হিন্দুদের বাড়িগুলো পাহারা দিয়েছেন মুসলমানেরা
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গ্রামের মুসলমানরা দরবার করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যেন কোনোভাবেই হিন্দুদের বাড়িতে আক্রমণ না হয়। তাদের কাছে হিন্দুরা ছিল আমানতের মতো। ফলে গ্রুপ করে করে হিন্দুদের বাড়িগুলো পাহারা দিয়েছেন মুসলমানেরা।
“আমার বাবা ছিলেন ধর্মগুরু। রতনকান্দি, পরজুনা, বাচড়া ও নন্দলালপুর গ্রামের মানুষ তাকে এক নামে চিনত। পূজা-অর্চনার আয়োজন হলেই দূর-দূরান্ত থেকে ডাক আসত তার। বাবার সঙ্গে তখন আমিও যেতাম ধর্মীয় কাজে সাহায্য করতে।
আমার ছোটবেলাটা ছিল অন্যরকম। বাল্যবন্ধু আব্দুল মজিদ সরকার, গোলাম মাহবুব নান্নু, ননী গোপাল সরকার, ইমান আলী প্রমুখের সঙ্গে সারাদিন কাটাতাম। লেখাপড়ার পাশাপাশি ব্যস্ত থেকেছি খেলাধুলা নিয়েও। ফুটবল, লাটিম আর ছিল মার্বেল খেলা। মাঝেমধ্যে গ্রামের পাশেই দলবেঁধে পিকনিক করতে যেতাম। ওইসব স্মৃতি মনে হলে এখনও আনমনা হয়ে যাই।
স্কুলের শিক্ষকদের কথা খুব মনে পড়ে। দায়িত্ব নিয়ে পড়াতেন তারা। প্রাইমারি স্কুলে আব্দুল লতিফ ও হোসাইন মোহাম্মদ স্যার ছিলেন সকলেরই প্রিয়। বড় ভাই দেবেন্দ্রনাথ সান্যাল ছিলেন রতনকান্তি নিম্নমাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ভাই হলেও এতটুকু ছাড় দিতেন না তিনি। সেখানে ছিলেন মওলানা রফিকুল্লাহ ও মোহাম্মদ শাহআলম স্যারও। তারা খুব স্নেহ করতেন আমাদের। শিক্ষকরা তখন ছাত্রদের মন থেকেই ভালবাসতেন। ফলে তারা আমাদের মনের ভেতর এখনও জায়গা করে আছেন। এখন তো সেটা পাবেন না। শিক্ষকরা এখন টাকা ইনকামেই ব্যস্ত বেশি। ছাত্রদের প্রতি দায়িত্ব ও ভালোবাসা শিক্ষকদের মাঝে আগের মতো নেই।
গ্রামে হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ ছিল না। বরং আমাদের গ্রামটা ছিল ঐতিহ্যবাহী অসাম্প্রদায়িক গ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গ্রামের মুসলমানরা দরবার করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যেন কোনোভাবেই হিন্দুদের বাড়িতে আক্রমণ না হয়। তাদের কাছে হিন্দুরা ছিল আমানতের মতো। ফলে গ্রুপ করে করে হিন্দুদের বাড়িগুলো পাহারা দিয়েছেন মুসলমানেরা। এ কারণে অত্যাচার ও নির্যাতনের মুখে পড়তে হয়নি হিন্দুদের। আবার একাত্তরে গ্রামের একজন মানুষও পিসকমিটি বা রাজাকারে যুক্ত হয়নি। এটাও ছিল আমাদের জন্য গর্বের বিষয়।”
শৈশব ও কৈশোরের নানা ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল। তার বাড়ি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার রতনকান্দি গ্রামে। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই আলাপ চলে যুদ্ধদিনের নানা প্রসঙ্গে।
দ্বিজেন্দ্রনাথ সান্যাল ও নিলীমা সান্যালের তৃতীয় সন্তান দেবেশ চন্দ্র সান্যাল। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি রতনকান্দি প্রাইমারি স্কুলে। পঞ্চম শ্রেণি পাসের পর ভর্তি হন রতনকান্দি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। একাত্তরে তিনি ছিলেন ওই স্কুলেরই অস্টম শ্রেণির ছাত্র।
