কলাম

নগরে উদযাপন গ্রামে দিনযাপন

বাঙালির আবেগ ও অন্তরে মিশে আছে ‘বাংলা নববর্ষ’। প্রতিটি বাঙালির কাছে এ উৎসব যেন শেকড়ের মিলনমেলা। লোকজের সঙ্গে নাগরিক জীবনের সেতুবন্ধ তৈরি করে বৈশাখের আয়োজনগুলো। নববর্ষই বাঙালি জাতিকে একত্র করে বাঙালি জাতীয়তাবোধে। তাই ধর্ম, বর্ণ ও সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে বাংলা নববর্ষকে সাদরে আমন্ত্রণ জানায় দেশের মানুষ। এটি বাঙালির সর্বজনীন প্রাণের উৎসব। এখানে উল্লেখ্য যে, নাগরিক জীবনে নববর্ষ যেমন উদযাপনের সঙ্গে জড়িত, গ্রামীণ জীবনে তা মানুষের দিনযাপনের সঙ্গে বেশি সম্পর্কিত। যার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আবহমান বাংলার কৃষিও। বৈশাখে গ্রামীণ জীবনে হালখাতার আনন্দ ও ঐতিহ্য, নতুন বছরে কৃষকের পরিকল্পনা ও সম্ভাবনার শুভ স্বপ্ন রোপিত হয় বাংলা নববর্ষেই। নববর্ষের আয়োজনে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে পালপাড়ার মানুষরাও। সারা দেশে গ্রামীণ মেলাগুলোও পরিণত হয় উৎসবে। এই উৎসবের রঙই একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়তে বাঙালি জাতিকে প্রেরণা দিয়ে আসছে।

কাঁটাতারের বেড়ার ওপাশেই ভারতের রাধিকাপুর। দূর থেকেই সেখানকার থেমে থাকা ট্রেনগুলো ঠিক দেখা যায়। এপাশে দিনাজপুরের রামচন্দ্রপুর গ্রাম। রাধিকাপুর আর রামচন্দ্রপুর একসময় একই জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রায় তিনশ বছর আগ থেকেই বছরে একবার এই রামচন্দ্রপুরে বসে শঙ্খবাণী মেলা। একসময় এই মেলাই ছিল দুই বাংলার মানুষের মিলনমেলা।

সময়ের গতিতে দেশভাগ হয়। কাটা তার বসে সীমান্তে। ফলে রাধিকাপুরের লোকেরা এখন মেলায় আসতে পারে না। একবার দিনাজপুরে গিয়ে বন্ধু শামীমের মুখেই শুনলাম শঙ্খবাণী মেলার কথা।

হিন্দু পঞ্জিকামতে, বৈশাখ মাসের প্রথম মঙ্গল অথবা শনিবারে দিনাজপুরের বিরল উপজেলার রামচন্দ্রপুরে বসে শঙ্খবাণীর মেলা। শতবর্ষী এক বটের ছায়ায় বসে মেলাটি। মেলা প্রাঙ্গণে আছে অতি প্রাচীন কালো পাথরের মূর্তি। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ওইদিন সেখানে আয়োজন করে পূজাসহ নানা আচারের। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মেলাপাগল মানুষদের পায়ের ছাপ পড়ে রামচন্দ্রপুরের মেঠোপথে। মনোবাসনা পূরণের আশা নিয়ে আশপাশের জেলার লোকেরাও ভিড় জমায় এ মেলায়। বৈশাখ মাসে মেলা! শুনেই রওনা হই রামচন্দ্রপুরের দিকে।

জীর্ণশীর্ণ গ্রাম্য রাস্তায় কাঁঠালপাকা রোদে চলছি গরম জিলাপি, পাঁপড় আর পুণ্যসন্ধানীদের মুখ দেখব বলে। চারপাশে সবুজ ধানক্ষেত। বরেন্দ্র অঞ্চলের ধানক্ষেতের সৌন্দর্য অন্যরকম। ঠিক যেন স্তরে স্তরে সবুজ গালিচা বিছানো। দমকা বাতাসে সবুজ প্রাণে চলে উথাল-পাতাল ঢেউ।

