আদি বিশ্বাসে ফুল, বৃক্ষ ও বিহঙ্গ
আদিবাসী সমাজে ফুল, বৃক্ষ ও পাখি বা বিহঙ্গ কথা এবং এ নিয়ে তাদের বিশ্বাসের অন্তর্নিহিত প্রভাব কেমন– তা তুলে ধরতেই এই লেখার অবতারণা। যে কোনো আদিবাসী জাতির কাছেই ফুল অতি পবিত্র। ফলে তাদের দৈনন্দিন উপাসনা ছাড়াও উৎসবের নানা আচারে ফুলের ব্যবহার লক্ষণীয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতি মারমা। তারা উদযাপন করে নববর্ষবরণ অনুষ্ঠান বা ‘সাংগ্রাইং’। এটি মারমাদের অন্যতম সামাজিক উৎসব।
কেন এই উৎসব?
মূলত সংক্রান্তি শব্দ থেকেই এসেছে ‘সাংগ্রাইং’ শব্দটি। মারমারা বিশ্বাস করে, এ পৃথিবীতে সাংগ্রাং নামে এক ধর্মীয় দেবী মানুষের সৌভাগ্য আর কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসেন। তাই স্বর্গ থেকে মর্ত্যে দেবী নেমে আসার অর্থাৎ পৃথিবীতে পা রাখার ক্ষণটি থেকেই শুরু হয় সাংগ্রাইং বা নববর্ষ পালনের উৎসব। পৃথিবীতে যে ক’দিন দেবী অবস্থান করবেন, সে ক’দিন ধরেই চলে সাংগ্রাইং উৎসব। সাধারণত তিন দিন এ উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয়। সাংগ্রাং দেবীর ফুল পছন্দ। তাই এ উৎসবে ফুলের ব্যবহার অত্যাবশ্যকীয়। প্রথম দিনটিকে তারা বলে ‘পাইং ছোয়াইক’, যার শাব্দিক অর্থ ‘ফুল তোলা’। এ দিন মারমা যুবতীরা গোলাপ, জবা, গন্ধরাজ, বেলিসহ নানা ধরনের পাহাড়ি সুগন্ধি ফুল সংগ্রহ করে। রাতে সেসব ফুল সাজিয়ে দলবেঁধে ভোরবেলা সবাই বৌদ্ধবিহারে গমন করে। আগেই বুদ্ধমূর্তির বেদির স্থানটুকু ফুল ও মাল্যে ভরিয়ে দেয়। অতঃপর তারা সেখানে মনের নানা ইচ্ছার কথা জানিয়ে প্রার্থনা নিবেদন করে।
আবার ফুলকে বরণ করতেই সমতলে সাঁওতাল আদিবাসীরা বাহাপরব বা বাহা উৎসব পালন করে থাকে। সাধারণত ফাগুন মাসের শেষে বা চৈত্রের শুরুতে আয়োজন করা হয় অনুষ্ঠানটি। সাঁওতালি ভাষায় ‘বাহা’ মানে ‘ফুল বা কুমারী কন্যা’ আর ‘পরব’ মানে ‘অনুষ্ঠান’ বা ‘উৎসব’। অনেকেই এটিকে বসন্ত উৎসব বা পুষ্প উৎসবও বলে থাকে। বসন্তে শাল, শিমুল, পলাশ, মহুয়া, চম্পা ফুল ফোটে চারদিকে। বিচিত্র সাজে সজ্জিত হয় প্রকৃতি। কিন্তু বাহাপরবের আগে সাঁওতাল নারীরা সে ফুল উপভোগ করে না।
বাহাপরব উৎসবটি তিন দিনের। তবে প্রথম দিনের অনুষ্ঠানই প্রধান। পরবের এক দিন আগে জাহের থান ও মাঝি থান নানাভাবে সাজানো হয়। নতুন সবুজ পত্রপল্লবে সেজে ওঠা ধরণি হলো পবিত্র কুমারী কন্যার প্রতীক। পরব শুরুর পূজায় দেবতাকে শাল ও মহুয়া ফুল উৎসর্গ করা হয়। অনুষ্ঠানে সাঁওতালরা শাল ফুলকে বরণ করে নেয় নানা আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে।
