৭১-এর যুদ্ধশিশু নিয়ে টরন্টোতে সুলতানার শিল্পপ্রদর্শনী
ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে ঘুম পাড়াতে নয়, বরং ঘুম ভাঙাতে হবে– এমনটাই অভিমত এ শিল্পীর।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন যারা, তাদের রক্ত-ঘাম-ত্যাগে সৃষ্ট বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি এবং তাদের সহযোগী জামায়াত-রাজাকারগোষ্ঠী কর্তৃক ধর্ষিত হয়েছিল দুই থেকে চার লক্ষ নারী। বঙ্গবন্ধু তাদের ‘বীরাঙ্গনা’ বলেছেন, ধানমণ্ডির নিজ বাড়ির ঠিকানা দিয়েছিলেন সবাইকে।
বীরাঙ্গনাদের গর্ভে জন্ম নিয়েছিল প্রায় ২৫ হাজার যুদ্ধশিশু। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও ডেনমার্কে দত্তকায়ন করা হয় সেসব যুদ্ধশিশুদের। বিস্ময়কর হলেও সত্য সেসব পবিত্র যুদ্ধশিশুরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এখনও প্রায় বিস্মৃত। আমাদের জাতীয় গাথায় উঠে আসেনি তাদের ত্যাগের কাহিনি।
কিন্তু আশার কথা, শিল্পের মাধ্যমে একাত্তরের সেসব যুদ্ধশিশুদের কথাই তুলে ধরার উদ্যোগ নিয়েছেন শিল্পী আসমা সুলতানা। ‘লং লস্ট লালাবাইজ’ (বিস্মৃত ঘুমপাড়ানি গান) শিরোনামে তার একক শিল্পপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে চলতি মাসের ১৯ তারিখ থেকে অগাস্টের ৬ তারিখ পর্যন্ত, জেরারড আর্ট স্পেস, ১৪৭৫ জেরারড স্ট্রিট ইস্ট, কানাডার টরন্টোতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা অনুষদ থেকে ‘অংকন ও চিত্রায়ন’ বিভাগে স্নাতক পাশের পর লন্ডন ও টরন্টোতে চারুকলা ও শিল্পকলার ইতিহাস বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন আসমা সুলতানা। স্বাধীন শিল্পী হিসেবে তিনি কানাডা, যুক্তরাজ্য, ভারত ও বাংলাদেশে বেশকিছু একক ও যৌথ শিল্পপ্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। বর্তমানে এ শিল্পী কানাডায় বসবাস করে স্বাধীনভাবে দৃশ্যশিল্পের চর্চা করছেন, পাশাপাশি কানাডার ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ও যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ‘শিল্পকলার ইতিহাস’ বিষয় নিয়ে পড়ছেন।
শিল্পকলা নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সুলতানা নিয়মিত লেখালেখি করেন। শিল্পকলার ইতিহাস নিয়ে ইতোমধ্যে তার তিনটি অনূদিত বই প্রকাশিত হয়েছে: ‘সভ্যতা- একটি ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি, দেখার দৃষ্টিভঙ্গি’, ‘পৃথিবীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ ও ‘শিল্পকলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’। এছাড়া ‘বালিশে লেগে থাকে বনভূমির ঘ্রাণ’ ও ‘মিউজিয়াম অব ব্রোকেন রিলেশনশিপস’ নামে তার দুটি কবিতার বই রয়েছে।
এ শিল্পী বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে নিজের চুল দিয়ে নানা ধরনের নকশা তৈরি করেন। এমনকি শিশুদের কাপড়, শাড়ি কিংবা কাঁথায়। তবে এসব সৃষ্টির নেপথ্যে রয়েছে তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও প্রবাস জীবনের কথা। নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে আসার যন্ত্রণা, শেকড় ছেঁড়ার কষ্ট, স্বপ্নভঙ্গের বেদনা- সব উঠে আসে তার শিল্পকর্মে।
দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র কিছুটা পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করে তিনি রূপান্তরিত করেন শিল্পকর্মে। যেমন তার ব্যবহৃত টুথব্রাশের প্লাস্টিকের ব্রিসলগুলো ফেলে দিয়ে সেখানে বসিয়ে দেন নিজের মাথার চুল। অথবা নিজের ব্যবহৃত চিরুনির দাঁতের পরিবর্তে যোগ করে দেন চুল। এমনকি তার ছবি আঁকার তুলির চুলগুলোও তার নিজের চুল দিয়ে প্রতিস্থাপন করেন।
প্রকৃতিতে ক্রমাগত এই যে স্থান পরিবর্তন, গাছের পাতা পড়ে যাওয়া, পাখিদের এক দেশ ছেড়ে অন্যদেশে পাড়ি জমানো, প্রাণীদের স্থানান্তরিত হওয়ার উপাখ্যান, সবকিছু ধরা পড়ে সুলতানার শিল্পী জীবনের প্রতিফলনের সাথে। শেকড়ের কথা ভুলতে না পারলেও ঘুড়ির মতো ওড়ার স্বপ্ন, তার যাযাবর জীবনে ভিন্ন সংস্কৃতিকে আপন করার প্রচেষ্টা এবং নিজ সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার অভিজ্ঞতা- সবকিছুই চমৎকার ফুটে ওঠে তার শিল্পসৃষ্টিতে।
মুক্তিযোদ্ধা পিতার মতোই সুলতানার অন্তরজুড়ে রয়েছে বাংলাদেশ। নিভৃতে থেকে সততার সঙ্গে এ শিল্পী চেষ্টা করছেন বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে। উন্নত জীবনযাপনে সুলতানা ভুলে যাননি নিজের মাতৃভূমিকে। ফলে দেশ নিয়ে তার ভালোবাসা, চিন্তা ও চেতনা প্রভাব বিস্তার করে কাজে। মাতৃভাষা বাংলা, মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের ইতিহাস এবং রক্তে পাওয়া স্বাধীনতা নিয়ে সুলতানার আবেগ ও অনুভূতিগুলোই যেন উঠে আসে তার সৃষ্টিতে।
মায়ের কোল নিরাপদ আশ্রয় হওয়ার কথা ছিল। অথচ একাত্তরে মায়েদের জঠরই হয়েছে অনেক শিশুর সমাধিস্থান। এ ভয়াবহ গণহত্যার মাঝেও যারা বেঁচে ছিলেন, তাদের পাড়ি দিতে হয়েছিল ভিনদেশে কোনো বিদেশি মা-বাবার ঘরে পালিত সন্তান হয়ে। সেই যুদ্ধশিশুদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আমাদের মানচিত্র, পতাকা, মাটি ও পরিচয়।
কিন্তু তারপরই আমরা ভুলে গেছি তাদের কথা। আমরা আত্মপরিচয়ের গ্লানি নিয়ে বেঁচে আছি বিস্মৃতির পথে হারিয়ে গিয়ে। আমাদের স্মৃতি, দৃষ্টি, সবকিছু ঘোলাটে হয়ে গেছে রাজনীতি, জীবন দর্শন ও ব্যক্তিস্বার্থে। তাই ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে ঘুম পাড়াতে নয়, বরং ঘুম ভাঙাতে হবে- এমনটাই অভিমত শিল্পী আসমা সুলতানার। তার শিল্পকর্ম নিশ্চয়ই আমাদের বিবেকবোধের ঘুম ভাঙাবে, সদা জাগ্রত রাখবে একাত্তরকে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজ বিভাগে, প্রকাশকাল: ১৩ জুলাই ২০২৩
© 2023, https:.