এপ্রিল ১৯৭১ : রক্তে ভেজা দেশে মুজিবনগর সরকার গঠনের মাস
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে শব্দ সৈনিকদের ভূমিকা অনেক৷ লেখার শুরুটা তাই তাদের নিয়ে- আরো স্পষ্ট করে বললে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে নিয়ে৷
একাত্তরে তখনও সশস্ত্র সংগঠন তৈরি হয়নি৷ তার আগেই শব্দ সৈনিকদের দশ জনের একটি দল ২৬ মার্চ স্বতঃস্ফূর্তভাবে চট্টগ্রামের কালুরঘাট ট্রান্সমিটার ভবনে গিয়ে স্বাধীন বাংলা (বিপ্লবী) বেতার কেন্দ্র গড়ে তোলেন৷ ৩০ মার্চ পর্যন্ত ওই কেন্দ্রের প্রচার চলে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে৷ সেদিনই ট্রান্সমিটার ভবনে পাকিস্তানি বিমান থেকে বোমা বর্ষণ করা হয়৷ ১ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটারটি ডিসমেন্টাল করে তারা চলে যান পটিয়ায়৷ ৩ এপ্রিল থেকে স্বাধীন বাংলা (বিপ্লবী) বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান আবারও শুরু হয় রামগড় সীমান্তবর্তী মুক্ত অঞ্চলে, যা চলে ২৫ মে ১৯৭১ পর্যন্ত৷ পরে ভারত সরকারের কাছ থেকে পাওয়া ৫০ কিলোওয়াট ক্ষমতার একটি ট্রান্সমিটারে কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে আরো ব্যাপকভাবে এর কার্যক্রম শুরু হয়৷ সেসময় ‘বিপ্লবী’ শব্দটি বাদ দিয়ে নাম করা হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র৷ (তথ্যসূত্র: বেলাল মোহাম্মদ রচিত গ্রন্থ- স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র)৷
এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত দশজন শব্দসৈনিকের নাম রয়েছে বেলাল মোহাম্মদ রচিত ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ গ্রন্থে৷ সেই গ্রন্থের বিবরণ অনুযায়ী অনুষ্ঠান বিভাগে ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাসেম সন্দ্বীপ, আবদুল্লাহ-আল-ফারূক, মুস্তফা আনোয়ার ও কাজী হাবিবউদ্দীন আহমদ৷ আর প্রকৌশল বিভাগে সৈয়দ আব্দুর শাকের, রাশেদুল হোসেন, আমিনুর রহমান, শারফুজ্জামান ও রেজাউল করিম চৌধুরী ছিলেন৷ এছাড়াও নৈমিক্তিকভাবে অনুষ্ঠান প্রচার বা ঘোষণা এবং নেপথ্যে উৎসাহক হিসেবে যুক্ত ছিলেন অনেকেই৷
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন বলে দাবি করে তার দল বিএনপি৷ কিন্তু এ দাবিকে বিভিন্ন সময় ‘অহেতুক ও ভিত্তিহীন’ বলেছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত বেলাল মোহাম্মদ৷ বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তার প্রয়োজনে ২৭ মার্চ পটিয়ায় গিয়ে তিনিই মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কথা বলেছিলেন এবং তারপর জিয়াউর রহমান বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন বলেও জানিয়েছেন তিনি৷
বেলাল মোহাম্মদ জীবদ্দশায় স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি বর্ণনা করেছিলেন এভাবে, ‘‘২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঢাকা থেকে প্রেরিত স্বাধীনতার ঘোষণার তারবার্তাটির অনুবাদ চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে আমরা বারবার পড়েছি৷ শুধু বেতার কর্মীরাই সেটা পড়েছি, অন্য কেউ নয়৷ একজন রাজনৈতিক নেতা (চট্টগ্রামের স্থানীয় রাজনৈতিক এম এ হান্নান সাহেব) এসেছিলেন৷’’