গ্রামের এক প্রান্তে নির্দিষ্ট জায়গায়তেই এ পূজার আয়োজন চলে। এ উপলক্ষে নির্দিষ্ট দিনে জাহের থানে শাল গাছের খুঁটি দিয়ে অন্যান্য দেব–দেবীর জন্য প্রতীক হিসেবে ছোট ছোট কয়েকটি চালাঘর তৈরি করা হয়। সাধারণত গ্রামের যুবকরাই জঙ্গল থেকে শাল গাছ কেটে আনে এবং চালাঘর তৈরিতে সাহায্য করে। পূজার জায়গাটি ভালোভাবে নিকানো হয় গোবর দিয়ে। চালের গুঁড়ো দিয়ে আঁকা হয় আলপনা।
পূজা উপলক্ষে মহত বা পুরোহিতকে উপোস থাকতে হয়। পূজার জন্য দেবতার আসন প্রস্তুত করেন তিনি। একটু উঁচু জায়গায় তিনটি ধনুক গেড়ে দিয়ে সিঁদুর মাখিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর চলে পূজার আনুষ্ঠানিকতা। বিকেলের দিকে মহত বা পুরোহিতকে সঙ্গে নিয়ে সবাই দলবেঁধে গ্রামে ফিরে আসে। তাঁর মাথায় থাকে শাল ফুলের ডালা। তাঁর সঙ্গে এক যুবক মাটির কলসিতে এক কলসি জল ভরে মাথায় নিয়ে বাড়ি বাড়ি চলতে থাকে। একেকটি বাড়ির ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় গৃহস্থ নারীরা ওই পুরোহিত ও যুবকটির পা ধুইয়ে দেয়। তাঁরাও প্রত্যেক গৃহস্থকে ঝুড়ি থেকে পবিত্র শাল ফুল প্রদান করেন। অতঃপর শুরু হয় আনন্দ নৃত্য। পুরুষেরা বাজায় মাদল–ঢোল। তালে তালে ঝুমুর নৃত্যে ব্যস্ত হয় আদিবাসী নারীরা। খোঁপায় শালসহ নানা রঙের ফুল ঝুলিয়ে, হাত ধরাধরি করে নাচে সাঁওতালরা।
ফুলের আধিক্য পাওয়া যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা আদিবাসীদের বিজু উৎসবেও। উৎসবে মূল বিজুর আগের দিনটিকে তারা বলে ফুল বিজু। ওই দিন বাড়ির ছেলেমেয়ে, অনেক সময় বয়োবৃদ্ধ পুরুষ ও নারীরাও খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে দলে দলে নানা দিকে ফুল সংগ্রহে বেরিয়ে পড়ে। তারা বিভিন্ন ধরনের ফুল তুলে নিজ নিজ বাড়িতে এনে ঘরদুয়ার সাজিয়ে নেয়। এ ছাড়া ফুল দিয়ে বুদ্ধপূজা, গৃহদেবতার পূজাও করে থাকে। এ সময় ঘরবাড়ি ও আঙিনা পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন করে ফুলে ফুলে বাড়িঘর সাজানোর পর পোষা গরু, মহিষ ইত্যাদির গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেওয়া হয়। মূল বিজুর দিন প্রতি বাড়ির নারী–পুরুষ, ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেই নদীতে বা জলাশয়ে স্নান সেরে নেয়। অতঃপর দলে দলে নদী, পাহাড়ি ছড়া বা জলাশয়ে ফুল ভাসিয়ে দিয়ে পুরোনো বছরের গ্লানি ভুলে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়।
একইভাবে ত্রিপুরাদের কাছেও ফুল ভক্তির প্রতীক। ফুলের ব্যবহার দেখা যায় তাদের ‘হারিবৈসুর’ দিনটিতেও। ওই দিন চন্দন পানি দিয়ে গবাদিপশুকে স্নান করানো ও তাদের উন্নত মানের খাদ্য ও পানীয় খাওয়ানো হয়। অতঃপর ফুলের মালা পরিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা ও ক্ষমা প্রার্থনা করে তারা। এদিন বাড়িঘর নিম ও আমপাতা, দূর্বা ঘাস ও ফুল দিয়ে সাজানো হয়। কারণ তাদের বিশ্বাস নিম, আম, ডুমুর, বট ও অশ্বত্থ গাছের পাতা শান্তির প্রতীক, দূর্বা ঘাস অমরত্বের প্রতীক, ফুল ভক্তির প্রতীক আর পান–সুপারি কল্যাণের প্রতীক।