মিনিট চল্লিশের মধ্যেই পৌঁছে যাই ভারাডাংগি বাজারে। বাকি ৫ কিলোমিটার পথ যেতে হবে মহিষের গাড়ি বা ভ্যানে। আমরা মহিষের গাড়িতেই উঠে পড়ি। কাঠের চাকায় মেঠোপথ খুঁড়িয়ে ক্যাচ ক্যাচ শব্দে এগোতে থাকে গাড়িটি। মনের মধ্যেও তখন অন্যরকম দোলা লাগে।

শঙ্খবাণীর মেলায় যখন পৌঁছাই তখন দুপুর ছুঁইছুঁই। বড় একটি বটগাছের ছায়ায় বসেছে মেলাটি। দীর্ঘদেহী ছড়ানো বটগাছটিই যেন মেলার প্রধান সৌর্ন্দয। যতটা সাদামাটা ভেবেছিলাম মেলার আয়োজন তার চেয়েও অনেক অনেক বড়। বটগাছের তলায় নানা বাহারি জিনিস নিয়ে বসেছে দোকানিরা। শিশুদের খেলনার দোকানগুলোতে উপচে পড়া ভিড়। বাঁশ আর কাঠের তৈরি নানা রঙের মন ভোলানো খেলনা কিনতে শিশুরা যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।

পাশেই বেশ কয়েকজন দোকানি বসেছে শাঁখা আর কাচের চুড়ি নিয়ে। চুড়ির শব্দে ঢেউ লেগেছে তরুণীদের মনে। হাত বাড়িয়ে দেখে নিচ্ছে পছন্দের চুড়িগুলো। কেউবা আবার দোকানির হাতেই পরে নিচ্ছে পছন্দের শাঁখা বা চুড়ি।

মেলার একপাশে রঙিন কাপড় টাঙিয়ে লাইন ধরে বসেছে কয়েকটি মিষ্টির দোকান। দোকানগুলোর ভেতরের পাম্প চুলায় শোঁ শোঁ শব্দ। সেখানে গরম তেলে নানা ঢঙের জিলাপি ভাজা হচ্ছে। সাজিয়ে রাখা হয়েছে গুড়ের জিলাপি, ছানার সন্দেশ, চমচমসহ নানা রসের মিষ্টি। দূর থেকে দেখলেই জিভে জল এসে যায়। কেউ কেউ দোকানে বসে ফুঁ দিয়ে দিয়ে পালা করে খাচ্ছে জিলাপি।

মেলার মাঝ বরাবর মাটির তৈরি খেলনা, কাঁসার প্রদীপ আর তালের পাখা নিয়ে বসেছে একজন। তাকে ঘিরে ধরেছে ভিড়ের এক অংশ। ফুরিয়ে যাওয়ার ভয়ে সবাই যেন কেনায় ব্যস্ত।

রঙচঙা পোশাকে ঠোঙ্গার মধ্যে মুড়ালি আর আচার হাতে একদল তরুণী ঘুরে দেখছে মেলাটি। মাঝে মঝেই তারা প্রাণখোলা হাসিতে ঢলে পড়ছে।

মেলার একপাশে ছোট্ট একটি মন্দির। এটিই শঙ্খবাণী মন্দির। মনোবাসনা পূরণের ইচ্ছা নিয়ে মন্দিরটিতে পূজা দিতে লাইন ধরেছে শত শত লোক। সবার হাতে পাতায় মোড়ানো ধূপ-সিঁদুর। মানত করে সেটি তারা ছুড়ে দিচ্ছে শঙ্খবাণীর দিকে। কেউ কেউ রুপা বা স্বর্ণের পাদুকা বানিয়ে শঙ্খবাণী মূর্তির শরীরে লাগিয়ে দেয়।

আমরা ভিড় ঠেলে ভেতরে যাই। কথা বলি পূজারী ফগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি জানান শঙ্খবাণী নিয়ে প্রচলিত লোককাহিনিটি।

এখানেই ছিলেন এক রাজা। তারই আদরের একমাত্র মেয়ের নাম ছিল শঙ্খবাণী। একদিন রাজবাড়ির পাশ দিয়ে এক শাঁখারি শাঁখা ফেরি করছিল। শাঁখার কথা শুনে রাজকন্যা শঙ্খবাণীর মন উদ্বেল হলো। ঘরকন্নায় ব্যস্ত রাজকন্যা আকুল হয়ে ছুটে এলো স্নানঘরে নিজের কাপড় ধোয়া ফেলে রেখে। শখ করে শাঁখা কিনল সে আর কুমারী অবস্থাতেই হাতে পরল সেই শাঁখা। এ খবর ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। শুনে রাজা ক্ষিপ্ত হলেন, ক্রোধের বশে মারতে গেলেন মেয়েকে। বাবার আচরণে শঙ্খবাণী মনে কষ্ট পায়। মনের দুঃখে সে ঝাঁপ দেয় রাজবাড়ির পাশের দীঘিতে।

