মুক্তিযুদ্ধ

একাত্তরকে জাগ্রত রাখছে সিরাজগঞ্জের যে কমিটি

একাত্তরকে জাগ্রত রাখার কাজ করছে সিরাজগঞ্জ গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি। ফলে সেখানে প্রজন্ম অনুভব করতে শিখছে মুক্তিযুদ্ধকে। মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলামসহ কমিটির সদস্যদের স্বপ্ন, একদিন প্রত্যেকটি গ্রাম হবে মুক্তিযুদ্ধের গ্রাম

সিরাজগঞ্জ শহরের পাশেই শিয়ালকোল এলাকা। সেখানে শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সামনে দিয়ে চলে গেছে বড় একটি রাস্তা। রাস্তার পাশে একটি ডোবা। অন্যসব ডোবার মতোই কচুরিপানা আর বড় বড় ঘাসে পূর্ণ। ১৯৭১ সালে এখানেই নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল সাতজন নিরীহ-নিরাপরাধ মানুষকে।

শুধু হিন্দু হওয়ার অপরাধেই হত্যা করা হয়েছিল তাদেরকে। লুঙ্গি খুলে ধর্মপরিচয় নিশ্চিত হয়ে সবাইকে নির্মমভাবে গুলি করে পাকিস্তানি সেনারা। নিহতদের কেউ কেউ দুধ ও কলা দিয়ে তৃপ্তি নিয়ে ভাত খেয়েছিলেন খানিক আগেই। গুলির তোড়ে পেট ফেটে সেগুলোও বেরিয়ে আসে। ওইসব ক্ষত-বিক্ষত লাশের বর্ণনা দিয়েছেন কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী।

১৮ মে ১৯৭১। দুপুরের ঘটনা। কামারখন্দের পাইকশা মাদ্রাসা থেকে পাকিস্তান আর্মিদের একটি গ্রুপ শিয়ালকোল হয়ে সিরাজগঞ্জ শহরের দিকে যাচ্ছিল। ওরা শিয়ালকোল বাজারে এসে মোস্তফা খন্দকার নামে এক সাইকেল মিস্ত্রিকে পায়। তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘মালাউন কাহা হ্যায়?’ সে বলে, এখানে তো মালাউন নাই। খানিক পরেই এক গরিব হিন্দু অন্ধ লোক আসে তাদের কাছে সাহায্য চাইতে। তার পরনে ছিল ধুতি। এক আর্মি বলে, ‘এই তো মালাউন।’ বুঝে যায় এটা হিন্দু এলাকা। মোস্তফা কেন মিথ্যা বলল, তাই তাকে ধরে মারতে থাকে। এরপর পাক আর্মিরা পাশের হিন্দুপাড়ায় ঢোকে।

সিরাজগঞ্জে শিয়ালকোল গণহত্যার স্থান শনাক্ত করছেন শহিদুল আলম, ছবি: সালেক খোকন

ওই পাড়া থেকে সিরাজগঞ্জ জ্ঞানদায়িনী হাইস্কুলের শিক্ষক যোগেন্দ্রনাথ বসাক, তার বড় ভাই ননীগোপাল বসাক ও ভাতিজা প্রণব বসাককে ধরে নিয়ে যায়। পথেই পায় আরও তিনজন–শুকুচরণ রবিদাস, ফণীন্দ্রনাথ দাস ও প্রেমনাথ দাসকে। আর শিয়ালকোলে শিবচরণ রবিদাস ওই সময় তার বাড়িতে স্নান সেরে ধুতি নাড়ছিলেন। তাকেও ওরা ডেকে নেয়। এরপর পাকিস্তানি সেনারা তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে। ফণীন্দ্রনাথ দাস গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচেছিলেন। কিন্তু প্রচণ্ড রক্তক্ষরণে ওইদিন রাতেই বিনা চিকিৎসায় তার মৃত্যু হয়।

পাকিস্তানি আর্মি চলে যাওয়ার পর সেখানে ছুটে আসেন কয়েকজন। ওই সাতজন তখনও যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন। সবার হাতের বাঁধন খুলে দেন আজম, জামাল উদ্দিনসহ আরও কয়েকজন। সেই স্মৃতি বলতে গিয়ে আজও তারা আপ্লুত হন।

