‘প্রতিটি স্কুলে বইমেলা হওয়া উচিত’
‘কিডজ’ এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শিশুকিশোরদের নিয়ে নিজের ভাবনা ও পরিকল্পনা জানাচ্ছেন লেখক ও গবেষক সালেক খোকন।
লেখক ও গবেষক সালেক খোকন লেখালেখি করছেন এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী, ভ্রমণ ও শিশু-কিশোর সাহিত্যসহ তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২৯। পেয়েছেন কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার। এবারের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে সালেক খোকনের চারটি বই। ‘কিডজ’ এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শিশুকিশোরদের নিয়ে তিনি তার ভাবনা ও পরিকল্পনা জানাচ্ছেন।
এবারের বইমেলায় আপনার কী বই প্রকাশিত হয়েছে? বিষয়বস্তু কী?
চারটি বই প্রকাশিত হয়েছে- দুটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ও দুটি আদিবাসীবিষয়ক। ‘বীরত্বে একাত্তর’ ও ‘আদিবাসী উৎসবকথা’ বই দুটি প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ (বইমেলায় প্যাভিলিয়ন), কিশোরদের জন্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বই ‘একাত্তরের গল্পগাথা’ প্রকাশ করেছে বেঙ্গল পাবলিকেশনস (স্টল নম্বর ১৩৯-১৪১) আর ‘চন্দ্র কেন কম আলো দেয় সূর্য কেন বেশি’ শিশুদের জন্য আদিবাসী গল্পের এ বইটি চমৎকার অলংকরণসহ প্রকাশ করেছে শৈশবপ্রকাশ (শিশুচত্বরে স্টল নম্বর ৬৩৫)।
সরকারি হিসাবে দেশে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতি ৫০টি, কিন্তু এখন পর্যন্ত পাঁচটি ভাষায় প্রাক-প্রাথমিক স্তরের বই ও শিক্ষাউপকরণ তৈরি করা হয়েছে। আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা বিস্তারে করণীয় কী?
শুধু মাতৃভাষায় দায়সারা পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করলেই চলবে না। সেটি ক্লাসরুমে পঠন ও শিক্ষা প্রদান নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। শিশুদের জন্য মাতৃভাষায় পুস্তক প্রণয়নের সঙ্গে সমন্বয় রেখে শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও সংশ্লিষ্ট ভাষার শিক্ষক নিয়োগে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি বাকি ভাষার পুস্তক প্রণয়নেও গতি আনতে হবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাষা-ভাষী জাতির মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে।
এবছর বিভিন্ন শ্রেণিতে নতুন পাঠ্যবই প্রকাশ করেছে সরকার। নতুন বইয়ে নানা ভুল নিয়ে বিতর্ক চলছে। এ থেকে শিক্ষার্থীদের বাঁচানোর উপায় কী?
সমস্যা হচ্ছে সমালোচনার পাশাপাশি কিছু মিথ্যাচারও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এসব খবর যখন শিক্ষার্থীরা জানছে তা তাদের মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করছে। এ থেকে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে উদ্যোগী হতে হবে অভিভাবক ও শিক্ষকদের। পাশাপাশি সরকারের উচিত পাঠ্যবইয়ে নির্ভুলতা আনতে আরও আন্তরিক হওয়া।
আপনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করছেন, ভোটের রাজনীতি থেকে এ ইতিহাসকে বাঁচিয়ে নতুন প্রজন্মের মর্মে কীভাবে পৌঁছানো যায়?
দেখুন, এখনকার প্রজন্ম খুবই মেধাবী। তারা ভালো ও মন্দের প্রভেদটা বেশ ধরতে পারে। একাত্তরের ত্যাগের ও বীরত্বের ইতিহাস জানতে তাদের আগ্রহ অনেক। একাত্তর আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িক ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের শিক্ষা দেয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নও ছিল তাই। কোন কিছুই তো রাজনীতির ঊর্ধ্বে নয়। তবে অপরাজনীতি বা ইতিহাসবিকৃতি প্রজন্ম মেনে নেয় না। একাত্তরের প্রকৃত ইতিহাস প্রজন্ম ঠিকই খুঁজে নেবে।
প্রতিবছর বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সারমর্মে আমরা ‘অমর একুশে বইমেলা’ করি। কেবল বই ছাপিয়ে কি ভাষা রক্ষা করা সম্ভব?