ঝাঁপ দেওয়ার সময় সে রাজার উদ্দেশে বলে যায়, ‘আজ তুমি আমাকে অপমান করলে, একদিন তুমি আমাকেই পূজা দেবে।’ এর কিছুদিন পরেই নাকি এই স্থানে এক রাতে কালো পাথরের মূর্তি ভেসে ওঠে। সে থেকে এখানে মা শঙ্খবাণীর পূজা হয়ে আসছে। প্রচলিত বিশ্বাস, যে যেই ইচ্ছা নিয়ে এখানে আসে তার সে ইচ্ছা পূরণ হয়ে যায়। মূলত এই শঙ্খবাণী পূজাকে ঘিরেই এখানে এক দিনের মেলা বসে।

হঠাৎ মন্দিরস্থলে ঢাকঢোল আর বাঁশির করুণ সুর বেজে ওঠে। আমরা বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখি। দেবংশী চন্দ্রকান্ত রায় মন্ত্র পাঠ করতে থাকেন। মন্ত্রের সঙ্গে চলে ঢাকের শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে খালি গায়ে চার যুবক হাতের মধ্যে কবুতর নিয়ে নানা ভঙ্গিতে নাচতে থাকে। পূজারী জানাল দেবতারা নাকি তাদের ওপর ভর করেছেন। নাচ শেষে দেবংশী একে একে ভোগ খাইয়ে তাদের মুক্তি দেন বা বির্সজন দেন।

পূজা শেষে সবাই ব্যস্ত হয়ে পরে মেলার কেনাকাটায়। নাতনির জন্য বাতাসা কিনছেন সেতাবগঞ্জের মালতি রানী। বয়স ষাটের মতো। কথা হয় তার সঙ্গে। কী চাইলেন শঙ্খবাণীর কাছে? উত্তরে শুধুই মুচকি হাসি। মনোবাসনার কথা নাকি বলতে হয় না।

মেলার একটি হোটেলে চলে আমাদের দুপুরের খাবার। খিচুড়ির সঙ্গে কবুতরের মাংস। রান্নাটি বেশ। এখানো মনে হলে মুখে জল এসে যায়।

বিকেলের দিকে পুরো দমে জমে উঠে মেলাটি। তিল পরিমাণ জায়গা নেই মেলাপ্রাঙ্গণে। হাজার হাজার মানুষ। অথচ কোনো ভেদাভেদ নেই। শঙ্খবাণীর টানে বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে সবাই যেন উজাড় করে দিচ্ছে নিজেকে। নানা বাদ্য বাজছে মেলাময়। চারপাশের রাস্তায় ভিড় লেগেছে সাইকেল, ভ্যান, মহিষের গাড়ি আর মোটরসাইকেলের। যে যেভাবে পারছে দলবেঁধে ছুটে আসছে মেলাস্থলে। চারপাশে অন্ধকার নামতেই আমরা ফিরতি পথ ধরি। বৈশাখ আসলে আজও মনে পড়ে শঙ্খবাণী মেলাটির কথা।

সময়ের হাওয়ায় বদলে গেছে অনেক কিছু। কিন্তু এখনো রামচন্দ্রপুরের মতো সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় বৈশাখী মেলার আয়োজন চলে। বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন ও নতুন মাস বৈশাখকে বরণ করে নিতে চলে মেলাসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন। খেলনা টমটমের টুং টাং শব্দ, তালপাতার বাঁশির সুর, নাগরদোলায় দোল খাওয়া শিশু-কিশোরদের আনন্দ ধ্বনি আর পুতুল নাচের আসর থেকে মাইকে ভেসে আসা লোকজ গানের সুর এসবই আমাদের বাঙালি সত্তাকে আন্দোলিত করে। তাই বৈশাখে গ্রামবাংলায় আয়োজিত মেলাগুলোই বাঙালি ঐতিহ্য। এটি বাংলা নববর্ষ উৎসবের এক অবিচ্ছেদ্য অংশও।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল; ১৪ এপ্রিল ২০২৩

© 2023, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button