দেবেশ চন্দ্র সান্যালরা দেশের খবর জেনে নিতেন বড়দের নানা আলোচনা থেকে। ১৯৬৯ সাল। আন্দোলন চলছে সারাদেশে। চায়ের দোকানে মানুষ বলাবলি করত– ‘দেশের অবস্থা ভাল না।’ যারা ঢাকা থাকতেন তারা গ্রামে ফিরলে তাদের মুখেও শুনেছেন আন্দোলন-সংগ্রামের ঘটনা। ওসব কথা দেবেশের কিশোর মনকে খুব ভাবাত।
১৯৭০ সাল। নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি সামরিক সরকার। দেবেশদের আসনে (চৌহালী-শাহজাদপুর) এমএনএ প্রার্থী ছিলেন আওয়ামী লীগের সৈয়দ হোসেন মনসুর তারা মিয়া। তার প্রতিপক্ষ ছিলেন জামায়াতে ইসলামের ব্যারিস্টার কোরবান আলী [একাত্তরে এই ব্যারিস্টার ছিল পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর প্রচার সম্পাদক ও পূর্ব পাকিস্তান শান্তি কমিটির এক ভাইস চেয়ারম্যান। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজ এলাকায় গড়ে তোলে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী। বাড়িতে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প। রাজাকার-আলবদরদের কাছে কোরবান আলী ‘উনি সাহেব’ নামে পরিচিত]। এমপিএ পদে দাঁড়ান আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আব্দুর রহমান। তার প্রতিদ্বন্দী ছিলেন মুসলীম লীগের মাওলানা ছাইফুদ্দিন এহিয়া খান মজলিশ [একাত্তরে বৃহত্তর পাবনা জেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান]। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীই বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন।
নির্বাচনে সারাদেশে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও ক্ষমতা দিতে টালবাহান করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। ফলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু নানা নির্দেশনা দিয়ে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন ঢাকায়, রেসকোর্স ময়দানে। সিরাজগঞ্জে দেবেশরা তা শোনেন পরদিন, রেডিওতে। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো……এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর ওই কথাগুলোই দেবেশের কিশোর মনে দাগ কাটে। দেশকে শক্রমুক্ত করার শপথও নেন তিনি।
এরপর কী ঘটল?
দেবেশ চন্দ্র সান্যাল বলেন, “ঢাকায় শুরু হয় গণহত্যা। ২৮ মার্চ কারফিউ উঠলে ঢাকা থেকে অনেকেই চলে আসেন গ্রামে। তাদের মুখেই শুনি গণহত্যার খবর। কিন্তু তখনও আর্মিরা সিরাজগঞ্জে আসেনি। এপ্রিলের ঘটনা। সিরাজগঞ্জের এসডিওর সহযোগিতায় আওয়ামী লীগের নেতা আব্দুল লতিফ মির্জা, মোতাহার হোসেন তালুকদার, হাসিবুর রহমান স্বপন, শাহজাদপুরের আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ আজাদ রহমান শাহজাহান, মোহাম্মদ শাহিদুজ্জামান হেলাল, অ্যাডভোকেট আব্দুর রহমানসহ একটি গ্রুপ আমাদের গ্রামের নদীর পাড়ে বাঘাবাড়ি বন্দরে প্রতিরোধ গড়ে। তাদের সঙ্গে অস্ত্র হাতে ছিল ইপিআর, আনসার ও ছুটিতে আসা বাঙালি সেনা সদস্যরা। তারা নদীর পাড়ে বাঙ্কার করে অবস্থান নেয়। যাতে পাকিস্তানি সেনারা নদীপথে সিরাজগঞ্জে ঢুকতে না পারে। কিন্তু ওদের ভারী অস্ত্রের মুখে তারা টিকতে পারে না। ২৭ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা শাহজাদপুর ঢুকে থানায় ক্যাম্প করে। তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে শান্তি কমিটির নেতারা।
