতে না পারায় মাঝপথেই নেমে যেতে হয়। পরে হেঁটেই চলে যাই বনগাঁ, টালিখোলা ক্যাম্পে। সেখানে বিকেলের দিকে লাইনে দাঁড়াতেই নিয়ে নিল। প্রায় দুই সপ্তাহ লেফট-রাইট আর ক্রলিং করানো হয় ওই ক্যাম্পে।

নৌ-কমান্ডো ট্রেনিং কি ওই ক্যাম্পেই হয়েছিল? না। টালিখোলা ক্যাম্পে একদিন আসেন ওসমানী সাহেব। সঙ্গে ছিলেন ইন্ডিয়ান নেভির প্রধান। একাত্তরে আটজন বাঙালি সাবমেরিনার জাহাজ আনতে গিয়েছিলেন ফ্রান্সে। তারা ওখান থেকেই পাকিস্তান-পক্ষ ত্যাগ করে পালিয়ে চলে আসেন ইন্ডিয়ায়। তারাও ওই দিন ওসমানীর সঙ্গে আসেন। প্রথমে সবাইকে ফল-ইন করানো হয়। পরে বাছাই করা হয় ৬০ জনকে। মেডিকেল টেস্টে বাতিল হয় ২০ জন। আমিসহ ৪০ জনকে বলা হলো একটা গ্রুপ করা হবে, যারা অপারেশনে গেলে মরতেও হতে পারে। আমরা রাজি হয়ে যাই: ‘মরতে হলে দেশের জন্য মরমু।’

আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় মুর্শিদাবাদে ভাগীরথী নদীর পাড়ে। ওটা ছিল পলাশীর প্রান্তর। অন্যান্য ক্যাম্প থেকেও বাছাই করে আনা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। অপারেশন জ্যাকপটে আমরা ছিলাম সুইসাইডাল স্কোয়াড। ট্রেনিংয়ের শুরুতেই একটা ফরমে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। ইন্ডিয়ান নেভি ট্রেনিং করায়। প্রথম দিকে প্রত্যেককে পায়ে ফিনস পরে চিৎসাঁতারের অভ্যাস করানো হয়। বুকে গামছা বেঁধে ৪-৫ কেজি ওজনের মাটির ঢিবি বা ইট বেঁধে নদীতে চিৎসাঁতার করানো হতো। সবচেয়ে কঠিন ছিল ডুব দিয়ে পানির নিচে লোহার প্লেটে মাইন লাগিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সাঁতার কেটে ফেরত আসা। কেউ মারতে এলে তাকে প্রতিহত করার যুদ্ধও শেখানো হয়। প্রতিদিন ১৭-১৮ ঘণ্টা প্রশিক্ষণ হতো। আমার নৌ-কমান্ডো নম্বর ছিল ০০৪৪। বিশেষ কমান্ডো ট্রেনিং চলে প্রায় আড়াই মাস।

নৌ-কমান্ডোরা ছিলেন ১০ নম্বর সেক্টরের অধীনে। কোনো কমান্ডার ছিল না এই সেক্টরে। প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী এটা নিয়ন্ত্রণ করতেন। অপারেশনের জন্য যখন নৌ-কমান্ডোদের বিভিন্ন সেক্টরে পাঠানো হতো, তখন তারা ওই সেক্টরের অধীনেই কাজ করতেন। অপারেশন শেষে আবার ১০ নম্বর সেক্টরের অধীনে চলে আসতেন তারা।

নৌ-কমান্ডো ট্রেনিং শেষেই অপারেশন জ্যাকপটের পরিকল্পনা করা হয়। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম, মোংলা সমুদ্রবন্দর, চাঁদপুর এবং নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরসহ দাউদকান্দি ফেরিঘাটে নৌ-অ্যাটাকের পরিকল্পনা এটি। ১৬০ জন নৌ-কমান্ডোকে কয়েকটি দলে ভাগ করা হয়। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর অ্যাটাকের জন্য সাবমেরিনার আবদুল ওয়াহিদের নেতৃত্বে ৬০ জন, মোংলা সমুদ্রবন্দরের জন্য সাবমেরিনার আহসান উল্লাহর নেতৃত্বে ৬০ জন, চাঁদপুর নদীবন্দরের জন্য সাবমেরিনার বদিউল আলমের নেতৃত্বে ২০ জন এবং নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরসহ দাউদকান্দি ফেরিঘাটের জন্য সাবমেরিনার আবিদুর রহমানের নেতৃত্বে ২০ জন নৌ-কমান্ডোকে পাঠানো হয়। মতিউর রহমান ছিলেন নারায়ণগঞ্জের গ্রুপে।

অপারেশন জ্যাকপট কীভাবে করলেন? বীরপ্রতীক মতিউর বলেন, ট্রেনিংয়ের পর আমাদের পাঠানো হয় আগরতলায়, নিউ ট্রানজিট ক্যাম্পে। সেখানে প্রত্যেককে দেওয়া হয় একটি লিমপেট মাইন, ফিনস, সুইমিং কস্টিউম, নাইফ, কাঁধে ঝোলানোর চটের ব্যাগ, কিছু কাপড়চোপড়, বন্দরের ম্যাপ ও জোয়ার-ভাটার চার্ট প্রভৃতি। প্রতিটি গ্রুপকে একটি রেডিও দেওয়া হয়। নারায়ণগঞ্জের গ্রুপে সাবমেরিনার আবিদুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা ছিলাম ২০ জন। বর্ডার পার হলে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা পথ দেখিয়ে নিরাপত্তা দিয়ে আমাদের গন্তব্যে নিয়ে আসে। নারায়ণগঞ্জে মুসার চরে আমরা আত্মগোপন করে থাকি। নদীবন্দর থেকে সেটি ছিল প্রায় এক মাইল দূরে।

