বগামারা রেলওয়ে ব্রিজ ও বাজিতপুরে আক্রমণ
একাত্তরে আমরা সামনাসামনি ও গেরিলা উভয় আক্রমণই করেছি। আগেই রেকি করা হতো। ল্যান্সনায়েক হাফিজ উদ্দিন ও এক সিভিলিয়ান ছেলে ছিল ভালো রেকিম্যান। গ্রুপে তখন ৫৫ জন। কমান্ডে সুবেদার নুরুল আজিম চৌধুরী। সঙ্গে ছিলেন সুবেদার বজলুর রহমান, আব্দুল লতিফ, ইদ্রিস, নায়েক আব্দুল হাইসহ অনেকেই। বগামারা রেলওয়ে ব্রিজ পাহারায় ছিল রাজাকাররা। আক্রমণের মুখে ওরা সরে পড়ে। পরে ব্রিজটা আমরা ভেঙে দিই।
ঠিক ওই সময়ই পাকিস্তানি আর্মিরা ট্রেনে করে চলে আসে উত্তর দিক থেকে। এ খবর জানা ছিল না। ওরা ট্রেন থেকে নামলে ম্যাসাকার করে দেবে। তাই আমরা রেললাইনের নিচের দিকে ধানক্ষেতে পজিশন নিয়ে গুলি করতে থাকি। বৃষ্টি হচ্ছিল মুষলধারে। তার ভেতরই চলে লড়াইটা। ওরাও ফায়ার করে। ফলে সুবেদার বজলুর রহমান ও আব্দুল লতিফ আহত হন। বৃষ্টির কারণে পাকিস্তানি সেনারা সুবিধা করতে পারেনি। ট্রেন ব্যাক করে পেছনে চলে যায়। পরে খবর পাই কিশোরগঞ্জ স্টেশনে গিয়ে ওরা অনেক লাশ নামিয়েছে। একাত্তরের মতো বৃষ্টি কখনো হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ওই বৃষ্টিও ছিল আশীর্বাদ।
একাত্তরের একটি অপারেশনের কথা এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা কনস্টেবল মো. আবু শামা। তিনি ছিলেন পুলিশের কনস্টেবল, ব্রাশ (বডি) নম্বর ছিল ৫০৩৪। ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে তিনি প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন এবং পাকিস্তানি সেনাদের হাতে বন্দিও হন। পরে ছাড়া পেলে চলে আসেন গ্রামের বাড়িতে, কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার পীরপুরে।
বাড়িতে কয়েক দিন থাকার পরই আবু শামা চলে যান আগরতলায়, নাইনটি ওয়ান বিএসএফ শালবনে। আগেই ট্রেনিং ছিল। তাই ওখান থেকে শুধু অস্ত্র সংগ্রহ করে ভেতরে চলে আসেন। ১৭ জনের একটা গ্রুপ ছিল তাদের। গ্রুপটিতে আর্মি, ইপিআর আর পুলিশের সদস্যরা ছাড়া সিভিল কেউ ছিলেন না। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেন তিন নম্বর সেক্টরে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, সিলেটের ও ঢাকারও কিছু অংশ নিয়ে ছিল এই সেক্টর। অপারেশন করেছেন কিশোরগঞ্জের গুতালিয়া মাইলপাশা, নিকলি থানা, বগামারা রেলওয়ে ব্রিজ, গুরাউতরা নদীতে, বাজিতপুর, সরারচর প্রভৃতি এলাকায়।
বাজিতপুর অপারেশনে মারাত্মকভাবে রক্তাক্ত হন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু শামা। পাকিস্তানি সেনাদের একটি গুলি তার বুকের ডান দিকের নিচ দিয়ে ঢুকে রগগুলো ছিঁড়ে বেরিয়ে যায়। ছোট ছোট কিছু স্পিøন্টারও বুকের ডান পাশ দিয়ে ঢুকে বাম পাশের ভেতরে চলে গেছে। সরিষা দানার মতো ওই স্পিøন্টারগুলো এখনো আবু শামার বুকের ভেতর রয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছিল শরীরে চর্বি যখন কমে যাবে তখন পেইন হবে। তাই হয়েছে। এখন তার বুকের ভেতর ব্যথা হয় মাঝেমধেই। ফলে স্বাধীনতার জন্য রক্ত দেওয়া এই যোদ্ধার যুদ্ধ চলছে শরীরের সঙ্গে। আহত হলেও ওই অপারেশনে বাজিতপুর মুক্ত হয়েছিল।
