মুক্তিযুদ্ধ

অব্যক্ত বীরত্বগাথা

লাবণী মণ্ডল

লেখক ও গবেষক সালেক খোকন দীর্ঘদিন ধরে মাঠপর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করছেন। মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অসাধারণ অবদান তুলে ধরাটা তাঁর কাজের অন্যতম ও অপরিহার্য অংশ। কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত ‘বীরত্বে একাত্তর’ বইটি মুক্তিযুদ্ধের বিস্মৃত ইতিহাস তুলে আনার প্রয়াস।
গণমানুষের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার বিষয়টি প্রচলিত ইতিহাসে সেভাবে আসে না। সালেক খোকন সেই ইতিহাসটুকু তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে, একেকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবনের গদ্যই মুক্তিযুদ্ধের একেকটি ইতিহাস। যুগাধিক সময় ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা ও দেশ নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের না-বলা কথা তুলে ধরেছেন এ গবেষক।
এর আগে প্রকাশিত হয় মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখকের বেশ কয়েকটি গ্রন্থ। এর মধ্যে রয়েছে- ১৯৭১ : যুদ্ধাহতের বয়ান (২০১৬), ১৯৭১ : যাঁদের রক্তে সিক্ত এই মাটি (২০১৭), ১৯৭১ : রক্তমাখা যুদ্ধকথা (২০১৮), যুদ্ধাহতের ভাষ্য (২০১৮), ১৯৭১ : যাঁদের ত্যাগে এলো স্বাধীনতা (২০১৯), রক্তে রাঙা একাত্তর (২০১৯), যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য (২০২০), ১৯৭১ : রক্ত, মাটি ও বীরের গদ্য (২০২০), অপরাজেয় একাত্তর (২০২০), ৭১-এর আকরগ্রন্থ (২০২১) ও ১৯৭১ : বিজয়ের গৌরবগাথা (২০২১)।
‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মৌলিক গবেষণাগ্রন্থ হিসেবে ‘তরুণ কবি ও লেখক কালি ও কলম পুরস্কার’ লাভ করে।
গবেষণার ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালের ডিসেম্বরে রচিত হয়েছে ‘বীরত্বে একাত্তর’ গ্রন্থটি। এই গ্রন্থে একাত্তরের চারজন বীরপ্রতীক, সাতজন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ছয়জন বীর মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বের ইতিহাস মুক্তিযোদ্ধার নিজ বর্ণনায়, বিভিন্ন দলিল, লেখাসংশ্নিষ্ট আলোকচিত্র সন্নিবেশ করা হয়েছে। প্রায় প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধাই অকাট্য আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি। দেশ নিয়ে তাঁরা তাঁদের স্বপ্নের কথাগুলোও বলেছেন আগামী প্রজন্মের উদ্দেশে।
কীভাবে গেরিলারা ঢাকায় পেট্রোল পাম্প উড়িয়ে দিয়েছেন; রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের প্রতিরোধ যুদ্ধ; একজন সাবসেক্টর কমান্ডারের বীরত্ব ও পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বরে এয়ারফোর্স পাইলটদের অব্যক্ত ইতিহাস; কীভাবে গেরিলার হাতে নিহত হন পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর আবদুল মোনেম খান; কী লেখা ছিল আজিমপুরের মেয়েবিচ্ছুদের লালচিঠিতে; সৈয়দপুরে বিহারিদের হত্যাযজ্ঞ; গ্রামের নাম কেন বদলে হয় আরশাদগঞ্জ- একাত্তরের এমন অজানা ঘটনা তুলে আনা হয়েছে ‘বীরত্বে একাত্তর’ গ্রন্থে। গ্রন্থভুক্ত মুক্তিযোদ্ধারা পৌরাণিক কোনো চরিত্র নয়; বরং অকুতোভয় বীর। তাঁদের রক্ত, ঘাম, ত্যাগে সৃষ্ট বাংলাদেশ আজ বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সূর্যসন্তানদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে উঠে এসেছে বাঙালির আত্মত্যাগের মহিমাময় প্রকৃত ইতিহাস। গল্পের ছলে বলে যাওয়া রোমহর্ষক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্লভ দলিল ও আলোকচিত্র।