শাহজাদপুরে শান্তি কমিটির নেতা মাওলানা সাইফুদ্দিন ও কোরবান আলী ছাড়াও নামকরা রাজাকার ছিল জয়নাল আবেদীন। ওরা হিন্দুদের ওপর অত্যাচার ও তাণ্ডব চালায়। গৌরকুণ্ডু, প্রাণগোপাল শাহ-এর বাড়ি ছাড়াও বিভিন্ন হিন্দু বাড়িতে লুটতরাজ শুরু করে। আর্মিরা আমাদের গ্রামের বাজারে এসেও তাণ্ডব চালায়। এরপরই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কথা ভাবতে থাকি।”
এপ্রিলের শেষের দিকের কথা। দেবেশরা খবর পান এক রাতে রতনকান্দি ঘাট থেকে নৌকা ছাড়বে। যারা মুক্তিযুদ্ধে যেতে চায় তারা সেখানে একত্রিত হবে। কাউকে কিছু না জানিয়ে কিশোর দেবেশও ওই ঘাটে হাজির হন। ওখানে আসেন বাছরা গ্রামের আব্দুল ওহাব, শাহজাদপুরের আব্দুর রাজ্জাক, মো. এরশাদ আলীসহ প্রায় ২২ জন। মূলত এমপিএ অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আব্দুর রহমানের নেতৃত্বেই ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতে যান তারা।
রাতে নৌকা ছেড়ে বিভিন্ন ঘাট হয়ে তারা চলে যান পাবনার সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়া নামক জায়গায়। পরে আরেক নৌকায় নদী পার হয়ে আসেন কুষ্টিয়ার কুমারখালিতে। এক বাড়িতে আশ্রয় নেন। পরে এক রাতে হেঁটে ঢোকেন ভারতে।
বাকী ইতিহাস শুনি দেবেশের মুখে। তার ভাষায়, “মেঘাচ্ছন্ন রাত। গুড়িগুড়ি বৃষ্টিও হচ্ছিল। বিদুৎ চমকানো আলোতে আমরা পথ চলি। জলঙ্গিতে বর্ডার পার হয়ে ভারতের নদীয়া জেলার মালদহতে প্রথম যাই। সেখান থেকে যাই কামারপাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে। বয়স কম হওয়ায় আমাকে প্রথম নিতে চায়নি। ক্যাম্প ইনচার্জ ছিলেন বেড়া-সাথিয়ার এমএনএ অধ্যাপক আবু সাঈদ। যুদ্ধে যাওয়ার প্রবল আগ্রহ ছিল আমার। তা দেখে আমাকে নিতে সুপারিশ করেন অ্যাডভোকেট আব্দুর রহমান ও এরশাদ সাহেব। এভাবেই ভর্তি হই কামারপাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে।
সেখানে তিনদিন চলে লেফট-রাইট। এর পর পাঠানো হয় কুরমাইল ক্যাম্পে। একদিন পর প্রথম মালঞ্চ ক্যাম্পে এবং পরে পতিরাম ক্যাম্পে চলে যাই। সেখান থেকে বাছাই করে ট্রাকযোগে পাঠিয়ে দেওয়া হয় শিলিগুড়ির পানিঘাটা ট্রেনিং ক্যাম্পে। একুশ দিনের ট্রেনিংয়ে শিখি থ্রি নট থ্রি, এলএমজি, এসএলআর, স্টেনগান, হ্যান্ড গ্রেনেড, এক্সপ্লোসিভ প্রভৃতি। ভারতীয় সেনারা ট্রেনিং করান। খুব আন্তরিক ছিলেন তারা। ডিএস ভিলোন নামে এক শিখ সেনার কথা এখনও মনে হয়। ডেলটা কোম্পানিতে এক তাবুতে ছিলাম নজরুল ইসলাম, রতন কুমার দাস ও রবীন্দ্রনাথ বাগচীর সঙ্গে। আমার এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর ছিল ৪৭৪২।”
ট্রেনিং শেষে মুক্তিযাদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যালদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় সাত নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টার তরঙ্গপুরে। সেখানে এলাকাভিত্তিক দশ জনের একটি গ্রুপ হয়। দেবেশদের মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপটির কমান্ডার ছিলেন বেলকুচি উপজেলার তামাইর গ্রামের এম এ মান্নান। ডেপুটি কমান্ডার হন শাহজাদপুরের জামিত্তা গ্রামের রবীন্দ্রনাথ বাগচী। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে এ গ্রুপটি দেশে ঢোকেন।
কীভাবে?