লিমপেট মাইন গামছা দিয়ে বুকে বেঁধে জাহাজে লাগাতে হবে; বড় জাহাজে তিনটি আর ছোট হলে দুটি মাইনেই চলবে। ডুব দিয়ে আগে দেখতে হবে জাহাজের গায়ে শ্যাওলা আছে কি না, থাকলে জায়গাটা পরিষ্কার করে মাইন ফিট করতে হবে। নোঙর করা অস্ত্র ও গোলা-বারুদপূর্ণ পাকিস্তানি জাহাজই টার্গেট। বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দ্রুত ফিরে যেতে হবে ট্রানজিট ক্যাম্পেএমন নির্দেশনাই দেওয়া ছিল অপারেশন জ্যাকপটের নৌ-কমান্ডোদের।

বলা হয়েছিল, ভারত থেকে সিগন্যাল আসবে রেডিওতে গানের মাধ্যমে। নির্ধারিত প্রথম গানটি বাজে ১৯৭১ সালের ১৩ আগস্ট সকালে। এরপর আমরা রেকি করতে বের হই। আদমজী জুটমিলের মসজিদের উঁচু মিনারে উঠে বন্দরে আর্মি-পজিশন, জাহাজের পজিশন দেখে কমান্ডারকে গিয়ে বলি। রেডিওতে প্রথম গানটি শোনানোর ২৪ ঘণ্টা পর দ্বিতীয় গানটি বাজবে, ওই দিন রাতেই আক্রমণ করতে হবে। এমনটাই ছিল পরিকল্পনায়। কিন্তু দ্বিতীয় গানটি শোনানো হয় এক দিন পর, অর্থাৎ ১৫ আগস্ট সকালে। ফলে ওই দিন রাতেই নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরে অপারেশনের প্রস্তুতি নিই আমরা।

আবিদুর রহমানের নেতৃত্বে অপারেশনে আমি ছাড়াও অংশ নেন আবদুর রহিম, হেদায়েত উল্লাহ, আজহার হোসেন, আনোয়ার হোসেন, হাবিবুল হক, মাহবুব আহমেদ মিলন, জি এম আইয়ুব, আবদুল মালেক, আবদুল জলিল, ফজলুল হক ভূঞা প্রমুখ।

আমার কাজ ছিল এক্সপ্লোসিভ দিয়ে নদীবন্দরের টার্মিনাল উড়িয়ে দেওয়া, যাতে অন্য কোনো জাহাজ ভিড়তে না পারে। এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে দ্রুত সরে আসি। সঙ্গের তিনজন একটি পাকিস্তানি মালবাহী জাহাজের গায়ে মাইন ফিট করে চলে আসে। নির্ধারিত সময় পর জাহাজ ও টার্মিনালে বিস্ফোরণ ঘটে। পাকিস্তানি আর্মি তখন এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। দূর থেকে আমরা বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনি। অন্য রকম আনন্দ লেগেছিল তখন। এরপর ফিরে যাই আগরতলায়, নিউ ট্রানজিট ক্যাম্পে। অপারেশন জ্যাকপটের পর আমাদের দ্বিতীয় অপারেশন ছিল কাঁচপুর ফেরিঘাটে জাহাজ ও ফেরি ডুবিয়ে দেওয়া। সেটিতেও সফল হই। তৃতীয় নৌ-অ্যাটাক করি কলাগাইছায়পাকিস্তানি জাহাজে।

সাধারণ মানুষের অপরিসীম সাহায্য পেয়েছিলেন নৌ-কমান্ডোরা। তারা খাবার ও থাকার জায়গা দিয়ে পাশে থাকতেন। সোর্সও ছিল গ্রামের সাধারণ মানুষ। ঘাটে পাকিস্তানিদের বড় জাহাজ এলেই তারা মতিউরদের খবর দিত। দেশ যখন স্বাধীন হয় মতিউর তখন নারায়ণগঞ্জে। তারা ঢাকায় আসার সময় পথে পথে দেখেন মানুষের লাশ। ডিসেম্বরের শেষের দিকে তিনি ফেরে যান নিজ গ্রামে, মায়ের কাছে।

প্রজন্মের উদ্দেশে নৌ-কমান্ডো মো. মতিউর রহমান (বীরপ্রতীক) বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা ঘরে বসে থাকলে কি দেশ স্বাধীন হতো! মরার চিন্তায় যদি যুদ্ধে না যেতাম তাহলে কি স্বাধীনতা আসত! তোমরাও স্বপ্নটাকে বড় করো। অলস হইয়ো না, সব সময় চেষ্টা করে যাও। দেশের ও নিজের জন্য কাজ করো। কাজই তোমাদের এগিয়ে নেবে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১৫ ডিসেম্বর ২০২২

© 2022, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button