‘‘মেজর সাহেবকে (সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান) পেয়েছিলাম ২৭ মার্চ সন্ধ্যায়৷ তখন তাকে সরাসরি প্রস্তাব তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে একটা ড্রাফট তৈরি করা হয়, অন বিহাফ অফ আওয়্যার গ্রেট ন্যাশনাল লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’-এভাবেই ওটা প্রচার হয়েছে৷ ওটার বাংলা অনুবাদ আমি করেছি এবং ওদিনই সেটি আব্দুল্লাহ আল ফারূক সাহেব পাঠ করেন৷ জিয়াউর রহমান এরপর ২৮ ও ২৯ মার্চ তারিখেও আসেন এবং বক্তব্য দেন৷ এভাবে তার তিনটি ঘোষণা বেতারে প্রচারিত হয়েছে৷ সবগুলোই ছিল বঙ্গবন্ধুর পক্ষে৷ সেভাবেই প্রচার হয়েছে৷সত্য সবসময় অবিনাশী৷ এ নিয়ে বির্তকের কোনো সুযোগ নেই৷’’ (তথ্যসূত্র: ডয়চে ভেলে সংলাপ, তারিখ-৩০.০৭.২০১৩, বেলাল মোহাম্মদ রচিত গ্রন্থ- স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র)৷
সীমিত জনবল আর সামর্থ্যের মধ্যেও যুদ্ধের দিনগুলোতে টানা সম্প্রচার চালু রেখেছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতারের শব্দসৈনিকেরা, যা দেশের আপামর জনসাধারণকে স্বাধীনতার পথে উৎসাহ, সাহস ও আশা জুগিয়েছে৷ একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিকদের ভূমিকা তাই শ্রদ্ধার সঙ্গে চিরস্মরণীয়৷
এদিকে একাত্তরের এপ্রিলের শুরুতেই দেশের নানা অংশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশের বাঙালি সদস্য ও ছাত্রজনতা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শুরু করেন৷
ওইসময় প্রতিরোধের ধরন কেমন ছিল তা জানতে মুখোমুখি হই বীর মুক্তিযোদ্ধা এ জেড এম আমিনুল ইসলাম চৌধুরীর৷ সিরাজগঞ্জের তৎকালীন ছাত্রনেতা তিনি৷ তাদের উদ্যোগেই ওই জেলায় প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়৷ তিনি বলেন, ‘‘সিরাজগঞ্জের তৎকালীন এসডিও এ কে এম সামসুদ্দিন সাহেব পুলিশের যত রাইফেল ও গুলি ছিল তা আমাদেরকে সরবরাহ করেন৷ আমরা তখন ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জ আসার একমাত্র রেলপথে প্রতিরোধ গড়ি, উল্লাপাড়ায় ঘাটিনা নামক রেলব্রিজে৷ কয়েক হাজার মানুষ লাঙ্গল, ফালা, লাঠি, বল্লম, সুরকি, জোয়াল, মোটকথা ঘরে যা ছিল তা নিয়েই সেখানে অবস্থান নেয়৷’’
‘‘১০ এপ্রিল ১৯৭১৷ আর্মিরা ঈশ্বরদী থেকে ট্রেন নিয়ে আসে৷ ট্রেনের সামনে-পেছনে ইঞ্জিন, মাঝখানে ওয়াগন৷ ওয়াগনের দরজায় বালির বস্তা দিয়ে বাঙ্কার করা৷ সেখানে পজিশন নিয়ে থাকে সেনারা৷ কিন্তু ঘাটিনা ব্রিজের কাছে আসতেই ওরা বাধার মুখে পড়ে৷ গ্রামের মানুষ আগেই রেললাইন তুলে ফেলে বিভিন্ন জায়গায়৷ ফলে ওরা ঢুকতে পারে না৷’’
‘‘১৭ এপ্রিল ওরা ঈশ্বরদী থেকে ননবেঙ্গলি বিহারিদেরও সঙ্গে নিয়ে আসে৷ বিহারিরা নেমে রেললাইন মেরামত করে দিলে সেনারা ট্রেন নিয়ে সামনে এগোয়৷ কিন্তু আবারও প্রতিরোধের মুখে পিছু হটে৷ আর্মিরা তখন ক্ষিপ্ত হয়ে মর্টারসহ হেভি অস্ত্র নিয়ে ঢোকে৷ অনবরত গুলি চালাই আমরাও৷ কিন্তু গোলাবারুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় টিকতে পারি না৷ ওরা তখন সিরাজগঞ্জে ঢুকে প্রথম ওয়াপদা রেস্ট হাউজে এবং পরে বিএ কলেজ, পিডাব্লিউডির রেস্ট হাউজ, যমুনার পাড়ের বিএল সরকারি স্কুলে ক্যাম্প করে৷ শহরের বাইরে ভাটপিয়ারী ও শৈলাবাড়ি ছাড়াও থানায় থানায় গড়ে তোলে ক্যাম্প৷ এরপরই গ্রামে গ্রামে ঢুকে মানুষের বাড়িতে হামলা করে ঘরগুলো জ্বালিয়ে দিতে থাকে৷’’
জেলা শহরগুলো দখলে নিয়েই পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি নিধনে নামে৷ কুষ্টিয়া, লালমনিরহাট, যশোর, রাজশাহী, সৈয়দপুরসহ অনেক জেলায় বিহারিরাও বাঙালিদের হত্যাযজ্ঞে অংশ নেয়৷ একাত্তরে বাঙালিদের ওপর বিহারিদের নৃশংসতার মাত্রাটি অনুমান করা যায় নানা ঘটনায়৷ তেমনি একটি ঘটনার কথা জানিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ হোসেন৷ রেলওয়েতে বাবার চাকরির সুবাদেই তারা থাকতেন সৈয়দপুরে, আতিয়ার কলোনির এল-৭৬-বি নম্বর কোয়ার্টারে৷ তার মা সুফিয়া খাতুনকে সেখানেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয়৷