আদি থেকেই আদিবাসীরা ছিল প্রকৃতি পূজারি। ফলে তাদের সমাজে বড় বড় বৃক্ষকে বিশেষ ভক্তির চোখে দেখা হতো। সমতলের কয়েকটি আদিবাসী জাতি বিরল প্রজাতির ‘খিল কদম’ বৃক্ষটিকে অতি পবিত্র বলে মনে করে। প্রতি ভাদ্রের চাঁদের পূর্ণিমায় নিজেদের অভাবমুক্তি ও সৌভাগ্য লাভের আশায় তারা ওই বৃক্ষের ডাল কেটে এনে বিশেষ আচারের সঙ্গে পূজা করে। কড়া আদিবাসীরা এটিকে কারমা উৎসব বললেও সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা, পাহান, মাহালী, লোহার প্রভৃতি আদিবাসীর কাছে এটি কারাম উৎসব।
দিনাজপুরের ঝিনাইকুড়ি গ্রামে কড়াদের কারমা উৎসব দেখেছি খুব কাছ থেকে, তাঁদের সঙ্গে মিশে গিয়ে। এ উৎসবে মাহাতো বা গ্রামপ্রধান আগে থেকেই অবিবাহিত কোনো যুবককে খিল কদম গাছের ডাল কেটে আনা ও তা বির্সজনের জন্য মনোনীত করে দেন। এ গাছের ডাল কেটে আনার রয়েছে বিশেষ নিয়ম। সাধারণত বিকেলের দিকে ডাল কাটতে বের হয় তারা। ওই গাছের সঙ্গে প্রথমে বেঁধে দেওয়া হয় দুটি তেলের পিঠা। এরপর ভক্তির সঙ্গে বলতে হয়– ‘কারাম গোঁসাই প্রতি বছরের মতো আজও আমরা তোমাকে নিতে এসেছি, তোমার পূজা দেব বলে।’ অতঃপর ‘বিসক্রম’ বলে এক বা তিন কোপে কেটে নেওয়া হয় গাছের বড় একটি ডাল।
সন্ধ্যায় ওই ডালসহ গ্রামের কাছাকাছি আসতেই ঢোল বাজিয়ে বিশেষ ভক্তি দিয়ে দেবতারূপী ডালটিকে কড়ারা নিয়ে আসে পূজাস্থলে। সেখানে আগে থেকেই বাঁশ দিয়ে মাড়োয়া তৈরি করে রাখা হয়। শাপলা ফুল দিয়ে সাজানো হয় মাড়োয়াটি।
সন্ধ্যার পর শুরু হয় পূজার আনুষ্ঠানিকতা। শুরুতেই গ্রামপ্রধান ডালটির সামনে পূজা দেন। ডালটিকে পূর্বদিকে রেখে পূজারিকে বসতে হয় পশ্চিমে। মাটি লেপা একটি স্থানে কলাপাতা বিছিয়ে পাশে রাখা হয় একটি কাঁসার থালা। থালায় থাকে প্রদীপ, কাঁচা ছোলা, জুঁই ফুল, শসা ও সিঁদুর। এ সময় দুটি লাল মুরগা (মোরগ) বলি দিয়ে কারমা উৎসবের শুভ সূচনা করা হয়। এর পরেই শুরু হয় পৌরাণিক কাহিনি বলার আসর। অতঃপর কড়া আদিবাসী নারীরা মনের নানা ইচ্ছা নিয়ে বানানো তেলের পিঠা বেঁধে দেয় ডালটির সঙ্গে।
কড়া আদিবাসীরা মনে করে কর্মদেবতারূপী কারাম গোঁসাই আছেন গহিন বনে, গাছ বা বৃক্ষরূপে। কড়াসহ এ অঞ্চলের আদিবাসীরা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপন করছে। কিন্তু তবুও প্রতি ভাদ্রে তারা ধুমধামের সঙ্গে পালন করে কারমা উৎসবটি। তাদের বিশ্বাস, দেবতা কারাম গোঁসাই একদিন ঠিক ঠিক তাদের ঘরে আসবে। দুঃখে ভরা জীবনে তখন লাগবে আনন্দের সুবাতাস। সে বিশ্বাসেই এ সময় কড়ারা আদিবাসী ভাষায় গান গায়: ‘সব গাতনি পিন্দ লাল/ নতুন নতুন সুপ দিয়া/ নতুন পারবেতী/ আজো কারমাকে রাতি…।’