তিনি বলেন, “ট্রেনে আসামের দুপরি হয়ে আসি মানকাচর। সেখানে থেকে যাই কুড়িগ্রামের রৌমারী। ওটা ছিল মুক্ত এলাকা। বাহাদুরাবাদ ঘাট এলাকায় পাকিস্তানি সেনারা স্পিডবোট দিয়ে টহল দিত। ফলে বিপদজনক এলাকা ছিল সেটি। একরাতে আমরা নৌকায় পজিশন অবস্থায় বাহাদুরাবাদ ঘাটের সামনে দিয়েই প্রথমে কাজীপুর এবং পরে টাঙ্গাইলের সিঙ্গুলিয়া চরে আসি। একদিন পর যাই সিরাজগঞ্জ বেলকুচির কামারখন্দের এমএনএ মোতাহার হোসেন তালুকদারের বাড়িতে। বাড়িতে ছিলেন তার ভাই আব্দুর রশিদ তালুকদার। তিনিই আমাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। আমির হোসেন ভুলুর নেতৃত্বে একটি গ্রুপসহ ওই এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের আরও কয়েকটা গ্রুপ ছিল। ছিলাম গেরিলা। নির্দেশ ছিল আক্রমণ করেই সরে পড়ার। প্রথম দিকে পাকিস্তানি সেনাদের আতঙ্কিত করাই ছিল মূল কাজ।”
কয়েকটি অপারেশনের কথা বলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল।
তার ভাষায়, “নভেম্বরের প্রথম দিকে আমরা বেলকুচি থানা ও মুসলিম লীগ নেতা মতিন সাহেবের বাড়ি রেকি করি। পরে একদিন রাতে বেলকুচি থানা আক্রমণ করি, দুটো গ্রুপ মিলে। আক্রমণের ফলে অধিকাংশ পাকিস্তানি পুলিশ ও রাজাকাররা পালিয়ে যায় যমুনা নদীর ঘাট দিয়ে। ওদের কিছু লোক পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করে, কিন্তু পেরে উঠে না। ওই অপারেশনে আমরা অনেক অস্ত্র পাই। একজন পাকিস্তানি পুলিশ ও এক রাজাকার সেখানে মারা যায়। ওইদিন দুজন রাজাকারকেও জ্যান্ত ধরে এনেছিলাম। প্রথম অপারেশনেই জয় পাই। ফলে মনোবল যায় বেড়ে।”
স্থানীয় যুবকরা অস্ত্র চালানোর ট্রেনিং নিলে গ্রুপে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়ে যায়। তখন দেবেশদের গ্রুপটিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। রবীন্দ্রনাথ বাগচীর নেতৃত্বে দেবেশসহ ১৪ জনের গ্রুপটি অবস্থান নেয় কল্যাণপুর নামক স্থানে। সেখানে সাধারণ মানুষ তাদের খাবার ও খবর দিয়ে সহযোগিতা করত।
গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আছে– একবার দুই পাকিস্তানি দালাল গোপনে বেলকুচি আর্মি ক্যাম্পে এ খবর দিয়ে আসে।
এরপর কী ঘটে?