সেই ঘটনার কথা বলতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হন মুরাদ হোসেন৷ হৃদয়বিদারক সেই স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমি তখন লুকিয়ে ছিলাম গ্রামের দিকে৷ তারিখটা ১৪ এপ্রিল ১৯৭১৷ মেইন রোডের পাশেই ছিল আমাদের কোয়ার্টার৷ মার্চের শুরুতেই ছাদের ওপর একটা বাংলাদেশের পতাকা ও একটা কালো পতাকা টাঙিয়ে দিয়েছিলাম৷ বাংলাদেশের পতাকা উড়তে দেখে ওরা ক্ষিপ্ত হয়৷’’
‘‘বিহারিরা প্রথম এসে আম্মাকে বলে, ‘উসকো উতার দো’৷ আম্মা বলেন, ‘আমার ছেলে টাঙিয়েছে৷ এটা আমি নামাতে পারবো না৷’ ওরা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাকিস্তানি আর্মিদের ভয় দেখিয়ে আবারও পতাকা নামাতে বলে৷ কিন্তু এবারও আম্মা অস্বীকৃতি জানায়৷ রাগ হয়ে ওরা গালাগালি করে চলে যায়৷’’
কিছুক্ষণ পরেই আর্মিসহ বিহারিদের একটি সশস্ত্র দল এসে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে৷ আম্মা রেহালে রেখে কোরআন শরিফ পড়ছিলেন৷ সামনের দরজা ভেঙে ওরা ঘরের ভেতরে যখন ঢোকে, তখন তিনি কোরআন শরিফ বুকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকেন৷ আম্মাকে ওরা কোপ দিয়ে দেহ থেকে মাথা আলাদা করে ফেলে৷ রক্তে ভেসে যায় পুরো ঘর৷ আল্লাহর কালাম কোরআন শরিফও মাটিতে পড়ে রক্তে ভিজে যায়৷ পরে আম্মার লাশ পাকিস্তানি আর্মিরা ট্রাকে তুলে নিয়ে যায়৷’’
‘‘আশপাশের পরিচিতজনরা আম্মার করুণ ও নির্মম এ মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছেন৷ তাদের মুখেই শুনেছি সবকিছু৷ ওরা চলে গেলে পাশের বাসার একজন ঘর থেকে রক্তমাখা কোরআন শরিফটি তুলে নেন৷ পরে সেটি আমরা সংগ্রহ করি৷ ওই কোরআন শরিফটাই আম্মার শেষ স্মৃতি, যার পাতায় পাতায় রয়েছে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ৷ ওটা হাতে নিলে এখনও বুকের ভেতরে ঝড় ওঠে৷ দেশ তো স্বাধীন হয়েছে কিন্তু আমরা তো মাকে ফিরে পাইনি, তার লাশও পাইনি৷ ফলে তার কবরও নেই৷ পুরো দেশের মাটিতেই মিশে আছে আমার মায়ের রক্ত৷ কিন্তু এ দেশ কি মনে রাখবে আমার শহীদ মাকে?’’
একাত্তরের এপ্রিল থেকে বাঙালি নিধনে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে বিহারিদের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামি ও ইসলামি ছাত্র সংঘের তৎকালীন নেতারাও যোগ দেয়৷ জানা যায়, মিরপুরে আলব্দী গ্রামের গণহত্যায় অংশ নিয়েছিলেন জামায়াত নেতা কাদের মোল্লা৷
এ নিয়ে কথা হয় প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন মোল্লার সঙ্গে৷ তার বর্ণনায় এভাবে উঠে আসে আলব্দী গ্রামের গণহত্যার স্মৃতি, ‘‘বাবাসহ ছিলাম আলব্দী গ্রামে, খালু রোস্তম বেপারির বাড়িতে৷ ২৪ এপ্রিল ১৯৭১৷ ভোর তখনও হয়নি৷ গ্রামের পশ্চিমে তুরাগ নদীর পাড়ে পাকিস্তানি সেনাদের হেলিকপ্টার নামে৷ ওই সময়ই কাদের মোল্লা, বিহারি আক্তার গুন্ডা, নেওয়াজ ও ডোমারা দলবল নিয়ে আলব্দী গ্রামে ঢোকে সশস্ত্র অবস্থায়৷ আমরা তখন ছোট্ট একটি খালের কচুরিপানায় লুকিয়ে থাকি৷ সকাল আনুমানিক নয়টা৷ খালের পঞ্চাশ গজ দূরে ধরে আনা হয় ৫০-৬০ জনকে৷ তাদের লাইন করে দাঁড় করায় কাদের মোল্লাসহ অন্যরা৷ তারপর হঠাৎ গুলির শব্দ৷ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে লাইনের সবাই৷ মানুষের আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে ওঠে আলব্দী গ্রামের বাতাস৷ ওইদিন ওরা আমার খালুসহ তিনশ চুয়াল্লিশ জনকে হত্যা করে৷’’
মিরপুরে আলব্দী গ্রামের ওইদিনের গণহত্যায় অংশ নেওয়ার অভিযোগে ২০০৮ সালে ২৩ জানুয়ারি আমির হোসেন মোল্লা জামায়াতের তৎকালীন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাসহ দশজনের বিরুদ্ধে আদালতে একটি পিটিশন দায়ের করেন৷ আদালতের নির্দেশে ওই পিটিশনটি পল্লবী থানায় নিয়মিত মামলা হিসেবে রেকর্ডভুক্ত হয় ২৫ জানুয়ারি তারিখে৷ মামলা নং- ৬০৷