একাত্তরের হত্যাযজ্ঞটি যেখানে ঘটেছে সেখানে নেই কোনো স্মৃতিস্তম্ভ বা ফলক। খুব কাছেই ভাঙাচোরা একটি খুপরি ঘর। এটিই শহীদ শিবচরণ রবিদাসের বাড়ি। একাত্তরে জুতার কাজ করতেন তিনি। হত্যার পর পরিবার তার লাশ এনে সমাধিস্থ করেন ঘরের সামনেই। সমাধির ওপর এলোমেলোভাবে পড়ে আছে কয়েকটি লাল জবা। পিতার সমাধিতে সকাল-বিকেল এভাবেই ফুলেল শ্রদ্ধা জানান শিবচরণের ছেলে মংলা চন্দ্র রবিদাস।

স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু দুই হাজার টাকার সহযোগিতাসহ একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। এরপর আর কেউ খোঁজ নেননি। পরিবারও পায় না কোনো সরকারি সুবিধা। শহীদ পুত্রের ভাষায়, ‘শেখ মুজিব মারা যাওয়ার পর আমাদের ভাগ্যেরও মৃত্যু ঘটছে।’

সমাধির পাশে একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ দেখিয়ে মংলা চন্দ্র রবিদাস বলেন, ‘এখন বাবাকে মনে রেখেছে শুধুই সিরাজগঞ্জ গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি।’ ওই গাছটির গোড়ায় ছোট্ট সাইবোর্ডে লেখা, ‘৭১-এ গণহত্যায় নিহত শহীদ শিবচরণ রবিদাস কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষ।’

পিতার সমাধিতে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান শহীদ শিবচরণের ছেলে মংলা চন্দ্র রবিদাস, ছবি: সালেক খোকন

সিরাজগঞ্জ শহরে গিয়ে এভাবেই একটি উদ্যোগের পরিচয় মেলে। সেখানে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ সিরাজগঞ্জ গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি গঠনের মাধ্যমে একাত্তরকে জীবন্ত রাখার কাজ করে যাচ্ছেন। শিয়ালকোলে ওই কমিটির সদস্য শহিদুল আলম জানান, বাড়ি বাড়ি গিয়ে গণহত্যায় শহীদদের তালিকা প্রণয়নসহ শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে বিভিন্ন জায়গায় বৃক্ষরোপণ করছেন তারা। শুধু তাই নয়, হাট-বাজারে ঘুরে ঘুরে মানুষের কাছ থেকে ১০-১৫ টাকা করে আর্থিক সহযোগিতা তুলে তহবিল তৈরি করা হয়েছে। প্রশাসনের সহযোগিতায় ওই তহবিলের মাধ্যমে তারা শিয়ালকোলের গণহত্যার জায়গায় স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করতে চান।

সিরাজগঞ্জ গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটির উদ্যোক্তাদের মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা আশরাফুল ইসলাম জগলু চৌধুরী, নবকুমার কর্মকারের কথা উঠে আসে স্থানীয়দের আলাপচারিতায়। প্রচলিত ধারায় পদ-পদবির কমিটি না করে তারা শুধু আহ্বায়ক পদ রেখে সবাই সদস্য হিসেবেই একাত্তরের স্মৃতিরক্ষা ও ইতিহাস তুলে ধরার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

কোন ভাবনা থেকে একাত্তর নিয়ে এমন মহতী উদ্যোগ? এমন প্রশ্ন নিয়েই মুখোমুখি হই সিরাজগঞ্জ গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটির আহ্বায়ক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলামের।

তার অকপট উত্তর, ‘মূলত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করার আগ্রহ থেকেই আমরা মাঠে নামি। এরপর বিভিন্ন আইডিয়া আসতে থাকে। যেমন একাত্তরে শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে কৃষ্ণচূড়া, বঙ্গবন্ধুর নামে বটগাছ লাগানো প্রভৃতি। বাজার স্টেশনে এক শ্রমিক একটা বটগাছ লাগিয়েছিল। ওই গাছের সাথে তার নামটাও মিশে আছে। গাছটি দেখিয়ে সবাই বলে, ওই গাছটা লাগিয়েছে শ্রমিক নেতা মনির। সেখান থেকে আইডিয়াটা পাই। এখনও গ্রামের বাড়িগুলোতে মানুষ আলোচনা করে যে, এ গাছটা পরিবারের কে লাগিয়েছে। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিই গাছ লাগানোর।’

