স্বাধীনতার জন্য ফুটবল
পৃথিবীর ইতিহাসে ‘যুদ্ধকালীন প্রথম ফুটবল দল’ বলা হয় এটিকে। দলটির প্রতিষ্ঠাতা সাইদুর রহমান প্যাটেলের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এলো স্বাধীনতার জন্য ফুটবল খেলার ইতিহাসটি।
২৫ মার্চ ১৯৭১। মুন্সিগঞ্জ হয়ে প্রথমে ভারতের আগরতলায় এবং পরে কলকাতায় চলে যাই। সঙ্গে ছিলেন তিনজন- লুৎফর রহমান, তার ছোট ভাই মুজিবর রহমান আর মোহসিন।
মে মাসের মাঝামাঝি সময়। আমরা তখন কলকাতায়, সুবোধ সাহার বাসায়। হঠাৎ চিন্তা আসে ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে কীভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধে অবদান রাখতে পারি? মনে মনে তখনই একটা ফুটবল দল গঠনের ইচ্ছা জাগে। সে দলের খেলা থেকে যে অর্থ আসবে তা দিয়ে দেওয়া হবে মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে। স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়তেও বিরাট ভূমিকা রাখবে সেটি।
পরিকল্পনাটা জানালাম সবাইকে। শুনে লুৎফর রহমান বলেন, ‘পাগল হয়েছিস। দেশে পাকিস্তানিরা লক্ষ লক্ষ লোক হত্যা করছে, মা-বোনদের টর্চার করছে। আর তুমি এখানে ফুটবল খেলবা!’
একটু রাগ হলো। তবুও দৃঢ়তার সঙ্গে বুঝিয়ে বললাম, ‘একটা মিনতি দিয়ে সারাদিন কাজ করলে একজন শ্রমিকের যে পরিশ্রম হয়, মাঠে আমরা যতক্ষণ ফুটবল খেলি এর চেয়ে কম পরিশ্রম হয় না। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে পয়সা পাবো সেটা দিয়ে দিবো মুক্তিযোদ্ধাদের তহবিলে। এর চেয়ে বড় কাজ আর কী হতে পারে!’
কলকাতায় আমাদের বেতার কেন্দ্রের নাম ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। ফলে আমরা যখন খেলতে নামলাম স্থানীয়রাই বলতে থাকল ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’। মানুষের মুখে মুখেই এভাবে নামকরণ হয়ে যায় দলটির। সব শুনে প্রস্তাবে তিনজনই সম্মতি দেয়। দেশপ্রিয় পার্কের পাশে ছোট্ট একটা চায়ের হোটেল। সেখানে বসেই ফুটবল দল গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে চারজন একটা খসড়া তৈরি করেন। তারপর সেটা নিয়ে যাওয়া হয় প্রিন্স সিফ স্ট্রিটে, এ এইচ এম কামরুজ্জামানের কাছে। পরিচয় দিয়ে প্যাটেল প্রস্তাবটি প্রথম তুলে ধরেন তার কাছে। শুনে ভীষণ খুশি হলেন তিনি। হাত খরচ হিসেবে তুলে দিলেন আটশ রুপি। পরে শামসুল হক সাহেব প্যাটেলদের নিয়ে যান তাজউদ্দীন আহমেদের কাছে, আট নম্বর থিয়েটার রোডে।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ফুটবল দল গঠনের প্রস্তাবটি শুনে তাজউদ্দীন আহমেদ এর উদ্দেশ্যটি জানতে চান। বললাম, ‘ম্যাচের গেট মানিটা আমরা মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে দিব। জনমত গঠনের ক্ষেত্রে এটা ভূমিকা রাখবে। আর খেলোয়াড়রাও স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অবদান রাখার সুযোগ পাবে।’
শুনে উনি জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ইয়াং চ্যাপ প্যাটেল। এত সুন্দর চিন্তা তোমাদের। কী করতে হবে বলো?’