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “আমাদের ধরতে ওরা আসে বহরা গ্রামের মধ্য দিয়ে। সামনে দুই দালাল, মুখ কাপড় বাঁধা। তারা আর্মিদের পথ দেখিয়ে আনছে। আমরা একটি বাঁশঝাড়ের ভেতর বাঙ্কার করে পজিশনে থাকি। কাছাকাছি আসতেই কমান্ডারের নির্দেশে ফায়ার ওপেন করি। শুরু হয় গোলাগুলি। যুদ্ধ চলে প্রায় এক ঘন্টা। আমাদের গুলিতে ওদের দুইজন ছিটকে পড়ে। টিকতে না পেরে ওরা তখন পিছু হটে।”
প্রতি রাতেই দেবেশদের শেল্টার পরিবর্তন করতে হতো। দৌলতপুর, বাজিয়ারপাড়া, টেংগাসিয়া গ্রামে তারা আত্মগোপন করে থাকতেন। কমান্ডার সবাইকে পাসওয়ার্ড বলে দিতেন। নিজেদের লোক চিনতেই ছিল এ ব্যবস্থা। একজন গোলাপ বললে আরেকজনকে বলতে হতো জবা– এমনটাই ছিল পাসওয়ার্ড। সৈয়দপুর নামক গ্রামে কালা চক্রবর্তীর বাড়িতে ছিল দেবেশদের গ্রুপটি। ২৫ নভেম্বর তারা খবর পান পাকিস্তানি আর্মিরা পালিয়ে যাচ্ছে। তারা তাদের পিছু নেন।
মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ বলেন, “ওরা টাঙ্গাইল যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে নদী পার হয়ে মালি পাড়া আসে প্রথম। সেখান থেকে দুজন রাজাকারকে সঙ্গে নেয় পথ চেনানোর জন্য। ওরা সরে যাবে বেড়া উপজেলার দিকে। কইজুরী নামক স্থানে এসে ওরা মুলা ক্ষেত থেকে মুলা তুলে নেয়। ওরা ভেবেছিল ওটা কোনো ফল। মুলা মুখে দিয়েই ওরা ফেলে দিচ্ছিল। দূর থেকে আমরা সব দেখি। অবস্থান বুঝেই ওদের ওপর আমরা আঘাত হানব। এমনটাই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু দীপপুর নামক স্থানে এসেই ওরা আমাদের দেখে ফেলে। ফলে শুরু হয় গোলাগুলি।
ভিডিও: ১৯৭১: কীভাবে ট্রেনিংয়ে গেলেন এবং সিরাজগঞ্জে অপারেশন করতেন দেবেশ চন্দ্র সান্যাল
আমরা ওয়াপদার পশ্চিম পাশে পজিশনে, ওরা পূর্বপাশে। গোলাগুলি শুরু হলে গ্রামের ভেতরে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রুপগুলোও সাহায্যে এগিয়ে আসে। দুই ঘন্টা যুদ্ধ হওয়ার পর সন্ধ্যা নামে। রাতে মাঝেমধ্যে গুলি আসছিল দীপপুর সার গুদাম থেকে। ভোরের দিকে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আমির হোসেন ও রবীন্দ্রনাথ বাগচীর নেতৃত্বে সার গুদাম ঘেরাও করা হয়। সেখানে মাত্র দুজন রাজাকার কাভারিং ফায়ার করছিল। আর্মিরা রাতেই ভেড়াখোলা নামক স্থান থেকে নৌকাযোগে সরে পড়ে। দীপপুর যুদ্ধে আব্দুল খালেক নামক একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। দুজন পথচারীও মারা যায়। ওটাই ছিল আমাদের শেষ অপারেশন। এর পর আমরা জামিত্তা হাই স্কুলে ক্যাম্প করে থাকি। ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ হানাদার মুক্ত হয় শাহজাহাদপুর উপজেলা।”
রণাঙ্গন ছিল নিজের এলাকাতেই। কিন্তু পরিবারের সঙ্গে কি আপনার যোগযোগ ছিল?