সিরাজগঞ্জ গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটির আহ্বায়ক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম, ছবি: সালেক খোকন

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধের তেমন কোনো স্মৃতি নেই, চিহ্নও নেই। এখানে যদি মুক্তিযোদ্ধাদের, শহীদদের ও বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় নেতাদের নামে গাছ লাগানোটা শুরু করা যায়, তাহলে ওই গাছটা বড় হবে। গাছটা মুক্তিযোদ্ধার কথা বলবে। একজন পথচারী হয়তো গাছের নিচে দাঁড়িয়ে নাম দেখে জানবে এই গাছটি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে। তখন ওই মুক্তিযোদ্ধার জীবনীসহ মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ও আলোচিত হবে। এই চিন্তা ও আবেগ থেকেই গাছ লাগানোর কাজটি শুরু হয়।

তবে শর্ত হলো, শুধু ঘটা করে গাছ লাগানো নয়, গাছটাকে নার্সিং করার কেউ না কেউ থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ভক্ত, ভাসানীর ভক্ত, কর্নেল তাহেরের ভক্ত, কোনো মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের কেউ। তারা ওই গাছটা লাগাবেন এবং নার্সিং করবেন। এভাবে আইডিয়াটা আমরা প্রচার করছি। যারা আমাদের সঙ্গে কাজ করছেন তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ, মুক্তিযোদ্ধাও আছেন। এখন পর্যন্ত প্রায় দুই শ গাছ লাগানো হয়েছে। যে গাছগুলো কোনো কারণে টেকেনি সেটা আবার রিপ্লেসও করা হয়েছে। পজেটিভ সাড়া আমরা পাচ্ছি। গাছ লাগাতে অনেকেই আগ্রহী হচ্ছেন এবং যত্ন করে তা বড় করছেন- এটা খুব আশার কথা।

কৃষ্ণচূড়া গাছ কেন?

সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘কারণ এই গাছের পাতা ও ফুলের সঙ্গে জাতীয় পতাকার লাল-সবুজের একটা মিল আছে। তাই আমরা ব্র্যান্ডিং করছি কৃষ্ণচূড়া গাছ। আবার গ্রামের ভেতরে বঙ্গবন্ধুর নামে লাগানো হচ্ছে বটগাছ। কিন্তু শহর এলাকায় জায়গা কম থাকায় বঙ্গবন্ধুর নামে আমরা বকুল বা আমলকী গাছ লাগাচ্ছি।’

সাইফুল ইসলাম জানান, এ কমিটির আরেকটি উদ্যোগের কথা। তিনি বলেন, বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে কমিটি করা হয়েছে। প্রতি বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসের দিনে দলবেঁধে তারা ফুল হাতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের কাছে গিয়ে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে আপনার বা আপনার পরিবারের অবদান অনেক। সে কারণে জাতি আপনার বা আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ।’ তখন ওই মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবার ভীষণ আবেগতাড়িত হয়। সেটা দেখে নতুন প্রজন্মকে আবেগতাড়িত হতে দেখছি। এভাবে পাঁচ বছর ধরে সিরাজগঞ্জের ৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা শ্রদ্ধা জানাচ্ছে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারকে। এটাকে একটা রীতিতে পরিণত করতে চাই আমরা। এই রীতি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লেই আমরা সার্থক হবো।’

আপনাদের অনুপ্রেরণায় সিরাজগঞ্জ ছাড়া অন্য কোথাও কি এটি চালু হয়েছে?

তার ভাষায়, ‘ঢাকায় সানিডেল স্কুলের টিচার জাকিয়া, তিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও লেখালেখি করেন। তার মা তাকে গর্ভে নিয়েই একাত্তরের সময়টা কাটিয়েছেন। তাই একাত্তর নিয়ে তার আবেগের জায়গাটা অন্যরকম। বিজয় ও স্বাধীনতা দিবসে জাকিয়া ওই স্কুলের কয়েকজন স্টুডেন্টসহ ফুল নিয়ে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে গিয়েছেন, এখনও যাচ্ছেন।

ভিডিও: সিরাজগঞ্জে একাত্তরকে জাগ্রত রাখতে কি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? কীভাবে কাজ করছে গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি?

