জুন ১৯৭১ : ‘জনযুদ্ধ’ শুরু, খন্দকার মোশতাকদের ষড়যন্ত্রও শুরু
২৬ মার্চ ২০২১ থেকে ৩১ মার্চ ২০২২ পর্যন্ত স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করেছে বাংলাদেশ৷ এক বছর পর, অর্থাৎ, ২০২৩ সালের মার্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে ফিরে তাকানো শুরু করে ডয়চে ভেলে বাংলা৷ বীরত্ব, আত্মত্যাগের গৌরব ও বেদনার সেই নয় মাসে পর্যায়ক্রমে ফিরে তাকানোর এই পর্বে থাকছে জুন ১৯৭১-এর কিছু ঘটনা….
মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি একাত্তরে আরেকটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলা হয়। বাহিনীটিকে প্রথমে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স, সংক্ষেপে বিএলএফ বলা হলেও পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে সেটির নামকরণ হয়- মুজিব বাহিনী। মূলত দেশ থেকে আসা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়েই ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল এস এস উবানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গঠিত হয় এ বাহিনী।
মুজিব বাহিনীর প্রায় ১০ হাজার সদস্যকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে তারাই দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে স্থানীয়দের প্রশিক্ষণ ও রাজনৈতিক আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত করে সাংগঠনিক কাঠামো বৃদ্ধি করবে- এমনটাই ছিল পরিকল্পনা। কেন্দ্রীয়, পূর্বাঞ্চলীয়, দক্ষিণাঞ্চলীয়, উত্তরাঞ্চলীয়- এই চারটি সেক্টরে ভাগ করে এ বাহিনী যুদ্ধ পরিচালনা করে।
বিএলএফ-এর ধলেশ্বরী হেডকোয়ার্টারের জোনাল কমান্ডার ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মোহাম্মদ সিরাজুল হক। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন তিনি। জুনের মাঝামাঝিতে সীমান্ত পার হয়ে চলে যান ভারতে, মহারাজা বীর বিক্রম কলেজ ক্যাম্পে। সেখানেই তার সঙ্গে দেখা হয় আ স ম আব্দুর রব ও আব্দুল কুদ্দুস মাখনের ।
সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘রব ভাই নিয়ে গেলেন আগরতলায় ‘শ্রীধর ভিলা’ নামের এক বাড়িতে, (শেখ ফজলুল হক) মনি ভাইয়ের কাছে। উনি বললেন– ‘একটা বাহিনী করতেছি। তুই, ছেলে কালেকশন করে দিবি।’ জানলাম ওটা বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী।কিন্তু যুদ্ধে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব আমি। পরদিন তার কাছে গিয়ে বললাম– ‘আমাকে আগে ট্রেনিংয়ে পাঠান। এরপর আপনি যা বলবেন তাই করবো।’ মুচকি হেসে তিনি বললেন– তুই কালই ট্রেনিংয়ে যাবি।’’
‘‘আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতের দেরাদুন মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে। বিএলএফের ফাস্ট ব্যাচে ছিলাম ৪৯৬ জন। ট্রেনিং হয় দেড় মাস। ইন্ডিয়ান আর্মির মেজর মালহোতরা ছিলেন ক্যাম্পে। সিলেটের একজন রিটায়ার্ড বাঙালিও ছিলেন, নাম কর্নেল পুরকায়াস্থ প্রকাশ। যুদ্ধকালীন আমাদের সরাসরি কমান্ড করতেন বিএলএফ-এর অধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মনি। তোফায়েল আহমদ, সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাকও ছিলেন এই বাহিনীর যৌথ অধিনায়ক। মনি ভাইয়ের স্বাক্ষরিত ও হাতে লেখা নির্দেশনা মেনেই আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি।’’
সিরাজুল হকের মতে, ‘‘বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী ছিল পলিটিকো ওয়ার গ্রুপ। মুক্তিযুদ্ধের পরে বামপন্থিরা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে পারে, তাই আওয়ামী লীগের একটা গ্রুপ থাকা প্রয়োজন, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে যারা পালিটিক্যালি ক্ষমতা দখলে রাখবে- এটাই ছিল উদ্দেশ্য।’’