মুক্তিযোদ্ধা দেবেশের উত্তর: “না। আমি মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পর শাহজাদপুর থেকে রাজাকাররা এসে বাবাকে হুমকি দিয়ে বলে যান সাত দিনের মধ্যে দেবেশকে হাজির করতে হবে। তা না হলে সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হবে। ওরা কয়েকটি হিন্দু পরিবারের বাড়িঘরও জ্বালিয়ে দেয়। তখন ভয়ে রাতের অন্ধকারে আমার পরিবার পালিয়ে যায় ভারতে, আশ্রয় নেন মানকাচর শরণার্থী ক্যাম্পে। স্বাধীনের পর তারা ফিরে আসেন।”
মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের কথা তুলে ধরেন এ বীর মুক্তিযোদ্ধা। বলেন, “গ্রামের ভেতরই মানুষের বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকতাম। সাধারণ মানুষ সাহায্য না করলে একাত্তরে গেরিলা যুদ্ধ করা সম্ভব হতো না। ভয় ছিল খুব। সাহায্যের কথা পাকিস্তানি আর্মি জানতে পারলে এসে বাড়িঘর পুড়িয়ে দিত। মানুষকে পাখির মতো গুলি করে মারত তারা। এটা জেনেও সাধারণ মানুষ সঙ্গে থাকত। মুক্তিযুদ্ধে তাদের বীরত্বও কম ছিল না। এটা ছিল আমাদের জন্য অনেক বড় শক্তি।”
একাত্তরে যুদ্ধ করে আমরা একটি স্বাধীন দেশ, একটি পতাকা ও নির্দিষ্ঠ ভূখণ্ড পেয়েছি। এটিই অনেক বড় প্রাপ্তি বলে মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল। তাদের স্বপ্ন ছিল অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ও সোনার বাংলার। কিন্তু সেটি এখনও হয়নি বলেন মত দেন তিনি।
স্বাধীনতা লাভের পর লেখাপড়া শেষ করে এ মুক্তিযোদ্ধা চাকরি পান সোনালী ব্যাংকে, জুনিয়র ক্লার্ক পদে। সর্বশেষ তিনি সিরাজগঞ্জে সোনালী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসে সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে দেশ ভাল চলছে বলে মনে করেন এই সূর্যসন্তান। অকপটে বলেন অতীত অভিজ্ঞতার কথাও। তার ভাষায়, “জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর নামই বলা যেত না। তখন এদেশ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনিরাপদ। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজাকারেরা রাষ্ট্র ক্ষমতার দখলে ছিল। ফলে বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের হয়রানি ও নির্যাতন করা হতো। কিন্তু বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান বাড়িয়েছে। ভাতা না বাড়লে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকেই এ বয়সে ভিক্ষা করতে হতো। তারা এখন পরিবার নিয়ে সুখে আছে, ভালোভাবে চলতে পারছেন। এ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিচ্ছেন। তাই এ সরকারের ওপর মুক্তিযোদ্ধাদের দোয়া থাকবে সবসময়।”
তিনি আরও বলেন, “দেশের উন্নয়ন তো হচ্ছে। এটা অস্বীকার কেউ করতে পারবে না। শুধু দুর্নীতিটা বন্ধ করতে হবে। প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় এখনও ঘাপটি মেরে আছে রাজাকার ও জিন্দাবাদী চেতনার লোক। সরকারকে নানাভাবে বিপদে ফেলার চেষ্টা করে তারা। তাই তাদের ব্যাপারেও সর্তক থাকতে হবে। পাশাপাশি দুর্নীতিবাজদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তাদের শেল্টারদাতাদেরও বিচার করা প্রয়োজন।”
প্রজন্ম যেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ে, তারা যেন লেখাপড়া করে নিজেদেরকে যোগ্য করে গড়ে, তাদের ভেতর যেন দেশপ্রেম জাগ্রত হয়– এমনটাই প্রত্যাশা বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যালের। চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে শেষে তাদের উদ্দেশ্যে তিনি শুধু বললেন, “আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম তখন জীবনের কোনো মায়া ছিল না। বেঁচে আসব এমন কোনো নিশ্চয়তাও ছিল না। পাকিস্তানিদের আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত দুর্ধর্ষ সেনাদল ছিল। তবুও আমাদের দেশপ্রেমের কাছে ওরা পরাজিত হতে বাধ্য হয়েছিল। তোমরাও সততার সঙ্গে স্বাধীন এই দেশটাকে এগিয়ে নিও। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নিজেদের গড়ে তোলে। একাত্তরের বীরত্বের ইতিহাসই অসময়ে তোমাদের সাহস জোগাবে।”
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ১৬ এপ্রিল ২০২৩
© 2023, https:.