ভাষা রক্ষার বিষয়টি তো বৃহৎ। সম্মিলিত উদ্যোগে সেটি সম্ভব। ঘর থেকেই সে উদ্যোগ নিতে হয়। এখনকার সময়ে ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষার প্রয়োজন আছে। তবে সেটি মাতৃভাষা বাংলাকে ভুলে গিয়ে নয়। আমি বাংলা ভাষা রক্ষা নিয়ে বড় বড় কথা বলব, কিন্তু নিজের শিশুটিকে ভর্তি করাবো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। তাহলে তো হবে না। এ শহরে আমি পরিচিত অনেককে গর্বের সঙ্গে বলতে শুনেছি যে তার শিশুটি ভালোভাবে বাংলা বলতে ও লিখতে পারে না। তাহলে সে পরিবারে মায়ের ভাষা বাংলা রক্ষা পাবে কী করে! তবে বইমেলাকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখি। বাংলা ভাষায় বই নিয়ে একমাস একটা উৎসব তো হচ্ছে। ভাষা ও বাংলা বর্ণমালা নিয়ে এ উৎসব অবশ্যই গৌরবের।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বিদেশ থেকে আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র এনে ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ নামে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শিশুকিশোরদের জন্য রঙিন বই প্রকাশ করবেন বলে। সুকুমার রায়ও এখান থেকে নিজের বই প্রকাশ করেছেন। বর্তমান সময়ে শিশুদের জন্য এমন আত্মোৎসর্গের অভাব কি দেখতে পাই আমরা?
ওরকম তো নেই। এখন শিশুদের নিয়ে গভীরভাবে ভাববার সময় কই আমাদের! পরিবারে আমরা আমাদের শিশুটিকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। তার জন্য খুব ভালো বা দামি খাবার এনে দিই। কিন্তু তার মানসিক বিকাশে ও সৃজনশীলতায় কোন বইটি পড়া প্রয়োজন অভিভাবক হিসেবে তা তুলে দেওয়াও আমাদের দায়িত্ব। আবার শিশুদের জন্য মানসম্পন্ন ও মননশীল বই কোনগুলো, সেটি নিয়ে খুব বেশি গবেষণা হয়নি। অথচ এটি গুরুত্বের সঙ্গে রাষ্ট্রীয়ভাবে করা উচিত। কারণ আজকের শিশুই আগামীর হাল ধরবে। ফলে এখন রঙচঙ্গা প্রচ্ছদের আড়ালে বইমেলায় যে বই মেলে তা শিশুদের জন্য কতটা উপযোগী, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে ব্যতিক্রমও আছে। শৈশবপ্রকাশ, ইকরিমিকরি, ময়ূরপঙ্খির মতো বেশকিছু প্রকাশনী শিশুদের জন্য মানসম্পন্ন বই প্রকাশের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে অন্যান্য প্রকাশকদের উদ্যোগ প্রয়োজন। পাশাপাশি প্রতিটি স্কুলে বইমেলা হওয়া উচিত, যাতে শিশুরা নিজের পছন্দমতো বই কিনে পড়তে পারে।
এখন তো ই-বুক চলে এসেছে, মানুষ অনলাইন নির্ভর। শিশুকিশোররা গেজেট ব্যবহার করতে শিখছে। ব্যাপারটা কীভাবে দেখেন?