ফুল, বৃক্ষ ছাড়াও পাখি বা বিহঙ্গ বিষয়ে নানা ধরনের পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে আদিবাসী সমাজে। সাঁওতালরা মনে করে, তাদের আদি পিতামাতা হাঁসের মতো বিশেষ ধরনের পাখির ডিম থেকে সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে প্রচলিত কাহিনিটি এমন: আদিতে চারদিকে ছিল শুধু পানি আর পানি। ঠাকুর জিয়ো পৃথিবী সৃষ্টির ইচ্ছা নিয়ে পানির মধ্যে কাঁকড়া, কুমির, বোয়াল, কাছিম, কেঁচোর মতো জীবের আবির্ভাব ঘটালেন। অতঃপর তিনি মাটি থেকে এক জোড়া মানব–মানবী সৃষ্টি করলেন। কিন্তু যখনই তিনি তাদের ভেতর জীবন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তখনই আকাশ থেকে আজব এক ঘোড়া এসে মানব–মানবীর মূর্তিগুলোকে খেয়ে ফেলে। ঠাকুর জিয়ো এতে কষ্ট পেয়ে নিজের বুকের অংশ থেকে সৃষ্টি করলেন এক জোড়া হাঁসের মতো বিশেষ পাখি। তাদের ভেতর তিনি আত্মা দিলেন। তারা মনের আনন্দে ভেসে বেড়াতে থাকল। একদিন হঠাৎ ওই আজব ঘোড়াটি এসে তাঁদের গ্রাস করার চেষ্টা করল। এবার ঠাকুর জিয়ো সতর্ক ছিলেন। তিনি ঘোড়াটিকে সমুদ্রের ফেনায় পরিণত করলেন। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? তাদের আশ্রয়ের জন্য মাটি চাই, বাঁচার জন্য চাই খাদ্য। এ রকম প্রার্থনায় ঠাকুর জিয়ো কাছিমকে নির্দেশ করলেন পানির নিচ থেকে মাটি তুলে আনতে। কাছিম ব্যর্থ হলো। চিংড়িকে বললে সেও চেষ্টা করে সফল হলো না। এভাবে বোয়াল, কাঁকড়া একে একে সবাই ব্যর্থ হলো। রাগান্বিত হয়ে ঠাকুর জিয়ো অবশেষে হুকুম করলেন কেঁচোকে। কেঁচো পানির অতল থেকে মাটি তুলে আনল। এবারে মহাপ্রভু ঠাকুর জিয়ো আনন্দের সঙ্গে পৃথিবী সৃষ্টি করলেন। পৃথিবীতে স্থাপন করলেন পাহাড়, অরণ্য সবকিছু। সেখানে হাঁসের মতো বিশেষ পাখি দুটি বাসা বাঁধে এবং প্রকৃতির নিয়মেই ডিম পাড়ে। সেই ডিম ফুটলে ভেতরে দেখা মিলল দুটি মানবসন্তানের। একটি ছেলে, অন্যটি মেয়ে। ছেলেটির নাম পিলচু হড়ম ও মেয়েটির নাম পিলচু বুড়ি। এরাই সাঁওতালদের আদি পিতামাতা।
এ ছাড়া তীর–ধনুক দিয়ে পাখির সঙ্গে লড়াইয়ের নানা গল্প, সওদাগরের উপকারী টিয়া পাখির গল্প প্রভৃতি রচনা যুগে যুগে আদিবাসী শিশুদের সাহস জুগিয়ে আসছে। যা সমৃদ্ধ করেছে আদিবাসী সাহিত্যকেও।
পাহাড়, বন ও প্রকৃতিই আদিবাসীদের জীবন। কিন্তু এ দেশে দখল হচ্ছে পাহাড়, উজাড় হচ্ছে বন, ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি। ফলে দেশ, সমাজ ও গোত্র ছাড়া হচ্ছে প্রাকৃতজনরা। ফলে আদি রূপ হারাচ্ছে তাদের উৎসব ও সংস্কৃতি। কিন্তু ফুল, বৃক্ষ ও বিহঙ্গ নিয়ে তাদের বিশ্বাসের মিথগুলো আজও আদিবাসীদের মুখে মুখে প্রচলিত। যা বেঁচে থাকবে যুগে যুগে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সমকালের কালের খেয়ায়, প্রকাশকাল: ১২ মে ২০২৩
© 2023, https:.