কী ঘটেছিল রক্তাক্ত ওই দিনে? জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা আবু শামা অকপটে বলেন, ‘অক্টোবর মাসের ঘটনা। আমাদের গোপন মিটিং হয় বাজিতপুরের খইকুড়ি নামক জায়গায়। গ্রুপ কমান্ডার মেজবাহ উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন সেখানে। সিদ্ধান্ত হয় বকতারপাড়া ও বগামারা রেল ব্রিজটা ভেঙে দেওয়ার। যাতে ভৈরব ও কিশোরগঞ্জ থেকে ট্রেনে পাকিস্তানি ফোর্স ঢুকতে না পারে। পরিকল্পনা মোতাবেক কুলিয়ারচরের মুক্তিযোদ্ধা জিল্লুর, মঞ্জু ভাইসহ একটি গ্রুপ বকতারপাড়া ব্রিজ আর আমরা বগামারা ব্রিজটা ভেঙে দিই। এরপর অক্টোবরের ২০ তারিখের পর সরারচর ও বাজিতপুরের ভেতরে থাকা আর্মি ও রাজাকারদের ওপর একই টাইমে আক্রমণ করি। ওই অপারেশনেই একই সঙ্গে সরারচর ও বাজিতপুর শত্রুমুক্ত হয়।
বাজিতপুর আক্রমণের গ্রুপটিতে ছিলাম আমি। আক্রমণটা হয় ভোররাতে। বাজিতপুরের বাঁশমল নামক জায়গায় ছিল পাকিস্তানি আর্মিরা। আর থানা এলাকায় ছিল মিলিশিয়া ফোর্স আর রাজাকাররা। সব মিলে ওরা পঁচাত্তরজনের মতো, সবাই নিহত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে।
উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বআমরা তিন দিক থেকে আক্রমণ করি। পশ্চিম দিকটা ছিল খোলা। আমাদের গ্রুপে সুবেদার মেজর নুরুল আজিম চৌধুরী, প্রফেসর ইয়াকুব, সুবেদার বজলুর রহমান, হাবিলদার ইদ্রিস, নায়েক আব্দুল হাইসহ ছিলেন অনেকেই। একেবারে থানার কাছাকাছি চলে আসি আমরা। গোলাগুলি চলছে প্রচ-। একতলা বিল্ডিংয়ের মতো উঁচু ছোট্ট একটা জায়গা। ওখানে একটা আমগাছ। গাছের পাতার ভেতর ওদের একটা বাঙ্কার। পাকিস্তানি মিলিশিয়া এক সৈনিক ওত পেতে ছিল সেখানে। প্রথম দিকে সে নীরব থাকে। ফলে আমরাও খেয়াল করিনি।
মার্ক ফোর রাইফেল নিয়ে লাইন পজিশনে ছিলাম। পরে ক্রলিং করে এগোচ্ছি। ঠিক তখনই আমার মাথা লক্ষ্য করে একটা গুলি আসে ওই বাঙ্কার থেকে। নিচের দিকে থাকায় গুলিটি আমার বুকের ডান দিকের নিচ দিয়ে ঢুকে রগগুলো ছিঁড়ে বেরিয়ে যায়। ফলে নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বেরুতে থাকে। রগ ছেঁড়ার কারণে ডান হাতটা ঝুলে ছিল। বুকের চামড়াটা ছিঁড়ে মাংস বেরিয়েও যায়।
সহযোদ্ধারা দ্রুত সরিয়ে নেয় আমাকে। সুবেদার মেজর নুরুল আজিম চৌধুরী তখনই ওই আমগাছের ব্যাঙ্কারে একটা থ্রি-ইঞ্চি মর্টার নিক্ষেপ করে। বুকের দিকে তাকিয়ে রক্ত দেখে খানিক পরেই জ্ঞান হারাই। ভেবেছি মরে যাব।