চট্টগ্রামে রয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান। আমাদের এই কাজটার কথা শুনে তিনিও তার এলাকায় এটি করার চেষ্টা করেছেন। তারা বলেন, এটা সিরাজগঞ্জ মডেল। এটা আমরা বাইন্ডিংসে রাখতেই চাই না। যে জানবে, সে চাইলেই করতে পারবে। তাতেই আমরা খুশি। এটা সবাই মিলেই ছড়িয়ে দিতে হবে।’

গণহত্যা প্রসঙ্গে এ মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘একাত্তরে কোথায় কোথায় গণহত্যা হয়েছে তার অধিকাংশই আপনার মতো গবেষকরা লিখে রেখেছেন। সেটা আমরা ফিল্ডে নিয়ে যাচ্ছি, ক্রসচেক করছি। সময় স্বল্পতার কারণে বাইরে থেকে এসে কোনো গবেষণা করা সত্যি কঠিন। ফলে দেখা গেছে, ১৯৭৩ সালে বাহার নামে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির একজন মারা গেছে, অথচ তার নামটাও মুনতাসীর মামুনের গণহত্যার বইয়ে একাত্তরের শহীদ হিসেবে চলে আসছে। এগুলো আমরা ঠিক করে নিচ্ছি। এছাড়া সিরাজগঞ্জের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্য জায়গায় গিয়েও মারা গেছেন। এমন শহীদের নামও আমরা সংগ্রহ করছি।

পাশাপাশি শহীদ স্মরণে তাদের নিয়েই ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসে গণহত্যার স্থানে, যুদ্ধের স্থানে আর শহীদ মিনারে মোমবাতি প্রজ্বলন করছি। প্রতিটি গণহত্যার স্থান ও যুদ্ধের স্থানে সরকার যদি স্মৃতিফলক না করে তাহলে আমরা স্থানীয় জনগণের উদ্যোগেই সেটা করার চেষ্টা করছি।

শিয়ালকোলে ইতিমধ্যে ৪০ হাজার টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্ডে জমা হয়েছে। যেহেতু টাকা নিয়ে নানা ধরনের কেলেঙ্কারি হয় তাই আমরা স্বচ্ছতার বিষয়েও সর্তক থাকি। এছাড়া সমমনা মানুষ, ঘনিষ্ঠজন কিছু আর্থিক সহযোগিতা করেন ভালবেসে। নাট্যকার বৃন্দাবন দাশ, অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী, এমন অনেকেই আছেন। তাদের দেওয়া টাকা স্বচ্ছতার সঙ্গে জমা থাকে ব্যাংকে। টাকা যেন মিসইউজ না হয় সে বিষয়গুলোও আমরা খেয়াল রাখি।’

এ কাজে তো রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব থাকার কথা। আপনার কি প্রশাসনকে জানাচ্ছেন?

তিনি বলেন, ‘আমরা ডিসি সাহেবকে বলেছি শিয়ালকোলে জায়গা চিহ্নিত করে দিতে। উনি বলেছেন দেখবেন ব্যাপারটা। তাদেরকে আমরা সবকিছু জানাই। কিন্তু তাদের জন্য বসে থাকতে রাজি নই। তাই স্বউদ্যোগে চেষ্টা করি। যেমন ধীতপুর গণহত্যার স্থানে একজন দুই শতক জায়গা দিতে চেয়েছেন। সরকার না করলে সেখানে হয়তো মুষ্টির চাল তুলে স্থানীয়ভাবেই স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করার উদ্যোগ নেব। একাত্তরে হয়েছিল তো জনযুদ্ধ। তাই মুক্তিযুদ্ধের কাজে জনগণকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা আমরা করছি। গণহত্যার জায়গা চিহ্নিত করা ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে যাচাই করে শহীদদের নামের তালিকা সংগ্রহ ও বিভিন্ন স্থানে তা লিখে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি।’

সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধটা ছিল একটি জনযুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদের নামে বিভিন্ন রাস্তার নামকরণে সরকারের নির্দেশনা আছে কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। আমরা সেটাই চেষ্টা করছি মাত্র।’

কিন্তু সরকারিভাবেই তো এটা হওয়ার কথা। হচ্ছে না কেন?