‘গুলি করতেই গভর্নর মোনেম খান উপুড় হয়ে যায়’ অধ্যায়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আনোয়ার হোসেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের বাসায় অভিযানের দুর্ধর্ষ বর্ণনা তুলে ধরেন- ‘স্টেনগান নিয়ে নিচতলায় ড্রইং রুমের দরজা ঠেলে ঢুকে যাই। মাত্র ১৫ ফুট সামনে তারা। মাঝের ব্যক্তিকে টার্গেট করেই গুলি করি। সঙ্গে সঙ্গে মোনেম খান সামনের দিকে উপুড় হয়ে পড়ে যায়, একটা চিৎকারও দেয়। এইটুকু এখনও স্মৃতিতে আছে। পেছনে ব্যাক করতেই মোজাম্মেল সঙ্গে সঙ্গে গ্রেনেড চার্জ করে। কিন্তু তার গ্রেনেডটা কোনো কারণে বার্স্ট হয় না। পরে শুনেছি মোনেম খানের সঙ্গে (দুই পাশে) ছিল প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী আমজাদ হোসেন আর মেয়ের জামাই জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল। কিন্তু তারা আমাদের টার্গেটে ছিল না। ফলে শুধু মোনেম খানকেই আমরা হিট করেছি।’
‘মরতেই গিয়েছিলাম একাত্তরে, বেঁচে আছি এটাই অস্বাভাবিক’ অধ্যায়ে উঠে এসেছে সম্মুখসমরে লড়াইয়ের সুসংহত জ্ঞান না থাকলেও সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের এক অসাধারণ নজির। বহু সহযোদ্ধাকে যুদ্ধে হারিয়েছেন। বেশ কয়েকবার মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসা বীরপ্রতীক নূর উদ্দিন আহমেদের স্মৃতিচারণ- ‘ওই অপারেশনে আমিও ছিলাম। শামসুল ছিল গাছের ওপরে, ওপি পোস্টে। দেখে দেখে বলত কোনদিকে পাকিস্তানিরা। নিচে ছিলেন ক্যাপ্টেন। তাঁর নির্দেশে সেই অ্যাঙ্গেলে বোম্বিং করা হতো। পাকিস্তানি আর্মিরা তাঁকে টার্গেট করে ফেলে। থ্রি ইঞ্চ মর্টার মারলে সেটি এসে পড়ে তাঁর ওপরে। মর্টারের আঘাতে তাঁর শরীর দু’টুকরো হয়ে যায়। চোখের সামনে সহযোদ্ধার ক্ষতবিক্ষত দেহ।’
‘১৯৭১ : আজিমপুরের মেয়েবিচ্ছু’ অধ্যায়ে ফেরদৌসী হক লিনুর স্মৃতিচারণ উঠে এসেছে। তখন তিনি দশম শ্রেণির ছাত্রী। তাঁর চার ভাই মুক্তিযোদ্ধা। সেই সময়ের আতঙ্ক, শঙ্কা যেমন তাঁর ভাষ্যে উঠে এসেছে, তেমনি তৎকালীন ঢাকার একটা সমাজচিত্রও আমরা পাই। আজিমপুর কোয়ার্টার এলাকায় কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন নারীরা, মেয়েবিচ্ছু লিনুর বয়ানে উঠে এসেছে- “একবার পরিকল্পনা করি আজিমপুরের রাস্তায় পোস্টারিং করার। কারণ, ওখানকার সড়কে পাকিস্তানি আর্মিদের চলাচল ছিল বেশি। ফৌজিয়া খালার পরামর্শে রংতুলি দিয়ে পাকিস্তানি সেনা আর মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি এঁকে পোস্টারে লেখা হয়- ‘পাকিস্তানি আর্মি স্যারেন্ডার করো।’ লিটু ও সানু ভাই মিলে পাইওনিয়ার প্রেস থেকে গোপনে পোস্টার ছাপিয়ে আনে। ওই পোস্টার গোপনে দেয়ালে লাগাতে হবে। কীভাবে সেটা করব …?” মুক্তিযুদ্ধের বিস্মৃত ইতিহাস তুলে আনার প্রয়াসে সালেক খোকন গবেষণা করে চলেছেন। নিভৃতচারী এ লেখক নিরলস প্রচেষ্টায় মুক্তিযুদ্ধের অনালোচিত মানুষের কথা শোনাতে ব্রতী হয়েছেন, যাঁরা ছিলেন অন্তরালে। এই কথ্য ইতিহাসে যে টুকরো টুকরো মুক্তিযুদ্ধ উঠে আসে, তা-ই গণমানুষের ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধ যে প্রকৃত অর্থে একটা গণযুদ্ধ ছিল, সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আত্মনিয়োগ করেছে। তা এসব টুকরো ইতিহাসে উঠে আসে। তা-ই এ ইতিহাস আমাদের জাতীয় জীবনের এক অমূল্য প্রাপ্তি। আর সে বীরত্বগাথা তুলে ধরতে গবেষক সালেক খোকনের আরেকটি মূল্যবান সংকলন ‘বীরত্বে একাত্তর’।

 লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক সমকালের কালেরখেয়ায়, প্রকাশকাল: ৩০ ডিসেম্বর ২০২২

© 2023, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button