আমি বললাম, ‘ইন্ডিয়ান সরকারের অনুমোদন লাগবে। ভারতব্যাপী খেলব আমরা। তাই লাগবে ইন্ডিয়ান ফুটবল ফেডারেশন (আইএফএফ) এবং অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনের (এআইএফএফ) অনুমতিও।’ তাজউদ্দীন আহমেদ বললেন, ‘সবকিছু আমি ও আমার সরকার করে দিবে।’ তারপর প্রাথমিক খরচের জন্য বেশ কিছু রুপি আমাদের হাতে তুলে দেন তিনি।
‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ নামটা হলো কীভাবে?
‘আসলে অফিসিয়ালি গঠন করা হয়েছিল ‘বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি’। শুধু ফুটবল নয়, সাঁতারসহ অন্যান্য খেলারও আয়োজন করার পরিকল্পনা ছিল সেখানে। কলকাতায় আমাদের বেতার কেন্দ্রের নাম ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। ফলে আমরা যখন খেলতে নামলাম স্থানীয়রাই বলতে থাকল ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’। মানুষের মুখে মুখেই এভাবে নামকরণ হয়ে যায় দলটির।’
খেলোয়াড়দের আহ্ববান জানিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিনিয়ত ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিল। তা শুনে আগরতলায় আসেন অনেকেই। নওশের, সালাউদ্দিন, এনায়েত, আইনুল হক ভাই ছিলেন নামকরা খেলোয়াড়।
তাজউদ্দীনের অনুমতি পেয়ে আমরা কাজে নামি। কারনানি ম্যানশনে সতেরো নম্বর ফ্ল্যাটটি ছিল আকবর আলীর। উনি কুমিল্লার লোক। ফ্ল্যাটটি নেওয়া হয় খেলোয়াড় রাখার জন্য। মাসিক ভাড়া ছিল সাড়ে চারশ রুপি। কিন্তু উনি আগ্রহ নিয়ে বিনা ভাড়াতেই থাকতে দিলেন। তার আগে পার্ক সার্কাস এলাকায় ‘সাখী’ নামক রেস্টুরেন্টে বসে প্রাথমিক একটি কমিটি করা হয়।
প্রথম কমিটিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চিফ পেট্রন রেখে সরকার অনুযায়ী পেট্রন নজরুল ইসলাম সাহেব ও পেট্রন তাজউদ্দীন আহমেদ। প্রথম সভাপতি ছিলেন শামসুল হক সাহেব, উনি দূত হয়ে বিদেশে চলে গেলে দ্বিতীয় সভাপতি হন আশরাফ আলী চৌধুরী। এমএনএ ছিলেন তিনি। উনিও চলে গেলে সভাপতি হন ওয়ারী ক্লাবের এম এ চৌধুরী (কালু ভাই)।
সেক্রেটারি হলেন লুৎফর রহমান। ট্রেজারার মোহসিন সাহেব। সদস্য ছিলেন এম এ হাকিম (তৎকালীন এমএনএ জামালপুর), আব্দুল মতিন (তৎকালীন এমপিএ ভালুকা), মজিবুর রহমান ভূঁইয়া প্রমুখ। ননি বোসাককে মুরব্বি হিসেবে কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রস্তাবক ও প্রধান সংগঠক হিসেবে রাখা হয় আমাকে।’
খেলোয়াড় সংগ্রহ হলো কীভাবে?