সময় অনেক কিছুই পাল্টে দেবে। এটা মেনে নেওয়াই উচিত। ছাপা বইয়ের আবেদন আমাদের দেশে থাকবে অনেকদিন। তবে প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষার গল্প, উপন্যাস, গবেষণা ও কবিতা তুলে ধরতে ই-বুক করা ও অনলাইনে বইমেলার আয়োজনকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখছি। এতে সারা পৃথিবীতে বসবাসকারী বাংলা ভাষাভাষীরাও যুক্ত হতে পারবে। পাশাপাশি বাংলা ভাষা রক্ষার ক্ষেত্রেও কার্যকরী প্রভাব থাকবে বলে মনে করি।
আইনস্টাইন তথ্যের চেয়ে কল্পনাকে মূল্যবান মনে করতেন। বই খুললেই যা পাওয়া যায় তা মুখস্থ করে সীমিত স্মৃতি অপচয় না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রচলিত পরীক্ষানির্ভর প্রতিযোগিতার মধ্যে শিক্ষার্থীদের কল্পনা কীভাবে বিস্তৃত হবে?
সরকার জিপিএ-৫ পদ্ধতি থেকে সরে এসেছে। আমি বলবো রাষ্ট্রীয়ভাবে শিশুদের প্রতি গুরুত্ব বাড়লে ইতিবাচক উদ্যোগও বাড়বে। তবে পরিবার ও সামাজিক উদ্যোগ প্রয়োজন। শিশুটি কী চায়, কীভাবে চায়, কীসে তার আগ্রহ সেদিকে খেয়াল রাখা অভিভাবকের দায়িত্ব। অধিকাংশ সময় আমরা দেখি অভিভাবক তার জীবনে যা হতে পারেননি সন্তানকে নিয়ে তিনি সেই স্বপ্নটাই দেখেন। ফলে অভিভাবকের স্বপ্ন শিশুর ওপর আরোপিত হয়। আমি বলবো, শিশুরা বড় হোক তার আপন স্বপ্ন নিয়ে। অভিভাবক সেই স্বপ্নের পথে তার পাশে থাকুক। তাহলেই দেখবেন কত কত মেধাবী প্রজন্ম আমরা পাবো।
আপনার শৈশবের কোন আনন্দের বা দুঃখের স্মৃতি?
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি তখন। ভূগোল ক্লাস করতে ভালো লাগত না। কারণ যে শিক্ষক ছিলেন তিনি শুধু বই দেখে দেখে পড়াতেন। আমরা সেটা বুঝতে পারছি কিনা সেদিকে খেয়াল রাখতেন না। তখন গল্পের বই পড়তাম। লাইব্রেরি থেকে বই ধার পাওয়া যেত। আমরা কয়েকজন তিন গোয়েন্দা সিরিজের বই এনে সবাই পড়ে ফেলতাম। একদিন ওই ক্লাসে বসে মূল বইয়ের ভেতর রেখে গোয়েন্দা সিরিজ পড়ছি মনের আনন্দে। ভাবলাম শিক্ষক খেয়াল করবেন না। বইয়ের ভেতর ডুবে রইলাম। হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ালেন ভূগোল শিক্ষক। চোখ বড় বড় করে মূল বইয়ের ভেতর থেকে বের করে নিলেন সেই গোয়ন্দা সিরিজের বইটি। ক্লাস ক্যাপ্টেনকে পাঠালেন বেত আনতে। তারপর বই পড়ার অপরাধে গোটা ক্লাসের সামনে দুই হাত লাল করে দিলেন। এখানেই শেষ নয়। ধার করা বইটিও আর ফেরত পাইনি। ফলে ওই বইয়ের জরিমানা হিসেবে টিফিনের টাকা জমিয়ে কিনে দিতে হয়েছিল।
শিশু-কিশোরদের জন্য আর কী লেখার বা করার পরিকল্পনা আছে আপনার?
যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ ও আদিবাসী বিষয় নিয়ে কাজ করি, তাই এ দুটি বিষয় নিয়েই শিশু ও কিশোরদের উপযোগী লেখালেখি করার প্রবল আগ্রহ আমার। মুক্তিযুদ্ধের সত্য ঘটনা নিয়ে সামনে হয়তো শিশু-কিশোরদের জন্য আরও ভালো কিছু বই আসবে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজ বিভাগে, প্রকাশকাল: ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
© 2023, https:.