কিন্ত মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী না হওয়ায় এবং নেতৃত্বেও কোনো সংকট তৈরি না হওয়ায় বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর বিকাশটা তেমন ঘটেনি। তবে একাত্তরে সম্মুখ যুদ্ধ ছাড়াও ছোটখাট বহু অপারেশন করেছেন এ বাহিনীর যোদ্ধারা। শহিদ আর আহতও হয়েছেন অনেকেই।
এদিকে আবু সাঈদ চৌধুরীকে ব্রিটেনে বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয় মুজিবনগর সরকার। ১৭ জুন তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত একটি পত্র ব্রিটেনের রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের বাসভবন বাকিংহাম প্যালেসে এবং আরেকটি পত্র ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের কাছে তুলে দেন।
আন্তর্জাতিক মহলেও তখন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিবৃতি এবং দেশে দেশে প্রতিবাদ বাড়তে থাকে। চীন ও অ্যামেরিকার নীতিগত সমর্থন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে। তাই ভারতের মানুষ মোটর শোভাযাত্রা করে দিল্লিতে চীনা অ্যাম্বাসি ঘেরাও করে এবং বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধে চীনা উদ্যোগের আহ্বান জানিয়ে স্মারকলিপি দেয়। ২৫ জুন পশ্চিমবাংলার বাঙালিরাও বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে মার্কিন দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন এবং স্মারকলিপি প্রদান করে। ওইদিন ফেস্টুনে লেখা দাবিগুলো ছিল- `Arms aid to Pakistan is abetment of genocide’, `Stop The Ship’, প্রভৃতি। সেদিন সবার মুখে উচ্চারিত হয়, ‘বাংলাদেশ থেকে অ্যামেরিকার সাম্রাজ্যবাদ- হাত উঠাও, হাত উঠাও’।
১৭ জুন সুইডেন, হল্যান্ড, ইটালি, অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরিসহ বেশ কয়েকটি দেশ ঐক্যমত প্রকাশ করে বলে, ‘‘পাকিস্তান পূর্ব বাংলার উপর একতরফাভাবে কোনো সমাধান চাপিয়ে দিতে পারে না। ইউরোপের এসব দেশ তাদের মিত্র দেশসমূহের সঙ্গে মিলে ইয়াহিয়া সরকারকে তাদের এই মনোভাব জানিয়ে দেবে।”
ওইসময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খাঁ। এ সময় তাকে শরণার্থীদের অবস্থা সম্পর্কে অবগত করে ইন্দিরা গান্ধী গণহত্যা বন্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের কড়া পদক্ষেপ দাবি করেন।
এছাড়া বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য স্টেটসম্যান, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, দৈনিক আনন্দবাজার প্রভৃতি পত্রিকায় সম্পাদকীয় ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে থাকে। (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র- দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড, বাংলাদেশ জেনোসাইড অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস-ফজলুল কাদের কাদরী)
মূলত সারাবিশ্বে প্রতিবাদ, পদক্ষেপ ও বিবৃতিগুলো ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে মুজিবনগর সরকারের নানামুখী প্রচার ও উদ্যোগের ফসল।
কিন্তু তখনও মুজিবনগর সরকারের অভ্যন্তরে চলছিল নানা ষড়যন্ত্র। খন্দকার মোশতাক আহমেদ গোপনে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের চেষ্টা করেন। এমন তথ্য মিলে প্রয়াত লে. কর্নেল এস আই এম নূরুন্নবী খানের (বীর বিক্রম) ভাষ্যে। কিছুদিন তিনি কলকাতায় আতাউল গণি ওসমানির এডিসি ছিলেন।
একটি ঘটনা তুলে ধরে নুরুন্নবী বলেছিলেন, ‘‘একদিন নূরে আলম সিদ্দিকী এসে বলে- ‘নবী ভাই, চলেন খন্দকার ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করি। কী অবস্থা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের- একটু জানি।’
মোশতাক সাহেবের কাছে সে জিজ্ঞাসা করে- মুক্তিযুদ্ধের অবস্থা কী? কী হবে আমাদের?