তার ভাষায়, ‘পলিটিক্যালি যে প্রবলেমটা হচ্ছে সেটা হলো, সবাই দৌড়ায় উপরের দিকে। এভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধটাকেও গণবিচ্ছিন্ন করা হইছে। এটা করছি আমরাই। কিন্তু দোষ দেই স্বাধীনতা-বিরোধীদের। যেমন বনবাড়িয়ার একটা রাস্তা আছে, সাবানা রোড। কার নাম এটা? কেউ জানে না। সেই রাস্তার নাম সহজেই হতে পারে বীর মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব আলী সড়ক। কিন্তু স্থানীয়ভাবে যদি এই উদ্যোগ না নেওয়া হয়, ডিসি সাহেব কী করবেন? উনি তো বাইরে থেকে চাকরি করতে আসছেন। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে রাজনীতি করছি তাদেরই এটা করা দরকার। এটা আমাদেরই দায়িত্ব। আমরা যারা যারা দায়িত্ব মনে করি তারা তারা হাঁটতেছি। এই সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তেছে। এই প্রস্তাবনাও ধীরে ধীরে আসতে থাকবে। তখন সরকারও এ কাজগুলো করবে। বিভিন্ন রাস্তার নামকরণে সরকারের কিন্তু প্রস্তাব আছে, বাস্তবায়ন নাই। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা জনগণকে সাথে নিয়ে। জনযুদ্ধে জনগণের অংশগ্রহণ যেমন ছিল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্যও জনগণের অংশগ্রহণটা খুবই জরুরি।’

সম্প্রতি জনগণকে সম্পৃক্ত করে সিরাজগঞ্জ গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি ‘গ্রামের মুক্তিযুদ্ধ’ নামে আরেকটি উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। ওই উদ্যোগটির কথা জানান মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম।

গ্রামের মুুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করছে সিরাজগঞ্জ গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি, ছবি: সালেক খোকন

তার ভাষায়, ‘২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জের গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি গঠিত হয়। আমরা মুক্তিযুদ্ধকে দেখার চেষ্টা করছি জনগণের চোখ দিয়ে। জানার চেষ্টা করছি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জনগণের অভিজ্ঞতার কথা। এসব শুনতে গিয়ে অনুসন্ধান কমিটির ধারণা হয়েছে, প্রতিটি বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আছে বিশাল আবেগ। যে আবেগ বুঝে জনগণের সঙ্গে ঐক্য গড়তে পারলে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী নানা ষড়যন্ত্রকে পরাজিত করা সম্ভব সহজেই। এ জন্য প্রয়োজন জনগণকে সম্পৃক্ত করে মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিক চর্চা। ওই লক্ষ্য নিয়েই সিরাজগঞ্জ গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি শিয়ালকোল ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের তথ্য সংগ্রহ করছে, জানতে চেষ্টা করেছে ওই সময়ে গ্রামে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা। চেষ্টা করা হয়েছে ঘটনাগুলো একত্র করে ইউনিয়নের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস দাঁড় করানোর। অনুসন্ধান কমিটির সংগঠকেরা পেশাদার গবেষক নয়, নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এটি করছে তারা আন্তরিকতা নিয়েই। ভবিষ্যতে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়ে তা সংশোধিত হবে, তৈরি হবে ইউনিয়ন থেকে উপজেলা, উপজেলা থেকে জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, জনযুদ্ধের ইতিহাস। এভাবে পিরামিডের মতো আরও ওপরে উঠবে। তখনই সম্ভব হবে বাঙালির আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নপূরণ।’

একাত্তরকে জাগ্রত রাখার কাজ করছে সিরাজগঞ্জ গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি। ফলে সেখানে প্রজন্ম অনুভব করতে শিখছে মুক্তিযুদ্ধকে। মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলামসহ কমিটির সদস্যদের স্বপ্ন, একদিন প্রত্যেকটি গ্রাম হবে মুক্তিযুদ্ধের গ্রাম। ওই গ্রামের সড়কগুলোর নামকরণ হবে বীর মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদের নামে। গ্রামে একটি পাঠাগার থাকবে। সেটি হবে বঙ্গবন্ধুর নামে। গ্রামে ঢুকতে গেলে যে কেউই অনুভব করতে পারবেন এ দেশে একদিন মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা।

সিরাজগঞ্জের মতো মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিরক্ষার এমন স্বপ্নগুলো সঞ্চারিত হোক সারাদেশে। সিরাজগঞ্জ গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটির উদ্যোগগুলো ছড়িয়ে পড়ুক গ্রামে গ্রামে। মানুষের মনে সদা জাগ্রত থাকুক একাত্তর।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৭ মে ২০২৩

© 2023, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button