দেশের ভেতর যখন পাকিস্তানি সেনা ও তার দোসররা হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে তখন স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রস্তুতি চলতে থাকে ভারতে৷ ১০ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে বাংলাদেশ সরকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রদান করে৷ যা বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান বলে ধরে নেওয়া হয়৷ ওইদিন সত্তরের নির্বাচনে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মিলিত হয়ে প্রবাসী সরকার গঠন ও এই সংবিধান প্রতিষ্ঠা করেন৷
তারা পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেন৷ আরও সিদ্ধান্ত হয় সৈয়দ নজরুল ইসলাম হবেন উপরাষ্ট্রপতি, যিনি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন আর তাজউদ্দীন আহমদ যুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে থাকবেন৷
মন্ত্রিসভার সদস্য হন: এম মনসুর আলী (অর্থ বাণিজ্য ও শিল্প) ও এএইচএম কামারুজ্জামান (স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ, পুনর্বাসন ও কৃষি) এবং খন্দকার মোশতাক আহমদ (পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ মন্ত্রী)৷
জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী প্রবাসী সরকারের মুক্তিবাহিনীর প্রধান কমান্ডার ও মেজর জেনারেল আবদুর রব চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন৷ এইচটি ইমাম মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷
গঠিত সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি হয় ১৭ এপ্রিল, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায়৷ পরে ইতিহাসের হাত ধরেই বৈদ্যনাথতলা হয়ে যায় মুজিবনগর৷
কথা হয় মুজিবনগরে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে গার্ড অব অনার প্রদানকারী বারোজনের মধ্যে বেঁচে থাকা চারজন আনসার সদস্যের সঙ্গে৷ তারা হলেন- মো. সিরাজ উদ্দীন, মো. হামিদুল হক, মো. আজিমুদ্দীন ও মো. লিয়াকত আলী৷
মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দীনের ভাষ্য ছিল এরকম, ‘‘মঞ্চ তৈরির দায়িত্ব ছিল স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির মোমিন, জজ মাস্টার, আইয়ুব ডাক্তার, সৈয়দ মাস্টার, রফিক মাস্টার, রুস্তম উকিল, জামাত মাস্টার, সুশীল কুমার বিশ্বাস প্রমুখের৷ মাটির ওপরে তক্তা বিছানো হয়৷ কাপড়, দড়ি, বাঁশ, দেবদারুর পাতা দিয়ে সাজানো হয় অনুষ্ঠানস্থল৷ দুটি বাঁশ পুঁতে দেবদারুর পাতায় তৈরি করা হয় গেট৷ চেয়ার, মাইক আর টেবিল আসে ভারত থেকে৷ শেষরাতের দিকে আমাদের ক্যাম্প থেকে আনা হয় চৌকি৷’
তিনি আরো বলেন, ‘‘অনুষ্ঠানটি শুরু হয় বেলা ১১টায়৷ জাতীয় নেতারা মঞ্চে উঠলে আসাদুল হক, শাহাবুদ্দিন আহমেদ সেন্টু, পিন্টু বিশ্বাস, আইয়ুব প্রমুখ জাতীয় সংগীতে কণ্ঠ দেন৷ কোরআন তেলাওয়াত করেন মো. বাকের আলী৷’’
১৭ এপ্রিল প্রবাসী বা মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন দলের হুইপ এমএনএ আবদুল মান্নান৷ চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন৷ শপথ করান সৈয়দ নজরুল ইসলাম৷ এরপরই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভাষণ দেন৷ মূলত এই শপথ অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের নাম সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে৷ এই সরকারের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে৷
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে ডয়চে ভেলে বাংলায়, প্রকাশকাল; ২৮ এপ্রিল ২০২৩
© 2023, https:.