তিনি বললেন, গোলাগুলি করে জনগণের অধিকার আদায় করতে হবে- এই রাজনীতিতে আমি বিশ্বাস করি না। এগুলা করেও কিছু হবে না।
কী করতে হবে?
কাটছাঁট করে ওরা যদি ৬ দফা মেনে নেয়- তাহলে পাকিস্তানিদের সঙ্গে নেগোশিয়েট করা উচিত।
নূরে আলম বলেন- ‘আপনি তো প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এ ব্যাপারে কি কোনো স্টেপ নিয়েছেন?’
মোশতাকের উত্তর- ‘আমি কলকাতায় অ্যামেরিকার এক কনসুলেটরের সঙ্গে লিয়াজোঁ মেনটেইন করছি। যোগাযোগ রাখছি দিল্লিতেও। তাহের ঠাকুর ও মাহবুবুর রহমান চাষীকেও কাজে লাগিয়েছি। শেখ মুজিবকে পাকিস্তান যদি জীবিত ফেরত দেয় আর ৬ দফা কাটছাঁট করে মেনে নেয়, তাহলে আমাদের যাওয়া উচিত।”
ওই সময়ে মোশতাকের ভূমিকা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা মো. মনিরুজ্জামান চৌধুরীও কথা বলেন। মুজিবনগর সরকারের ইয়ুথ অ্যান্ড রিসিপশন ক্যাম্প বিভাগের ডেপুটি ডায়রেক্টর ছিলেন তিনি।
তার বর্ণনায় সেই সময়টা উঠে এসেছে এভাবে, ‘‘ওখানে গিয়ে দেখলাম মুজিবনগর সরকারে অলরেডি দুটা গ্রুপ হয়ে গেছে। একটা গ্রুপ হচ্ছে যারা কনফেডারেশন চাচ্ছিল। এ গ্রুপে ছিলেন মাহবুবুর রহমান চাষী, ব্যারিস্টার মওদুদ, খন্দকার মোশতাক ও তার অনুসারী লোকজন। দে অয়্যার লুকিং ফর সার্পোট। তারা গিয়ে কলকাতায় অ্যামেরিকান কনসাল জেনারেলের অফিসে দেখা করারও চেষ্টা করে। তখন ইন্ডিয়ান ইন্টেলিজেন্স খবর দিলো এরা খুব বিপদজনক, অন্য দিকে যাচ্ছে। তাজউদ্দীন আহমদকেও তারা সর্তক করে দেন। একটা সময় এমন দাঁড়ালো যে, আনঅফিসিয়ালি তাদের নজরবন্দি করে রাখা হয়েছিল। ফলে তারা আর এগোতে পারেনি।’’
ফলে এটা স্পষ্ট যে, যুদ্ধ পরিচালনার পাশাপাশি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদকে সেই কঠিন সময়ে নানা ষড়যন্ত্র সামাল দিয়েও এগোতে হয়েছে। অথচ স্বাধীনতা লাভের পর খন্দকার মোশতাকই তার চাতুর্য দিয়ে ধীরে ধীর বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন হয়ে ওঠে এবং পরবর্তীতে তার নেতৃত্বেই জাতির জনককে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
এদিকে ২৫ মার্চ থেকে শুরু হওয়া পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এদেশীয় দোসর কর্তৃক গণহত্যা সারা দেশেই চলছিল। ১৭ জুন সকালে পাকিস্তানি সেনারা ঝালকাঠির জগদীশপুর, খাজুরা, রামপুর, মিরাখালি ও বেতরা গ্রামে প্রাণের ভয়ে পেয়ারা বাগানে আশ্রয় নেয়া হিন্দু ধর্মালম্বীদের আটক করে পৈশাচিক নির্যাতন চালায়।পরে জগদীশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠের পাশে তাদের দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে। এতে শহীদ হন প্রায় ৬০ জন নিরীহ মানুষ। এমন গণহত্যা চলে সারাদেশেই। (তথ্যসূত্র: গণহত্যা’৭১- তপন কুমার দে)