‘আমিই তখন একমাত্র খেলোয়াড়। কলকাতার রাস্তাতে দেখা হয় আবাহনীর আশরাফ ভাইয়ের সঙ্গে। উনি খেলতে আগ্রহী হলেন। জানালেন ট্রামে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে প্রতাব শংকর হাজরার, আলী ইমাম আছেন মোহনবাগান ক্লাবে, ইস্ট বেঙ্গলে আছে ওয়ারীর লুৎফর। এরই মধ্যে বন্ধু মঈনসেনাকে পাঠালাম ঢাকায়। সে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় গিয়ে বিখ্যাত খেলোয়াড় শাহজাহান, লালু ও সাঈদকে নিয়ে চলে আসে কলকাতায়।
এদিকে খেলোয়াড় আহ্ববান করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিনিয়ত ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিল। তা শুনে আগরতলায় আসেন অনেকেই। নওশের, সালাউদ্দিন, এনায়েত, আইনুল হক ভাই ছিলেন নামকরা খেলোয়াড়। ভারত সরকারের সহযোগিতায় আগরতলা থেকে তাদেরও আনা হয় বিমানে। আমি গেলাম আলী ইমাম ও প্রতাব দা’কে আনতে।
প্রথম লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করব, জাতীয় পতাকা উড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইব এবং ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে খেলা শুরু করব, এমনটাই ছিল আমাদের পরিকল্পনা।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে প্রথম যোগ দেন আলী আশরাফ ভাই। দ্বিতীয় প্রতাব দা, নুরুন্নবী ভাই। তৃতীয় আলী ইমাম ভাই। চতুর্থ লুৎফর। ইমাম ভাই আসেন তার দুইদিন পর। এভাবে ১৮-২০ জনের মতো চলে এসেছে। ইতোমধ্যে দল গঠন হয়ে গেছে। পার্ক সার্কাস পার্কের ভেতরের মাঠে চলছে অনুশীলন। অতঃপর ২৬ বা ২৭ দিন পর বালুঘাট থেকে আসেন জাকারিয়া পিন্টু। আসে তান্নাও। সে বেশ স্মার্ট ছিল। তাই ম্যানেজার করা হয় তাকে।
পরে জ্যেষ্ঠ বিবেচনায় জাকারিয়া পিন্টুকে অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সহ-অধিনায়ক করা হয় প্রতাব শংকর হাজরাকে।
প্রথম ম্যাচ হয় নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর মাঠে, ২৫ জুলাই ১৯৭১ তারিখে। প্রতিপক্ষ ছিল নদীয়া একাদশ। প্রথম লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করব, জাতীয় পতাকা উড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইব এবং ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে খেলা শুরু করব, এমনটাই ছিল আমাদের পরিকল্পনা।
কিন্তু প্রবাসী সরকারকে তখনও স্বীকৃতি দেয়নি ভারত। আট নম্বর থিয়েটার রোডে প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী অফিসেও ওড়েনি বাংলাদেশের পতাকা। ফলে পতাকা ওড়ানো ও জাতীয় সঙ্গীত বাজানোতে আইনি জটিলতা দেখা দেয়। পরিকল্পনার কথা শুনে নদীয়া জেলার তৎকালীন ডিসি ডিকে বোস বললেন, ‘আমার চাকরি থাকবে না’। আমরাও বেঁকে বসলাম। কেউ খেলব না। সারামাঠে তিল পরিমাণ জায়গা নাই। হাজার হাজার লোক খেলা দেখার অপেক্ষায়। পরে ডিসি সাহেব সাহস করেই অনুমতি দিলেন।
প্রথম জাতীয় পতাকা উড়িয়ে ও জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে খেলা শুরু করি। ওটাই আজ ইতিহাস। খেলাটি আধ ঘণ্টা পর্যন্ত ছিল ড্র। দ্বিতীয়ার্ধে শাহজাহান প্রথম গোলটা করে। পরের গোল করে এনায়েত। ২-২ গোলে ড্র হয় ম্যাচটি।
দ্বিতীয় ম্যাচটি ছিল গেস্টোপাল একাদশের বিপক্ষে। মোহনবাগানের দল। জাতীয় দলের খেলোয়াড়ও ছিল সেখানে। ওইদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি ছিল। বৃষ্টিভেজা মাঠ। দল যখন করি তখন শেখ কামাল ছিল প্রশিক্ষণে। ওইদিন সেও সেখানে ভিজেই খেলা দেখেছিল। ওই ম্যাচটা আমরা হেরে যাই। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল সারা ভারতে মোট ১৬টি ম্যাচ খেলেছিল।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ২৬ নভেম্বর ২০২২
© 2022, https:.