তৃণমূলে মুক্তিযুদ্ধ
২০১০ সালের একটি ঘটনা আমাকে ‘৭১-এর আকরগ্রন্থ’ বা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কাজের প্রতি বিশেষভাবে নিবিষ্ট করে। দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলায় বিজয় দিবসের এক অনুষ্ঠানে দেখা হয় যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা কৃষ্ণ কিশোর দাসের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের মাইনের আঘাতে উড়ে যায় তাঁর বাঁ পা। স্বাধীন দেশে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাঠমিস্ত্রির কাজ করে পরিবার চালান তিনি। আক্ষেপ নিয়ে তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘প্রতিবছর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দিতে আসেন মন্ত্রী-এমপিরা। তাঁদের বলা সমস্ত কথাই পরদিন পত্রিকায় ছাপা হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের না-বলা কথাগুলো অপ্রকাশিতই থেকে যায়। ফলে ইতিহাসের কথাগুলো ঘুরপাক খায় মুক্তিযোদ্ধাদের মনের অতলে।’ তাঁর কথাগুলো প্রবলভাবে স্পর্শ করে আমায়। মূলত তখন থেকেই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাষ্যে ইতিহাস সংগ্রহের কাজটির শুরু।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে রেকর্ড করি মুক্তিযুদ্ধ ও দেশ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের না-বলা কথাগুলো। আমার কাছে একেকজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনের গদ্যই গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের একেকটি ইতিহাস। ‘৭১-এর আকরগ্রন্থ’ মুক্তিযুদ্ধকালীন ১১টি সেক্টরের ১১১ জন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধার রক্তাক্ত স্মৃতি, যুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল, সেই সাথে ৪৬৫টি আলোকচিত্রের এক বিশাল পরিসরের গ্রন্থিত রূপ। তৃণমূলে এগারো বছর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণার এক পরম ফসল এই বই। যেখানে যুদ্ধাহত বীরদের যুদ্ধস্মৃতি, জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম, শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের প্রত্যয় ও অন্যান্য ভাবনাপুঞ্জ সুচারুভাবে বর্ণিত হয়েছে। অভিনব এই বইটিতে যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি তাঁদের ভালোবাসা, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতিরোধ, তাঁদের যন্ত্রণা, বীরত্ব, পরবর্তী প্রবংশের প্রতি তাঁদের আশাবাদ- এসব অনুষঙ্গ। সেসব বর্ণনা যেমন জীবন্ত, তেমনি প্রেরণাদায়ী। যা যে কোনো বয়সী পাঠকের মনে উন্মেষ ঘটাবে দেশ ও মানুষের প্রতি প্রদীপ্ত অঙ্গীকার। তাই ‘৭১-এর আকরগ্রন্থ’ বইটি মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য দলিল।
‘৭১-এর আকরগ্রন্থ’ বইটিতে প্রায় প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধাই অকাট্য আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি। দেশ নিয়ে তাঁরা তাঁদের স্বপ্নের কথাগুলোও বলেছেন আগামী প্রজন্মের উদ্দেশেই। মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস জানার সীমাবদ্ধতা কাটাতে এই বই বিশেষ সহায়ক ভূমিকা রাখবে। বইটির রচনাগুলো শিকড়সন্ধানী ও সুখপাঠ্য কিন্তু বেদনাবহ; যা যে কোনো পাঠককে সচেতনভাবেই নিয়ে যাবে একাত্তরের গহিনে। তাই এই বইটি সেইসব বাঙালির সংগ্রহে রাখার মতো, যারা দেশকে নিয়ে ভাবেন, দেশকে ভালোবাসেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
‘স্বাধীনতার জন্য তারেও হারালাম!’ শিরোনামে যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. বাকি মোল্লার কথা তুলে ধরা হয়েছে এই গ্রন্থে। সাত নম্বর সেক্টরের এই যোদ্ধা রাজশাহীর বাসুদেবপুর অপারেশনে গুলিবিদ্ধ হন, পরে তাঁর ডান পা হাঁটুর ওপর এক বিঘত থেকে কেটে ফেলা হয়। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সময় তিনি তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে রেখে যান। পা হারালেও স্বাধীনতা লাভের পর বাকি মোল্লা জীবনের স্বপ্নে বুক বাঁধেন- বাড়ি ফিরে দেখবেন ফুটফুটে সন্তান ও স্ত্রীকে। আবারও সুখের সংসার করবেন তাঁরা। কিন্তু সেটি আর হয় না। ফিরে এসে শোনেন, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীও মারা গেছেন। ফলে আরেকবার রক্তাক্ত হন তিনি। বাকি মোল্লার শরীরের ভারে এখন তাঁর বাঁ পা-ও বেঁকে গেছে। ফলে শরীরের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধটি এখনও চলছে। বঙ্গবন্ধুর কন্যার সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধিসহ নানা ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু এখনও কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে কটাক্ষ করেন। তখন কষ্ট পান এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। ক্ষোভের সঙ্গে বাকি মোল্লা আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আজ যদি এক কোটি টাকা দিয়ে আপনার একটা পা কেটে ফেলতে চাই, আপনি কি দেবেন?’ তাঁর প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারিনি। তাই তৃণমূলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, জনযুদ্ধের ইতিহাস ও আত্মত্যাগের ইতিহাস তুলে আনার কাজটি আরও দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে নেব- এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্তিতে আমি ভীষণভাবে আনন্দিত। এই পুরস্কার ও সম্মান মুক্তিযুদ্ধ গবেষণায় আমাকে আরও উৎসাহী, সাহসী ও দায়িত্বশীল করবে। ‘ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার’ এমন মহতী উদ্যোগ অব্যাহত থাকুক। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এই বইটি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে প্রকাশনী সংস্থা কথাপ্রকাশ। মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণামূলক কাজের প্রতি কথাপ্রকাশের কর্ণধার জসিম উদ্দিনের আগ্রহ, দায়িত্বশীলতা ও একাগ্রতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। ধন্যবাদ রইল কথাপ্রকাশের পুরো টিম ও এর কর্ণধার জসিম উদ্দিনের প্রতিও। (ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ২০২১-এর বক্তব্য থেকে)
`ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ২০২১’ উপলক্ষে পুরস্কার প্রাপ্তদের নিয়ে ‘সৃষ্টিশীলতার উদযাপন’ শিরোনামে সমকাল-এর শুক্রবারের সাহিত্য সাময়িকী (১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩) কালের খেয়ার বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত
© 2023, https:.