তবে জুন মাস থেকেই পাকিস্তানি সেনারা পাল্টা আক্রমণের মুখোমুখি হতে থাকে। চট্টগ্রামের চাঁদগাজীতে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তুমুল গোলাগুলি চলে। এতে হানাদার বাহিনীর ৪৫ জন সৈন্য নিহত হয়।
দাতা সংস্থার প্রতিনিধি, বিদেশি সংবাদ মাধ্যমগুলোকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ধারণা দিয়েছিল যে, দেশের কোথাও মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে না এবং ঢাকা শহরও সম্পূর্ণ শান্ত। কিন্তু সেই ধারণা পাল্টে দিয়ে সারাবিশ্বে খবরে জায়গা করে নেয় ঢাকার গেরিলাদের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গ্রেনেড হামলার ঘটনা।
৯ জুন সন্ধ্যায় দাতা সংস্থার বেশকিছু প্রতিনিধি ও বিদেশি সাংবাদিককে নিয়ে পাকিস্তান সরকারের এক অনুষ্ঠানের সময় হোটেলের মূল প্রবেশ পথে তিনটি গ্রেনেড বিষ্ফোরণ ঘটায় গেরিলা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া (বীরবিক্রম), বাদল, চুল্লু, স্বপন, জিয়া ও আলম।
২২ জুন সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে করাচী হয়ে সংক্ষিপ্ত সফরে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা পর্যবেক্ষণে আসেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের লেবার ও কনজারভেটিভ দলের চার সদস্য- আর্থার বটমলি, বব প্রেন্টিস, জেমস র্যামডেন ও টবি জেসেল। ২৪ জুন সকাল সাড়ে সাতটার দিকে হোটেলের লবিতে বিমানবন্দরে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন তারা। ওইসময় তিনজন গেরিলা হোটেলের বারান্দায় দুটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়। (তথ্যসূত্র:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র- নবম খণ্ড, মুক্তিযুদ্ধে ২ নম্বর সেক্টর এবং কে ফোর্স- খালেদ মোশাররফ)
একাত্তরে ঢাকার আজিমপুর সরকারি কলোনিতে স্বাধীনতার পক্ষে দুঃসাহসিক কিছু কাজে যুক্ত ছিলেন ফেরদৌসী হক লিনু, শিরীন আখতার (ফেনি-০১ আসনের সংসদ সদস্য)সহ কয়েকজন স্কুল ও কলেজপড়ুয়া মেয়ে। অজানা সে ইতিহাস শোনা যাক ফেরদৌসী হক লিনুর মুখেই, ‘‘ওখানে অনেক পরিবার ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। তাদের চিঠি লিখলাম৷ লাল চিঠি। লেখা থাকতো– ‘তোমরা যে দালালি করছ, এ খবর চলে গেছে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। তোমাদের শায়েস্তা করা হবে।’ শিরীন আপা, আমি আর ফৌজিয়া খালাম্মা চিঠিগুলো লিখি। শিরীন আপার ছোট বোন বেবী ও ভাই নিলুসহ বাড়ি বাড়ি গিয়ে লেটারবক্সে চিঠি ফেলে আসতাম।পরদিন সকালবেলা নানা অজুহাতে ওইসব বাসায় ঘুরতে গিয়ে দেখতাম মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে তাদের রান্না হয়নি, নাওয়া-খাওয়াও বন্ধ। এটা আমাদের খুব আনন্দ দিতো। এভাবেই শুরুটা হয়।’’