গ্রামের ভেতরেই চিকিৎসা চলে। ডাক্তার মঞ্জু ও ওয়াহাব চিকিৎসা করেন। প্রথম গজ ঢুকিয়ে সেলাই করার চিন্তা ছিল। কিন্তু ওয়াহাব ডাক্তার বললেন, এটা করলে ইনফেকশন হয়ে যাবে। বরং প্রতিদিন গজ ঢুকিয়ে লোশন দিতে হবে। এতে ধীরে ধীরে ক্ষত ভেতর থেকে শুকিয়ে আসবে। তাই করা হয়। লোশন দিয়ে প্রতিদিন ওয়াশ করার সময় জীবনটা যেন বেরিয়ে যেত। কষ্টে চিৎকার করতাম। ছোট ছোট কিছু স্পিন্টারও বুকের ডান পাশ দিয়ে ঢুকে বাম পাশের ভেতরে চলে যায়। সেগুলো বের করা সম্ভব হয়নি। মাস দেড়েক চিকিৎসা চলে। এরপর আর রণাঙ্গনে ফিরতে পারিনি। আহত হলেও ওই অপারেশনে জয় লাভ করেছি। এটা ভেবেই তৃপ্ত হই।’
আবু শামার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অপরাধে তার বাবাকে টর্চার করে পাকিস্তানি সেনারা। তাদের বাড়িতেও আগুন দেওয়া হয়। সেসব কথা বলতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হন এই যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা। অতঃপর বলেন, ‘আমি তখন মুক্তিযুদ্ধে। গ্রামের একটা লোক গামছা দিয়ে মুখ ঢেকে পাকিস্তানি আর্মিদের বাড়ি চিনিয়ে দেয়। আর্মিরা এসে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় বাড়িটা। বাবাকে গাছের সাথে বেঁধে আমার কথা জিগাইছে। নির্দয়ভাবে মারছে তারে। এটাই বেদনাদায়ক। বুকে বুলেট লাগছে এটা এত কষ্ট দেয় নাই। কষ্ট হলো বাবাকে কেন এমনভাবে মারল ওরা। স্বাধীনের পর ফিরে আসলে বাবা কিছু বলেন নাই। শুনেছি অন্য লোকের মুখে। পরে বাবাকে বলি আপনে চিনছেন মুখ ঢাকা ওই লোকটাকে।
বাবা বলে, ‘না। আমাকে আর্মিরা গাছে বেঁধে পেটাচ্ছিল। তখন একজন দাড়িওয়ালা পাকিস্তানি ওদের থামিয়ে বলে রুকো রুকো, এ তো সুফি আদমি লাগতা হে। আপকা নাম কেয়া হে। নাম বলেছি। কালেমা জানতা হে? কালেমা পড়েছি। শুনে বলে, ছোড় দাও আদমিকো।’
বাবা আমাকে বুঝিয়ে বলেন, না জেনে কাউকে মেরো না বাবা। সুস্থ মস্তিষ্কে, সজ্ঞানে কোনো মানুষ যে খুন করে ওই গুনাহ মাফ হবে না। শত্রুর সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে তুমি মারছ সেটা ভিন্ন। তুমি মরতেও পারতে। যুদ্ধক্ষেত্রে ওটা ঠিক আছে। আমি দোয়া করি তুমি বেঁচে থাকো বহুদিন। তুমি দেশের জন্য বুকের রক্ত দিয়েছ। আমি পিতা হিসেবে তোমার জন্য গর্বিত।
যে পাকিস্তানি সেনা বাবাকে ছেড়ে দিয়েছে তার ভেতর হয়তো মনুষ্যত্ব ছিল। কিন্তু গ্রামের যে বাঙালি লোকটা বাড়ি চিনিয়ে দিয়েছে, ওর তো মানবতা বোধটুকুও ছিল না। এখনো জানতে পারিনি কে সে? যদি এর প্রতিশোধ নিতে পারতাম। তাহলে হয়তো সন্তুষ্ট থাকতাম। আমার জন্মদাতা পিতাকে টর্চার করেছে ওরা। মনে হলে এখনো কষ্ট পাই।
পরবর্তী প্রজন্মই বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে। তাদের নিয়েই স্বপ্ন দেখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কনস্টেবল মো. আবু শামা। তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে তোমরা অনুসরণ করো। চার নেতাকেও স্মরণে রেখো। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস যদি তোমরা জেনে নাও, তাহলে দেশপ্রেমিক হবে। তোমরাই এ দেশেকে সোনার বাংলা করবে।’
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১১ ডিসেম্বর ২০২২
© 2022, https:.