আজিমপুর কলোনির বেশির ভাগই তখন সচিবালয়ে চাকরি করেন। বাড়ি বাড়ি লিফলেট পৌঁছাতে পারলে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগের খবরগুলো দ্রুত সচিবালয় হয়ে পাকিস্তান সরকারের কানে পৌঁছাবে। এমন চিন্তা থেকে তারা তখন লিফলেটও বিতরণ করেছিলেন।
লিনু বলেন, ‘‘গেরিলা সানু ভাই টিচার্স ট্রেনিং কলেজের তৃতীয় শ্রেণির এক কর্মচারীকে দিয়ে সাইক্লোস্টাইল করে লিফলেট বানিয়ে আনেন। কলোনির কাছের বিল্ডিংগুলোতে বেবী ও নিলু আর দূরের বাড়িগুলোতে আমি, লিটু আর শিরীন আপা সন্ধ্যায় হাঁটার নাম করে দরজার নীচ দিয়ে লিফলেট ফেলে আসতাম।
একবার পরিকল্পনা করি আজিমপুরের রাস্তায় পোস্টারিং করার। ফৌজিয়া খালার পরামর্শে রং-তুলি দিয়ে পাকিস্তানি সেনা আর মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি এঁকে পোস্টারে লেখা হয়– ‘পাক আর্মি সারেন্ডার করো’। তারপর আমি আর শিরীন আপা ফজরের আজানের পরপরই আটা দিয়ে আঠা তৈরি করে পোস্টার নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।’’
তখন ঈদ উদযাপন না করার নির্দেশ দিয়ে রোজার সময়ে চিঠিও বিলি করে এই দলটি৷
কিভাবে করেছিলেন তা-ও জানিয়েছেন লিনু, ‘‘বান্ধবী মলি থাকতো ধানমন্ডি ৫ নম্বরে। তার বাংলা ও ইংরেজি হাতের লেখা খুব ভালো ছিল। ওকে ডেকে এনে চিঠি লেখাই। মূল বিষয় ছিল এমন– ‘দেশের মানুষকে পাকিস্তানিরা হত্যা করছে। তাই জাঁকজমকভাবে ঈদ উদযাপন করা যাবে না, নতুন কাপড় পরা থেকে বিরত থাকতে হবে। মুক্তিবাহিনীকে সব রকম সহযোগিতা করতে হবে।’ শেষে লেখা হলো ‘জয় বাংলা, জয় শেখ মুজিব’। বিনীত– স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সংগ্রামী বোনেরা।
কিন্তু ওই চিঠিতে ছবি আঁকতে হবে। সানু ভাইকে বলতেই চারুকলার অধ্যাপক শামসুল ইসলামকে দিয়ে ডাস্টবিনে মানুষ খাবার খাচ্ছে, দেশের অবস্থা মুমূর্ষু এবং অস্ত্রহাতে মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি আঁকিয়ে সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ওই চিঠি তৈরি করে দেন। আজিমপুর কলোনির বাড়িগুলোতে গোপনে আমরা ওই চিঠি বিলি করেছি।’’
ফেরদৌসী হক লিনুরা একাত্তরে যা করেছেন, তা অন্যরকম এক যুদ্ধ। এ কাজে জীবনের ঝুঁকি ছিল অনেক। তবু বুকের ভেতর স্বাধীনতার স্বপ্নকে লালন করে এমন যুদ্ধ তারা চালিয়ে গেছেন। সারাদেশে সাহসী মানুষদের এমন উদ্যোগগুলো স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে খুব বড় ভূমিকা রেখেছিল৷
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগে, প্রকাশকাল: ২৩ জুন ২০২৩
© 2023, https:.